Published : 04 Aug 2023, 01:25 PM
প্রচণ্ড শীত থাকায় সন্ধ্যার পরপরই নিরিবিলি হয়ে যায় শ্রীমঙ্গল অঞ্চলের গ্রাম এলাকা। শীত আর ঘন কুয়াশায় সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এই নিরবতার সুযোগটাই নেয় মাছ চোরদের সংঘবদ্ধ দল। ছোট ছোট ডিঙ্গি আর কারেন্ট জাল নিয়ে ওরা মাছ চুরিতে নেমে পড়ে। প্রতিদিনের মতো আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাইক্কা বিল পর্যটনকেন্দ্রের যে কজন লোক তারাও সন্ধ্যার পরই দরোজায় খিল দিয়েছে। ফলে চোরদের পোয়াবারো।
রাত দশটার পর থেকেই চোরদের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। জাল পাতার পরপরই নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। বাইক্কা বিলের গভীর অংশটাতেই এখন পানি আছে। সারা বিলের মাছ এ সময়টায় গভীর অংশে চলে আসে। ফলে খুব অল্প সময়ে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। অন্যদিকে কারেন্ট জাল হওয়ায় ছোট-বড় সব মাছ জালে আটকা পড়ে।
গিট্টু, তিড়িং, বিড়িং ও মিট্টু প্ল্যান মোতাবেক অদৃশ্য হয়ে প্রথম নৌকায় উপস্থিত হয়। তারপর চারজন একসাথে নাকি সুরে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়।
আঁমরাঁ এঁসে গেঁছি চাঁচাগঁণ…
চমকে ওঠে নৌকার লোকজন। কে কথা বলে? কে তোমরা?
চারজন একসাথে অট্টহাসি দেয়। বাইক্কা বিলের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সে হাসি।
চিঁনতে পাঁরলি নাঁ তোঁ? চিঁনবি যঁখন ঘাঁড় মঁটকে রঁক্ত খেঁতে শুঁরু কঁরবো তঁখন।
ভীষণ ভয়ে জোরে জোরে সূরা পড়তে শুরু করে মাছ চোররা।
লাঁভ নাঁই। চুঁরি কঁরা যেঁ খাঁরাপ সেঁটা জেঁনেও দিঁনের পঁর দিঁন এইঁ কাঁজ কঁরে যাঁচ্ছিস। শোঁন নৌঁকা থেঁকে নঁড়তে চেঁষ্টা কঁরবি না। যেঁখানে আঁছিস সেঁখানেই থাঁকবি। পাঁলাতে চাঁইলে ঘাঁড় মটঁকাবো। হাঁ হাঁ হাঁ.....!
মোট চার নৌকায় এই বাণী পৌঁছে দেয় গিট্টুরা। তারপর তিন নৌকায় তিনজনকে পাহারায় রেখে চান্দুমামার সাথে দেখা করতে যায় গিট্টু।
চান্দুমামা বেশ রাত জেগে বই পড়েন। সারা বাড়ি তো অবশ্যই, সারা গ্রাম ঘুমে অচেতন। অদৃশ্য হয়েই চান্দুমামার রুমে ঢোকে গিট্টু।
মামা
কে? গিট্টু? তা এতো রাতে তুই? বইয়ে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করেন মামা।
বই রেখে আমার দিকে তাকান তো মামা। বিষয়টা জরুরি। অনিচ্ছা থাকলেও গিট্টুর দিকে তাকান মামা।
বল!
আমি বাইক্কা বিল থেকে এলাম মামা। চারটা নৌকায় প্রায় বিশজন লোক। ভয় দেখিয়ে এসেছি। সারারাত নড়বে না। এখন পুলিশ দরকার।
এতো রাতে? শীতের মধ্যে?
এই সুযোগটা কাজে লাগাতে না পারলে সারা জীবনেও বাইক্কা বিলের মাছ চুরি বন্ধ করা যাবে না মামা।
ঠিক বলেছিস। দেখি কী করা যায়!
অবিনাশ মামাকে ফোন করেন মামা। প্রশাসনের সব মহলের সাথেই ভালো সম্পর্ক অবিনাশ মামার। চান্দুমামা সিচুয়েশনটা অবিনাশ মামাকে বুঝিয়ে বলেন। দুজনের কথা থেকে বোঝা যায় অবিনাশ মামা একটা ব্যবস্থা করছেন।
এক জনও নড়বি না।
জেলে নৌকার অনেকেই অজ্ঞান। নড়াচড়া নেই বললেই চলে। ভূতের গল্প শুনেছে সবাই। কিন্তু আজ যে জ্যান্ত ভূতের খপ্পরে পড়বে মাছ চোরেরা এটা কখনও ভাবেনি। রাত প্রায় চারটার দিকে শ্রীমঙ্গল এবং মৌলভীবাজার থানার কয়েকটা জিপ এসে বাইক্কা বিলে থামে। টর্চের আলোয় আলোকিত হয়ে যায় এলাকা। ঘন কুয়াশার মধ্যেও চারটা নৌকা এবং আঠারোজন মাছ চোরকে ঘেরাও করে পুলিশ।
পুলিশের হুইসেল শুনে হাওরপাড়ের গ্রামবাসীরাও টর্চ, মোবাইল টর্চ, লাঠি, বর্শা নিয়ে এগিয়ে আসে। পুলিশ এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নৌকা, জাল এবং মাছ চোরদের আটক করে শ্রীমঙ্গল থানায় নিয়ে আসা হয়। সকালে চান্দুমামাসহ অবিনাশ মামা থানায় পৌঁছান।
জেলেরা ভূতের কথা বলাবলি করলেও চান্দুমামা এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকা পালন করেন। চোরদের হালকা পিটুনি দিতেই শ্রীমঙ্গলের মৎস্য সিন্ডিকেটের সদস্যদের নামও ফাঁস হয়ে যায়। কয়েকজন পালিয়ে গেলেও অধিকাংশই ধরা পড়ে। পুলিশের সাফল্যের খবর স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বড় অক্ষরে ছাপা হতে থাকে। থানা এবং জেলা সংবাদদাতারা রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত। টিভি সাংবাদিকরা নিয়মিত ফুটেজ পাঠাচ্ছেন নিজেদের চ্যানেলে। পর্যটন শহর শ্রীমঙ্গলের এই ঘটনা সারাদেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।
চান্দুমামার ছুটি শেষ। আজ রাতের উপবনে এক্সপ্রেসে ঢাকা ফিরবেন সবাইকে নিয়ে। সকালে পদ্মপুকুরপাড় ঘেঁষে হাঁটার সময় গিট্টু সঙ্গ দেয় চান্দুমামাকে।
ধন্যবাদ দিয়ে তোকে ছোট করবো না গিট্টু। শুধু শ্রীমঙ্গল নয়, সারা দেশের একটা বড় উপকার করলি তুই। মৎস্যসম্পদ তোর কারণে নিরাপদ হলো। তোর টিমের সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাস।
মামা, কী আর উপকার করলাম! আপনার মনে যে একটু শান্তি এলো এতেই আমি খুশি। আপনি শ্রীমঙ্গলকে খুব ভালোবাসেন, তাই না মামা?
আমার জন্মস্থান রে! এর জল হাওয়ায় বড় হয়েছি আমি। এই ঋণ তো কোনদিন শোধ করা যায় না।
ভালো করে ভয় দেখিয়েছি মামা। আর কোনদিন মাছ চুরি করতে বিল হাওরে নামবে বলে মনে হয় না।
তো তোর টিমমেটরা কই রে?
ওদের বিদায় দিয়েছি মামা। আমরা তো রাতেই যাচ্ছি?
হ্যাঁ। রাত বারোটায় ট্রেন।
ওকে মামা। আমি একটু ঘুরে দেখি শ্রীমঙ্গল।
ঠিক আছে। রাতে স্টেশনে চলে আসিস।
আচ্ছা মামা।
বাড়ি ফেরার পথে চান্দুমামার সাথে অবিনাশ মামার দেখা হয়ে যায়। চান্দুমামার সাথে দেখা করতেই যাচ্ছিলেন অবিনাশ মামা। ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা শুরু হয় দুজনের। নানা বিষয়ের পর বাইক্কা বিল প্রসঙ্গ চলে আসে।
আচ্ছা একটা কথা আমাকে বল। বিলে মাছ চোররা নেমেছে এ খবরটা তুই পেলি কীভাবে?
সিক্রেট! হা হা করে হেসে ওঠেন চান্দুমামা। অবিনাশ মামাও যোগ দেন সে হাসিতে।
না রে সিক্রেট এটাই! আমার ধারণা ছিলো শীত আর কুয়াশার সুযোগ নেবে ওরা। তাছাড়া কাল দিনের বেলা আমি বাইক্কা বিলের আশপাশে খোঁজ নিয়ে জেনেছি মাছ চোররা প্রতিদিনই বিলে নামছে। সেই ধারণা আর একটা গোপন সংবাদ, এই তো!
বিরাট একটা কাজ হলো চান্দু। দীর্ঘদিন ধরে ধরা যাচ্ছিল না। তুই তো হিরো হয়ে গেলি। কাঠচোরদের তুই-ই ধরে দিয়েছিলি। এখন লাউয়াছড়া অভয়ারণ্য কাঠচোর মুক্ত। এবার বাইক্কা বিলও আশা করি মাছচোর মুক্ত হবে।
না রে! হিরো হওয়ার বিষয় না। জনমানুষের সম্পদ কিছু অসৎ মানুষের হাতে চলে যাবে। সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে দীর্ঘ ক্ষতি হবে দেশের প্রকৃতির, এটা ভাবতে পারি না আমি।
চা চলে আসে। শ্রীমঙ্গলের ক্লোন চায়ের মিষ্টি গন্ধে ভরে ওঠে ড্রয়িংরুমের বাতাস। দুজনে চায়ে চুমুক দেন। চান্দুমামা মনে মনে গিট্টুকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ গিট্টু। কেউ না জানলেও আমি তো জানি, বাইক্কা বিল কাণ্ডের মূল হিরো তুই। ভাল থাকিস।