প্রয়াত শিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী ল্যাম্পশেডে প্রথম পটচিত্র আঁকা শুরু করেন।
Published : 29 Oct 2024, 06:23 PM
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই যদি এক তীব্র আলো আপনার চোখে বিরক্তির ছাপ তোলে, কিংবা অন্ধকার যদি ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে আপনার বাস্তুর সঙ্গে একটি শৈল্পিক বস্তুকে সংযোজন না করলেই নয়। একজন রুচিশীল মানুষের সেই প্রয়োজনীয় বস্তুর নাম ল্যাম্পশেড।
অন্দরসজ্জায় শৌখিন ছোঁয়া থেকে শুরু করে স্নিগ্ধময় আবহে ঘর পরিপূর্ণ করে তুলতে ল্যাম্পশেডের জুড়ি মেলা ভার। চাহিদা আর রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ল্যাম্পশেডের বাহারি কায়দার রূপ বেড়ে চলছে।
নান্দনিক এই ল্যাম্পশেডের কাঠামো তৈরির যারা কারিগর রয়েছেন তাদের থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমল থেকে আজ অবধি তারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সময়ের বিবর্তনে ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে তারা বহু ধরনের ল্যাম্পশেডের আকৃতি, মাধ্যম ও কাঠামোর পরিবর্তন এনেছেন।
তাছাড়া ল্যাম্পশেড কাঠামোর উপর মার্কিন কাপড় থেকে শুরু করে খাদি, প্রিন্ট, হাতের কাজ, সুতোর কাজ ইত্যাদি দিয়ে কারুশিল্পীরা ইতোমধ্যে কাজ করেছেন। নব্বই দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের প্রয়াত পটচিত্রশিল্পী রঘুনাথ চক্রবর্তী ল্যাম্পশেডে প্রথম পটচিত্র আঁকা শুরু করেন। তারপর থেকে আমাদের দেশের লোকশিল্প, কারুশিল্প ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে যেসব ল্যাম্পশেড তৈরি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে নজর কেড়েছে পটচিত্রের এই ল্যাম্পশেড।
সময়ের আবর্তে এই চাহিদা শৌখিন মানুষদের মধ্যে দিনকে দিন বেড়ে চললেও এই পটচিত্রের ল্যাম্পশেড বর্তমানে বিলীন হওয়ার পথে। কেননা এমন নান্দনিক ঘরানার ল্যাম্পশেডের মধ্যে পটচিত্র নকশা তৈরির শিল্পী কই! যেখানে বহির্বিশ্বে সবাই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিল্পকে বাঁচাতে সার্বক্ষণিক উদ্বুদ্ধ, সেখানে আমাদের শিল্প বাঁচাতে আমরা যেন কাঠের চশমা পরতে ব্যস্ত।
বেশি দূরে নয়, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে স্কুলপড়ুয়া শিশুরা মানসম্পন্ন বাণিজ্যিক কারুশিল্প তৈরির মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক খাতে অবদান রাখছে, সেখানে আমাদের দেশে শিশু-কিশোররা এখনো কারুশিল্পকে শিশুসুলভ পুস্তকের পাতার অক্ষরে বন্দি রেখেছে। অন্য দেশের মত ওদের সক্ষমতার কোন ঘাটতি থাকত না, যদি ওরাও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষক পেত।
সুচিন্তার এমন ধাপ থেকেই গত ৯ অক্টোবর ‘আঁধারের বাতিতে স্নিগ্ধময় আলো, দূর হোক গৃহকোণের যত সব কালো’ এমন স্লোগানকে সামনে রেখে ‘মনসিজ আর্ট একাডেমি’ ও ‘মনসিজ ক্র্যাফট’ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিনব্যাপী ল্যাম্পশেড পেইন্টিং কর্মশালার আয়োজন করে।
এ আয়োজনে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলাম আমি ও চিত্রশিল্পী মো. শামিম হোসাইন। কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হলো শিশু-কিশোরদের মধ্যে আমাদের লোকসংস্কৃতির পূর্ণ ধারণা ফিরিয়ে আনা, হাতে-কলমে দেশীয় সংস্কৃতির বাণিজ্যিক কারুপণ্য তৈরি, মাধ্যমিকে পুথিগত বিদ্যার বাইরে অর্থাৎ শিশুসুলভ কারুশিল্প তৈরি থেকে বেরিয়ে রপ্তানিযোগ্য আদর্শ কারুপণ্য তৈরিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা।
বড় হয়ে এই শিশুরাই যখন একেকজন উদ্যোক্তা হবে, তখন তারাই চাকরির লম্বা লাইনে ভিড় না করে দেশের কারুশিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমাদের আশা, যা দেশের অর্থনৈতিক খাতে অবদান রাখবে।
আরেক প্রশিক্ষক শামিম হোসাইন বলেন, “এক যুগের বেশি ধরে দেশীয় বিভিন্ন কারুশিল্প ভিত্তিক কর্মশালাগুলোতে আমি প্রশিক্ষক হিসেবে থাকলেও ল্যাম্পশেড পেইন্টিং নিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রথম কোন কর্মশালা। খুদে শিল্পীরা মাত্র একদিনের কর্মশালায় দক্ষতার মানের জায়গা থেকে এমন চমৎকার কাজ যদি করতে পারে, তাহলে এমন আরও কর্মশালার সুযোগ পেলে তারা না জানি কতটা পারদর্শী হয়ে উঠবে!”
উপস্থিত প্রশিক্ষণার্থীরা জানান, আসলে স্কুলে এমন সৃজনশীল কাজ শেখার কোন বই কিংবা প্রশিক্ষক আমাদের নেই। যদি এমন আরও কর্মশালার আয়োজন করা হয়, সেটা আমাদের জন্য খুব ভালো হবে। বিষয়টি আসলে সরাসরি হাতে-কলমে না শিখলে আদর্শভাবে তৈরি করা সম্ভব নয়।
মাধ্যমিকে সৃজনশীল শিক্ষায় যে আঁধার এখনো রয়েছে, তা খুদে শিল্পীদের স্নিগ্ধময় চেষ্টার দ্যুতিতে একদিন ঠিক দূরীভূত হবে, এই প্রত্যাশা আমাদের।