হঠাৎ করেই যেন অনেক জোনাকি আর তাদের ধারে কাছে নেই। দু’একটা যেগুলো আছে সেগুলোও একটা একটা করে টুপটাপ নিভে যাচ্ছে।
Published : 08 Apr 2025, 07:09 PM
চার কিশোরের এখন আসলে আর নিজেদের করার মতো তেমন কিছুই নেই। এখন কিছু করতে গেলে আরও বিপদের সম্ভাবনা। গহনবনের জমাট অন্ধকারের কোথায় কোন বিপদ ওত পেতে বসে আছে, তা তাদের অনুমানেরও বাইরে। তাই কিছু না করে এখন চুপচাপ বসে থাকাই বরং ভালো। অন্যের সাহায্য ছাড়া এখান থেকে বের হওয়ার বা নিজে নিজে কিছু করার সময় তারা অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছে।
কিন্তু এই কিশোররা কি আর চুপচাপ বসে থাকার বয়সে আছে! অজানাকে জানার ইচ্ছে যাদের অন্তরে, ভয়কে জয় করার দুরন্ত সাহস যাদের মনে, তাদের দমিয়ে রাখে এমন সাধ্য কার! পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যে ম্যানগ্রোভ বন তার বুকের সুবিশাল সব বৃক্ষ দিয়ে আম্পান, আইলা ও সিডরের মতো বড় বড় প্রলয়ঙ্করী ঝড় আটকে দিয়েছে, সে সুন্দরবন মোবাইলের নেটওয়ার্ককেও বাধাগ্রস্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। এবং সে তাই করে। জিসান ও আদনানের মোবাইলের নেটওয়ার্ক গহনবনে বাধাগ্রস্ত হয়ে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে। আর এলেও সে নেটওয়ার্ক সিগন্যাল থাকে খুব দুর্বল, ডায়াল করার পরই আর থাকে না।
কিন্তু অদম্য কৈশোর এত সহজে দমে যাওয়ার বা হেরে যাওয়ার তো নয়। জিসান ও আদনান গাছ থেকে নেমে আসে। চারজন মিলে আবার পরামর্শ করতে বসে। এখান থেকে বনের বাইরে যাওয়ার বিভিন্ন উপায় বের করার পাশাপাশি কী কী করতে হবে এবং কী কী করা যাবে না, সেগুলোর একটা তালিকা করতে শুরু করে। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা তাদের ভাবতে শেখায়। হেরে যাওয়ার আশঙ্কা তাদের উদ্যমী ও জেদি করে। প্রাণের ভয় তাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে।
মোবাইলের আলোতে ব্যাগ থেকে খাতা-কলম বের করে সবার মতামতের ভিত্তিতে তারা কিছু সিদ্ধান্ত নোট করে-
যা করতে হবে:
১. বাড়িতে পুনরায় জানানোর চেষ্টা করতে হবে,
২. সবাই মিলে বনের বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা খুঁজতে হবে এবং
৩. সবাইকে একসাথে থাকতে হবে।
যা করা যাবে না:
১. কারও আলাদা হওয়া যাবে না,
২. খাবার পানি নষ্ট করা যাবে না,
৩. যে অল্পকিছু খাবার আছে, সেগুলো শেষ করা যাবে না এবং
৪. মোবাইলের চার্জ অযথা শেষ করা যাবে না।
সিদ্ধান্তগুলো লিখে নিয়ে সবাই সেগুলো মনে রাখে, মেনে চলারও চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়িতে জানানোর চেষ্টা করতে হলে গাছে উঠতে হয়। আবার গাছে উঠে বাড়িতে জানানোর চেষ্টা করলে পথ খোঁজা বন্ধ রাখতে হয়। এতে এক গোলমেলে অবস্থার মধ্যে পড়ে তারা। কিছুক্ষণ হাঁটে, পথ খোঁজে। তারপর থেমে গাছে উঠে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খোঁজে। কিন্তু ঘন গভীর বনে চার কিশোর কিছুই খুঁজে পায় না। বিপদসংকুল সময় ধীর গতিতে চার কিশোরের বিষণ্ন মনের পাড় ধরে গড়িয়ে যায়।
ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকার ঢেকে দেয় সামনে-পেছনে পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ বন। তাদের রোমাঞ্চিত মনের চরাচরে বয়ে যেতে থাকে প্রবল ঝড়-বাদল। কিন্তু তাতে বনের স্বাভাবিক নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয় না। সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারও সেখানে এক অবাক বিস্ময় হয়ে দেখা দেয়। গহনবনে পথহারা দিকভ্রান্ত চার কিশোর হঠাৎ খেয়াল করে— তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে হাজার লক্ষ জোনাকি পোকা। মিটিমিটি জ্বলে-নেভে অন্ধকার বনে জোনাকিরা এক নির্মল ও মনোরম আলোকসজ্জা রচনা করেছে। সে সজ্জা এক অভিনব অপার বিস্ময় হয়ে ইমরান ও তার বন্ধুদের চোখে ধরা দেয়।
বেশি অবাক হয় আদনান ও জিসান। শহুরে জীবনে জোনাকি পোকার দেখা ওরা কখনোই পায় না। যদি কেউ দেখতে পায় সেটা হয়ে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। জীবনে যে অল্প কয়েকবার ওরা জোনাকি দেখেছে সেগুলো গ্রামে বেড়াতে এসেই দেখেছে। কিন্তু এতবেশি জোনাকি পোকা একসাথে ওরা কেউই কখনো দেখেনি। ইমরান ও মিঠু গ্রামে থাকলেও পুকুরপাড়ে বা বাড়ির আশপাশের জঙ্গলে এত জোনাকি দেখেনি। তাই চারজনই অপার বিস্ময় নিয়ে জোনাকির আলোকসজ্জা দেখতে দেখতে ঘোরগ্রস্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য পথ খোঁজার কথা ভুলে যায়। হয়তো তারা পথ হারানোর কথাও আর মনে রাখতে পারে না।
সবাই স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের মাথার ওপর ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির। মাটির কাছাকাছি কোথাও থেকে ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। আর এই দুইয়ের মাঝামাঝি হওয়ায় ভাসছে মিটিমিটি জ্বলা জোনাকির একরঙা আলোকসজ্জা। কিন্তু এমন সুন্দর মুহূর্তটিতে জিসান বাগড়া দেয়। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে মাথার ওপর মেঘেদের গুরু-গম্ভীর সাংঘর্ষিক শব্দ হতেই জিসান আর্তচিৎকার করে পাশে থাকা ইমরানকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বাকি সবাই মিলে তাকে অনেকক্ষণ ধরে শান্ত করে।
কিন্তু ততক্ষণে একটা দুটো করে জোনাক পোকার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। চার বন্ধুর অলক্ষ্যে মেঘের ঘনঘটায় জোনাকি পোকারাও একে একে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে শুরু করে। জিসানকে শান্ত করে তাকাতেই দেখতে পায় তাদেরকে এতক্ষণ ঘিরে থাকা আলোকসজ্জাটি প্রায় হারিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন অনেক অনেক জোনাকি আর তাদের ধারে কাছে নেই। দু’একটা যেগুলো আছে সেগুলোও একটা একটা করে টুপটাপ নিভে যাচ্ছে। চার বন্ধুর মনটা আরও একবারের জন্য খারাপ হয়ে যায়। যখন-তখন বৃষ্টি নামার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বাড়িতে জানানোর চেষ্টা করে করে তারা যখন ক্লান্ত প্রায়, কারো সাহায্য পাওয়ার সব রকম আশা-ভরসা জোনাকি পোকাগুলোর মতো নিভে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আদনানের মনে আন্দোলন করে কথাটা। তারপর সবাইকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে নিজেই এবার গাছে ওঠে। জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরটি ডায়াল করতে থাকে।
ইমরানের শিশির মামা তার দুজন বন্ধু নিয়ে যখন শরণখোলা থানায় পৌঁছেছেন, গ্রামের বিবেচনায় রাতের তখন প্রথমভাগ। এশার নামাজের আজান হয়ে গেছে আরও অনেকক্ষণ আগে। ঈদের রাত বলে তখনও কিছু মানুষ এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছে। রাস্তার পাশের চায়ের স্টলগুলোতে লোকজনের গল্প-আড্ডা জমজমাট। বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে বলে শরণখোলা থানা এলাকা তখনও নিরিবিলি। থানার আশপাশে কোনো দোকানপাট ও বাড়িঘর নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে কয়টা বাড়িঘর আছে, তাদেরকে নিকটে বলা যায় না কিছুতেই।
তবে ঈদের এমন আলস্য মোড়া রাতেও শরণখোলা থানার ডিউটি অফিসার মহাব্যস্ত ও চিন্তিত। কীভাবে কী করবেন, কোত্থেকে শুরু করবেন, কেমন করে শুরু করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। ঈদের দিন ছিল বলে শরণখোলা থানার ওসি সাহেব আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় চলে গিয়েছিলেন। তাকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি আসছেন— রাস্তায় আছেন।
এই মুহূর্তে থানায় আছেন মাত্র হাতেগোনা পাঁচজন কনস্টেবল। ডিউটি অফিসারের হাঁকডাকে তারাও ছুটছেন দিগ্বিদিক। অন্য কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই কারও। আসার পর থেকে শিশির মামাকে তারা কেউ পাত্তাই দিচ্ছেন না বলা যায়। অবশ্য কনস্টেবল একজন একবার এসে জিজ্ঞেস করায় তার সাথে নিচের কথাগুলো হয়েছিল।
কী সমস্যা ভাই? কার কাছে এসেছেন?
বিরাট একটা সমস্যা হয়েছে ভাই। ওসি সাব আছেন? উনার সাথে একটু দেখা করা জরুরি।
স্যার তো ডিউটি শেষ করে বাসায় চলে গেছেন। তবে উনি আসছেন, বসুন তাহলে।
আমার তো বসে থাকলে চলবে না ভাই। মহাবিপদে আছি। ওসি সাব না থাকলে একটু ডিউটি অফিসারের সাথেই কথা বলা জরুরি।
আরে ভাই! উনি নিজেই আছেন বেশ চাপে। আচ্ছা বসুন, দেখি কী করা যায়।
চলবে...