বিশ্ব বদলে দেওয়া যত ডাচ আবিষ্কার
তানবীরা হোসেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 30 Nov 2021 05:00 PM BdST Updated: 30 Nov 2021 05:00 PM BdST
বিশ্ব মানচিত্রে বলতে গেলে যার অবস্থান খুঁজে পাওয়া দুস্কর, মাত্র ৪২ হাজার ৬৭৯ বর্গকিলোমিটারের দেশ নেদারল্যান্ডস, জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ। কিন্তু তাদের আবিষ্কারের ইতিহাস বিশাল।
কথায় বলে, ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য আর্থ, বাট দ্য ডাচ ক্রিয়েটেড দ্য নেদারল্যান্ডস’, সমুদ্র থেকে বাঁধ দিয়ে দেশকে রক্ষা করা, সমুদ্রের লোনাপানি বাঁধের ভেতরে এসে মিঠা পানিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার গল্পতো এখন পুরনো। বাঁধের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ বহু দেশ অনেক উপকৃত হয়েছে এবং এখনও এ নিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু তাদের কিছু কিছু আবিষ্কার বিশ্ববাসীর জীবনকে কতভাবে বদলে দিয়েছে আজ সে গল্পটি লিখবো।
ওয়াইফাই
১৯৯০ সালে নেটওয়ার্ক বিজ্ঞানী ভিক্টর হেইস ও কেইস লিঙ্কস প্রথমে ওয়েভল্যানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন যা পরে নিউখেইনে এসে ওয়াইফাইয়ে রূপান্তর হয়। বিজ্ঞানী ভিক্টর হেইসকে ‘ফাদার অব ওয়াইফাই’ উপাধি দেওয়া হয় আর কেইস লিঙ্ককে বলা হয় ‘ইন্টারনেটের অগ্রদূত’। হাই ফিডেলিটি আর ওয়ারল্যাস শব্দ দুটো থেকে ‘ওয়াইফাই’ নামটির উৎপত্তি। ১৯৯৯ সালের অগাস্টে প্রথম ওয়াইফাই নামটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সম্ভবত আমার এ লেখাটা আপনি এখন ওয়াইফাই-এর সাহায্যেই পড়ছেন!
ব্লুটুথ
ডাচ প্রকৌশলী ইয়াপ হার্টসেন ১৯৯০ সালে ডিভাইসের মধ্যে ওয়্যারলেস সংযোগের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। তখন তিনি সুইডিশ টেলিকমুউনিকেশান কোম্পানি 'এরিকসনে' কাজ করতেন। ১৯৯০ সালে ইয়াপ হার্টসেন ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস কর্তৃক ইউরোপীয় আবিষ্কারক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। ‘ব্লুটুথ’ নামটি ড্যানিশ রাজা হ্যারাল্ড ব্লোট্যান্ডের উপনামের একটি ইংরেজি ভাষান্তর। ইয়াপ হার্টসেন সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন, সাইকেলে চড়তেন, বলতেন, ‘খুব প্রিয় আর খ্যাত হয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে চাই না’।
স্লট ডিজিটাল কোডিং সিস্টেম
খ্রোনিংখেনে জন্ম নেওয়া ডাচ ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার রোমকে ইয়ান বের্নহার্ড স্লট ১৯৯৫ সালে একটি ডেটা শেয়ারিং টেকনিক আবিষ্কার করেন যা দিয়ে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল মুভি ফাইলকে ৫১২ কিলোবাইটে রূপান্তর করে সংরক্ষণ করা যেতো। ইয়ান স্লট যখন তার আবিষ্কারকে জনসম্মুখে নিয়ে আসার জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজে পেয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করবেন বলে সব ঠিক হয়েছে ঠিক তার একদিন আগে ১১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। সম্পূর্ণ সোর্স কোডটি পুনরুদ্ধার করা হয়নি, প্রযুক্তি ও দাবিটিও আর পুনরুৎপাদন কিংবা যাচাই বা পরীক্ষা করা হয়নি।
ক্যাসেট-সিডি-লেজার ডিস্ক-ডিভিডি
শুধু মিউজিক সিস্টেম বানিয়ে 'ফিলিপ্স' হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, মিউজিক সিস্টেম ব্যবহার করার জন্য যা যা জিনিস প্রয়োজন তাও বানিয়েছে ফিলিপ্স। লু ওটেন্স আর তার টিমের দ্বারা ১৯৬৩ সালে বেলজিয়ামের হ্যাসেল্টে শুরু হয়েছিলো ক্যাসেট উৎপাদন। ১৯৮২ সালের অক্টোবরে ফিলিপ্স প্রথম অডিও সিডি রিলিজ করে।
ভিসিআর চালু হওয়ার দুই বছর পর, ১৯৭৮ সালে ১১ ডিসেম্বর জর্জিয়ার আটলান্টা বাজারে লেজারডিস্ক প্রথম পাওয়া যায়। সিডির উন্নত বিবর্তিত প্রক্রিয়া হলো ডিভিডি। এটা আসলে কোনো একক ব্যক্তির অবদান নয়, বরং অনেক মানুষ এবং কোম্পানির অবদান।
দ্য আই টেস্ট
যারা চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছি চোখ পরীক্ষার জন্য, ছোট অক্ষর বড় অক্ষর সব পড়তে হয়েছে। আর এভাবে চোখ পরীক্ষার এ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছেন ডাচ চক্ষু বিশেষজ্ঞ হ্যারমান স্ন্যালেন। ১৮৬২ সালে ভিজ্যুয়াল একুইটি নির্ধারণ করার জন্য যে চার্টটি তিনি প্রণয়ন করেন তাকে 'স্ন্যালেন চার্ট' বলা হয়, যা খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং চোখ পরীক্ষার সাবর্জনীন মানদণ্ডে পরিণত হয়।
গাজরের রঙ কেন কমলা
এর সাথে কি নেদারল্যান্ডসের রাজ পরিবার যাদের 'হাউজ অব অরানিয়া' কিংবা 'কমলা বাড়ি' বলা হয় তাদের কোন যোগাযোগ আছে?
চিরকালই কি গাজর কমলা রঙের ছিলো? জবাব হলো, না। গাজর আসলে কমলা রঙের ছিলো না। কথিত আছে, ১৭০০ সালের দিকে যখন ডাচল্যান্ড স্প্যানিশ কলোনি ছিলো তখন কমলা রাজপুত্র উইলিয়াম ফ্রেডেরিক, যে কিনা নেদারল্যান্ডসকে উদ্ধার করে সংগঠিত করার জন্য এবং সে ডাচ বিদ্রোহের নায়কও ছিলো, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ডাচ কৃষকরা সাদা, বেগুনি গাজরের পরিবর্তে কমলা গাজরের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করে।
কমলা গাজরের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ পৃথিবীব্যাপী দারুণ সমাদৃত হয় এবং ডাচ রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এর ব্যাপক চাষাবাদ শুরু হয়। যদিও জনপ্রিয় এ গল্পটি জেনেটিসিস্টদের দ্বারা মূলত বাতিল হয়ে গেছে। গবেষকরা প্রথমবারের মতো গাজরের জিনোম সম্পূর্ণরূপে ম্যাপ করে দেখেন যে, মিউটেশনের ফলে রোমান সাম্রাজ্যের দিনগুলোতে কমলা গাজর প্রথম দেখা দেয়।
সাবমেরিন
ডাচ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী কর্নেলিস ইয়াকোবসজন ড্রেবল ১৬২০ সালে পানির নিচে চলার উপযোগী ও কার্যকারী সাবমেরিন প্রথম ডিজাইন করেছিলেন। তিনি তখন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে কাজ করতেন, তিনি চামড়া ঢাকা কাঠের ফ্রেমের চলাচলযোগ্য সাবমেরিন তৈরি করেছিলেন। এর প্রথম পরীক্ষামূলক ভ্রমণ টেমস নদীতে হয়েছিলো।
১৬২০ থেকে ১৬২৪ এর মধ্যে ড্রেবেল আরও দুটি সাবমেরিন সফলভাবে তৈরি ও পরীক্ষা করেন, প্রতিটি আগেরটির চেয়ে বড়। চূড়ান্ত (তৃতীয়) মডেলটিতে ছয়টি ওয়ার ছিল এবং ষোলজন যাত্রী বহন করতে পারতো। সাবমেরিনটি তিন ঘণ্টার জন্য পানিতে নিমজ্জিত ছিল এবং ওয়েস্টমিনস্টার থেকে গ্রিনউইচ যেতে ও আসতে পারতো, বারো থেকে পনের ফুট (চার থেকে পাঁচ মিটার) গভীরতায় ভ্রমণ করতে পারতো।
দ্য স্টক মার্কেট
বিশ্বব্যাপী কিপ্টে হিসেবে বেনিয়া ডাচদের খানিকটা নাম আছে। এর মধ্যে প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলো 'গোয়িং ডাচ', মানে- একসঙ্গে সবাই খেতে গেলেও যার যার খরচ সে নিজে পরিশোধ করবে। এ কিপ্টে ডাচরাই স্টক মার্কেট চালু করে পৃথিবীসুদ্ধ বাণিজ্যের ধারণা পরিবর্তন করে দিলো।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীর্ঘ বাণিজ্য-ভিত্তিক সমুদ্রযাত্রার অর্থায়নের উপায় হিসেবে, ডাচ আইনপ্রণেতা ও ব্যবসায়ীরা ১৬০২ সালে প্রথম শেয়ার বাজার উদ্ভাবন করেছিলেন। সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেককে সমুদ্রযাত্রায় বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মূলধন বাড়াতে কোম্পানিটি স্টক বিক্রি করার এবং বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর ১৬১১ সালে, আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জ তৈরি করা হয়েছিল। বহু বছর ধরে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করা এক্সচেঞ্জে একমাত্র ব্যবসায়িক কার্যকলাপ ছিল। স্টক মার্কেটের ব্যাপক প্রসার ষোলশ দশকের নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল।
শুধু স্টক মার্কেট নয়, ১৯৮৮ সালে 'ফেয়ার ট্রেড লেবেল' বাজারে নিয়ে আসে দুইজন ডাচ। এ সার্টিফিকেট পাওয়া পণ্যগুলো বাইরের বাজারে সব ভোক্তাদের কাছে ন্যায্য দামে পৌঁছাতে পারে। এটি গ্রাহক ও উৎপাদক উভয়ের মাঝেই এ বিশ্বাস ও সাম্যতার প্রতীক।
দ্য অলিম্পিক ফ্লেইম
১৯২৮ সালে স্থপতি ইয়ান উইলস আমস্টারডামের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে কাজ করছিলেন। তিনি একটি লম্বা টাওয়ারের নকশা করেছিলেন যেটি থেকে ধোঁয়া বের হয়েছিল। উইলস আগুনের শিখার চেয়ে ধোঁয়ার প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন, কারণ এটি দিনের বেলা আরও দৃশ্যমান হবে। তারপর থেকে, আগুন অলিম্পিকের একটি ঐতিহ্যগত অংশ হয়ে ওঠে। যদিও ১৯৩৬ সালে বার্লিন গেমস পর্যন্ত ক্রীড়াবিদরা এ ফ্লেইমটি বহন করেননি।
ডাচ আবিষ্কারের মধ্যে আরও আছে মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ, ম্যান মেইড আইল্যান্ড, ফায়ার হোস ও স্পিড ক্যামেরা ইত্যাদি। পরিশ্রমী ও নিয়ম মানা ডাচ জাতি খুব বেড়াতে ভালবাসে। আড়ম্বরহীন স্বভাবের ডাচদের পৃথিবীর খুব কম কোণা আছে যেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সামান্য সুযোগ পেলেই পিঠে ব্যাকপ্যাক কিংবা ক্যারাভান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা।
২০১৮ সালে 'অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা' (ওইসিডি) প্রকাশিত উন্নততর জীবন সূচক ক্যাটাগরিতে নেদারল্যান্ডস 'ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্সে' বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকারী রাষ্ট্র। কাজের আর বিশ্রামের এরকম সমন্বয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |
সর্বাধিক পঠিত
- এ পি জে আবদুল কালামের ৩০টি অমিয় বাণী
- ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো
- বাবার বাঁধানো ছবির পাশে এসে দাঁড়াই
- শিশুর হঠাৎ জ্বর, ওমিক্রন হলেও দুশ্চিন্তা নেই
- জালাল উদ্দিন রুমির ৩০টি অমিয় পংক্তি
- বঙ্গবন্ধুর বাংলা জন্ম তারিখ কি আমরা জানি!
- শিশুর দেরিতে কথা বলা, কারণ ও করণীয়
- একটি ভূতের গল্প লেখার পরের ঘটনা
- শিশু খেতে চায় না, সত্যিই কি এটা কোন রোগ
- শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প: জীবনের বৃহৎ ইঙ্গিত