হো চি মিনের দেশে, দ্বিতীয় কিস্তি

ভিয়েতনামের প্রাচীন শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার্থীরা হলো মাছের মতো। মাছ যেমন সমুদ্রে ঘুরেফিরে খাবার আহরণ করে, শিক্ষার্থীরা সেভাবেই জ্ঞান আহরণ করে।

মীর মোশাররফ হোসেনমীর মোশাররফ হোসেন
Published : 5 Dec 2022, 09:43 AM
Updated : 5 Dec 2022, 09:43 AM

পরদিন দেখেছি লেগুন; লোকজন নৌকায় যাচ্ছে, কায়াকিং করছে। কোথাও বিশৃঙ্খলা নেই। হ্যানয়কে খানিকটা অগোছালো মনে হতে পারে; এদিক-সেদিক নানান আকৃতির ভবন উঠছে। কিন্তু যখনই আপনি শহর ছাড়বেন, মানে হাইওয়েতে উঠবেন, আপনি আসলে বুঝতে পারবেন, ভিয়েতনাম আসলে কতটা গোছানো।

বিশাল বড় বড় রাস্তা; জ্যামের ছিটেফোঁটা নেই। মসৃণ রাস্তা, কিছুদূর পর পর ড্রাইভিংয়ের উপযুক্ত সব নির্দেশনা। ইংরেজি এবং ভিয়েতনামি ভাষায়। হাইওয়ে মানে হাইওয়ে, মাঝে মাঝে লোকালয় পড়ছে না। এ রাস্তাতেই আমরা মেকং নদী দেখেছি। আমাদের জন্য যেমন পদ্মা-গঙ্গা; ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার সবাইকে ধরে রেখেছে। মেকং সত্যিই অপূর্ব নদী। হাইওয়ে থেকে যেতে-আসতে দু’বারই ওর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রেখেছিল। চোখে যে সুন্দর ধরবে, তা কী আর লিখে বোঝানো যাবে!

আমাদের আরেক প্রধান লক্ষ্য ছিল হো চি মিনের মুসোলিয়াম দেখা। এটার প্রস্তুতি আগে থেকে নিতে হয়। সবদিন খোলা থাকে না। যেদিন যেদিন থাকে, সেদিনও সকালে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য খোলা থাকে। গাইড আমাদের হোটেলে আসামাত্র আমরা দেরি না করে ছুটলাম মুসোলিয়ামের পথে। 

হো চি মিনের গল্প তো কয়েক দশক পুরনো হয়ে গেছে, একই দল স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতায়, একঘেঁয়ে কী লাগে না তাদের? হয়তো লাগে, কিন্তু তাতে হো চি মিনের আবেদন শেষ হয় না।

শনিবার। স্কুল কলেজ ছুটি; অফিস-আদালত আধাবেলা। মুসোলিয়ামে সকাল থেকে ভিড়। বিদেশিরা তো আছেই, আর আছে অগুণতি ভিয়েতনামি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে নিয়ে এসেছে। ভিয়েতনামের এ জিনিসটা সত্যিই সুন্দর। ইতিহাস তারা ভেতরে গেঁথে নিতে পেরেছে। হো চি মিনের গল্প তো কয়েক দশক পুরনো হয়ে গেছে, একই দল স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতায়, একঘেঁয়ে কী লাগে না তাদের? হয়তো লাগে, কিন্তু তাতে হো চি মিনের আবেদন শেষ হয় না। শনিবার সকালে বিশাল হো চি মিন মুসোলিয়াম দেখতে গিয়ে তাই মনে হলো।

দিনে অল্প যে কয়েক ঘণ্টা খোলা থাকে, তার মধ্যেই গড়ে ৮-১০ হাজার লোক প্রতিদিন ওই মুসোলিয়াম দেখে। এর মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যাই বেশি। মূল বেদিতে যাওয়ার আগে বেশ খানিকটা পথ লাইন ধরে হেঁটে যেতে হয়। পুরো হ্যানয় শহরে গাছপালার অভাব নেই, ছায়াও প্রচুর। মুসোলিয়ামের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে বসার জায়গাও আছে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সৌম্য পরিবেশ। হো চি মিনের দেহ যেখানে মমি করে রাখা তার উল্টো দিকে ওদের পার্লামেন্ট। তখন অধিবেশন চলছে না, সুতরাং নিরাপত্তার কড়াকড়ি নেই।

মূল ভবনের আরেক পাশে ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল সব ভবন। এখন ওগুলো রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানেই বিশাল বাগান, একটুখানি হাঁটলে হো চি মিন শেষ বয়সে যেখানে ছিলেন, সেই দুটি ঘর। আমরা হাঁটছি, গাইড আমাদের ইতিহাসের ভেতর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হো চি মিনের জীবন কাহিনি, তার অকৃতদার থাকা, বিছানা ছাড়া ঘুমানো, ভিয়েতনামের দরিদ্র কৃষক সাধারণ মানুষের জীবনমান বদলানোর স্বপ্ন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে হো চি মিনের মারা যাওয়া, তার প্রিয়ভাজন অনুচরের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, হো চি মিনকে মমি করা, কত কী!

সারা দুনিয়া যাকে হো চি মিন নামে চেনে, ভিয়েতনামে তিনি ‘আঙ্কেল হো’। কারণ, সব ভিয়েতনামিরা তাকে পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ সদস্য মনে করে, যিনি বটগাছের মতো তাদের ছায়া দেবেন।

হো চি মিনের আদেশ ছিল তার দেহ যেন তিন জায়গায় সমাহিত করা হয়। যেখান থেকে তিনি ভিয়েতনাম ছেড়ে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিলেন সেই শহর, যেখানে তিনি জন্মেছিলেন আর হ্যানয়। এদিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ধরাধাম ছেড়ে গেলেন তিনি। যে তিন শহরের কথা তিনি বলেছেন, তার পুরোটা বিপ্লবী বাহিনীর দখলে নেই। যোদ্ধা জেনারেলদের ভাষ্য, হো চি মিনকে মমি করে রাখতে হবে, যেন তার সেই দেহই আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়, অনুপ্রেরণা সেসময় খুবই দরকারি।

হ্যানয়ে আবার সমানে বোমা মারছে যুক্তরাষ্ট্র, ওই সময়ে হ্যানয়ে নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গরমও পড়েছে। তাহলে মমি হবে কীভাবে, সেই টেকনোলজি ভিয়েতনামিদের কাছে নেই। স্বাধীনতা লাভের পুরো প্রক্রিয়ায় ভিয়েতনামের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, একেবারে দিলখোলা বন্ধু। সোভিয়েতের কথা এখনও ভিয়েতনামিরা খুব শ্রদ্ধা, ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করে।

সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা জানালেন, মমি করা সম্ভব নয়। সুতরাং আপাতত কফিনে থাকা মৃতদেহ কিছুদিনের জন্য মাটির নিচে সেলারে এমনভাবে রাখা হোক যেন দেহের খুব বেশি পচন না হয়। সেই টেকনোলজিও তারাই দিয়ে দিলেন। তাদের কথা অনুযায়ী হো চি মিনকে রাখা হলো, বছর চারেক পর সেই কফিন ফিরল হ্যানয়ে, তারপর মমি। গাইড বলছেন, সারা দুনিয়া যাকে হো চি মিন নামে চেনে, ভিয়েতনামে তিনি ‘আঙ্কেল হো’। কারণ, সব ভিয়েতনামিরা তাকে পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ সদস্য মনে করে, যিনি বটগাছের মতো তাদের ছায়া দেবেন।

ভেতরে কনফুসিয়াস বসে আছেন, ‍দুইপাশে তার প্রিয় চার শিষ্য। কাঠের ঘর, ভেতরে ধুপ জ্বলছে, আলো-আধারি; মনে হবে এই বোধহয় সৌম্যদর্শন জ্ঞানী লোকজন তার ছাত্রদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন।

আঙ্কেল হো-র মুসোলিয়াম ছেড়ে বের হয়েই আমরা পেয়ে যাই ‘ওয়ান পিলার প্যাগোডা’। এক পিলারের উপর দাঁড়ানো প্যাগোড়া। ভিয়েতনামের বেশিরভাগ মানুষই তাওইজমে বিশ্বাসী, খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ বুদ্ধিস্ট। ঘরে প্রায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব দেবতার মূর্তি আছে, কনফুসিয়াসও আছেন ঘরে ঘরে। ধর্ম বলতে ওইটুকুই। বাকিসব কর্ম।

আমাদের পরের গন্তব্য ‘টেম্পল অব লিটারেচার’। ভিয়েতনামের এক রাজা একসময় রাজ পরিবার, ধনী লোকজন আর মেধাবী দরিদ্রদের জন্য এ টেম্পল বানিয়েছিল। ভেতরে কনফুসিয়াস বসে আছেন, ‍দুইপাশে তার প্রিয় চার শিষ্য। কাঠের ঘর, ভেতরে ধুপ জ্বলছে, আলো-আধারি; মনে হবে এই বোধহয় সৌম্যদর্শন জ্ঞানী লোকজন তার ছাত্রদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন! হলিউডি ফিল্ম হলে একে নির্দ্বিধায় মার্শাল আর্টের আদি সেন্টার বানিয়ে দেওয়া সম্ভব।

ওই মন্দিরে ঢোকার কয়েকটি গেট, তার প্রায় সবগুলোতেই মাছ খোদাই করা। কেন? গাইড জানালেন, তাদের প্রাচীন শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার্থীরা হলো মাছের মতো। মাছ যেমন সমুদ্রে খাবার আহরণ করে, শিক্ষার্থীরা সেভাবেই জ্ঞান আহরণ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন ‘টেম্পল অব লিটারেচারে’ তাদের গ্র্যাজুয়েশনের আগে আসে, বাবা-মায়েরা তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের পরীক্ষার আগে কচ্ছপের মাথা ছুঁইয়ে দেন।

ভেতরে অনেকগুলো সিমেন্ট দিয়ে বানানো কচ্ছপ কয়েকশ বছরের কালের সাক্ষী দিচ্ছে। কচ্ছপের পিঠে স্লেটে মেধাবীদের কৃতিত্বের কথা লেখা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন ‘টেম্পল অব লিটারেচারে’ তাদের গ্র্যাজুয়েশনের আগে আসে, বাবা-মায়েরা তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের পরীক্ষার আগে কচ্ছপের মাথা ছুঁইয়ে দেন। না, না ওইটাকে কেন্দ্র করে সেখানে মাজার খুলে বসেনি কেউ। দিব্যি খোলামেলা, টিকেট কেটে ঢুকে পড়া যাচ্ছে।

বিদ্যামন্দির পেরিয়ে আমরা চলে গেলাম ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসকদের বানানো কারাগার দেখতে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যারা মুখ খুলতো তাদেরই জায়গা হতো সেখানে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বিশাল বড় কারাগার ছিল। এখন মাত্র ২-৩ শতাংশ টিকিয়ে রাখা হয়েছে, বানিয়ে ফেলা হয়েছে জাদুঘর। এখানেও একই দৃশ্য। অসংখ্য ভিয়েতনামি তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছে। ঔপনিবেশিক আমলের বর্বর নির্যাতন সম্বন্ধে জানাচ্ছে, ছোট এক অংশে ভিয়েতনামে মার্কিন বোমা হামলাকারীদের কিছু নিদর্শনও আছে। কোথায় বন্দিদের আটকে রাখা হতো, গিলোটিনে কীভাবে শিরশ্ছেদ করা হতো, নির্জন কারাবাসে কীভাবে দিনের পর দিন রেখে দেওয়া হতো এসব যেমন দেখাচ্ছে; তেমনি আছে বীরত্বের কথাও।

ওই কারাগারের সুয়ারেজ লাইন দিয়ে বেশ কয়েকবার বিপ্লবীরা দল বেঁধে পালিয়েছিল। জাদুঘরের একেবারে শেষদিকে রয়েছে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি বেশ বড় খোলামেলা জায়গা। ভিয়েতনামিরা আগরবাতি বা ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করছে, হালকা সুর চারদিক আবিষ্ট করে রেখেছে, একপাশে কারাগারের বড় এক দেয়ালে ভিয়েতনামি ভাষায় লেখা রয়েছে, ফাঁসিতে ঝোলা বিপ্লবীদের শেষ কথা, মৃত্যুর আগে সাথীদের শেষবারের মতো যা বলে গিয়েছিলে- ‘কমরেড, আসি তাহলে। ভালো থেকো, (ভিয়েতনামকে) ভালো রেখো’। ভিয়েতনামের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই এ মন্ত্র মস্তিষ্কে গেঁথে নিচ্ছে।

মনটা ভরে যাচ্ছে, আর নিজের দেশের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের স্মৃতিস্তম্ভগুলো কতইনা অনাদরে পড়ে আছে! অথচ প্রত্যেকটিকে কেন্দ্র করে কী না করা যেত, শিশু-কিশোর আর তাদের বাবা-মাদের সাপ্তাহিক গন্তব্যে পরিণত করা যেত!

কোথাও ঘুরতে গেলে এই জ্বালা, খালি তুলনা এসে পড়ে। হোটেলে ফিরতে ফিরতেই বুঝছিলাম, ভাইব জিনিসটা কেমন। শনিবার মানে উইকএন্ডের রাত। হ্যানয়ে এ রাত উৎসবের। বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় তরুণ-তরুণীরা জড়ো হচ্ছে, মিউজিক বাজছে। অসংখ্য সড়ক বন্ধ, সেখানে উইকএন্ডের বাজার বসবে, তাতে নানা কিছু বিক্রিবাট্টা হবে। ট্যুরিস্টরা পিল পিল করে নেমে আসছে। রাস্তাজুড়ে হাজারো স্কুটার ছুটছে, মানুষ আর মানুষ। এ রাত লম্বা হবে, স্ট্রিটফুডের দোকানগুলো দেরিতে বন্ধ হবে। পরদিন সকালে প্রায় সবার দিন শুরু হবে অন্যদিনের চেয়ে খানিকটা পরে।

সেই সুযোগ নিয়ে আমরা রোববার সকালে এক ঝটকায় হ্যানয়কে বিদায় জানাতে জানাতে চলে গেলাম বিমানবন্দরে। অল্প কদিনে কী আর মন ভরে! বিমানভাড়া বাদ দিলে ভিয়েতনামে থাকা-খাওয়া আমাদের মতোই, কোথাও কোথাও আরও সস্তা। আবার যেতে হবে। দানাং, হো চি মিন সিটি, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম গুহা যে দেখতেই পেলাম না!  

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!