মৃত লাইব্রেরিয়ান

মানুষটিকে দেখে চমকে উঠি। আরে এ যে পুরোনো লাইব্রেরিয়ান কাকু, যার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে কিছুদিন আগে, তাও এই লাইব্রেরির মধ্যে!

হিমু চন্দ্র শীলহিমু চন্দ্র শীল
Published : 27 May 2021, 05:47 AM
Updated : 27 May 2021, 06:07 AM

এটাও কি আসলে সম্ভব! মানুষটির মৃত্যু হয়েছে গত চারদিন আগে, সে কিভাবে লাইব্রেরিতে বসে থাকতে পারে। তাকে দাহ করার সময় আমি নিজেও শ্মশানে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ না মানুষটির মৃতদেহ পুড়ে ছাই হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্মশানে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা।

না, এটা কোনো দিনও হতে পারে না। মৃত মানুষ আবার জীবিত হতে পারে নাকি। না না না, নিশ্চয় এটা আমার মনের ভ্রান্ত ধারণা। হয়তো পুরোনো লাইব্রেরিয়ানের মতো দেখতে ওই মানুষটির চেহারা। ভাবতে ভাবতে আমার গলা শুকিয়ে যায়। শিহরণ জাগে মনে। গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে।

এতক্ষণ ধরে লাইব্রেরিতে বসে বসে ‘মৃত মানুষের আত্মার জেগে উঠা’ নামে যে বইটি পড়ছিলাম ওই বইতে আর মন বসছে না। নিশ্চয় ওই বইটি পড়ে নিজের মনেই মৃত লাইব্রেরিয়ানকে কল্পনা করা শুরু করে দিয়েছি। যখনই লাইব্রেরিতে আসতাম, হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করতো কেমন আছি। কোনো বইটই বেশিদিন রাখলে কিছু বলতো না। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না লোকটি এভাবে চলে যাবে।

হয়তো ঘোরের মধ্যে লোকটির অবয়ব আঁকছি। চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম অত বড় পাবলিক লাইব্রেরিতে মানুষ আছি মাত্র তিনজন। অবশ্য আজ প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। এমনিতে কক্সবাজারের পাবলিক লাইব্রেরিতে মুষ্টিমেয় কিছু লোকছাড়া তেমন কেউ আসে না। তার মধ্যে আজ মুষলধারে বৃষ্টি। হাতের ঘড়িটায় চেয়ে দেখি বিকেল পাঁচটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

লাইব্রেরির জানালা দিয়ে বাইরে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ প্রকৃতি, নীরব মানুষের আনাগোনা। নতুন লাইব্রেরিয়ান কাকু বসে বসে ঝিমুচ্ছে। ঝুম ঝুম করে মুষলধারে বৃষ্টি একটানা ঝরে যাচ্ছে, যেন থামার কোনো নাম-গন্ধও নেই। ওই লোকটি লাইব্রেরির কোনায় বসে কি একটা যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে মাঝে-মধ্যে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখছে। ভাবছি কাছে গিয়ে একবার জিজ্ঞাসা করি লোকটি কে?

সাহস হয়ে উঠে না। মনে পড়তে লাগল, কোনো মৃত মানুষকে আচমকা কোথাও দেখলে কী করতে হয় তা, কিংবা মৃত মানুষের অবয়বের মতো কোনো কিছু দেখলে নীরবে ওই স্থান ত্যাগ করতে হয়, আরও কত কি! কিন্তু বাইরে যে প্রচণ্ড বৃষ্টি। আসার সময় ছাতাটাও সঙ্গে নিয়ে আসিনি। তখন আকাশ দেখে এতটুকুও মনে হয়নি বৃষ্টি নামবে। আচমকা বিদ্যুতও চলে গেল। একেবারে যাচ্ছে তাই! এই রকম ঠান্ডার মধ্যেও এবার আমার গা দিয়ে ঘাম বের হতে লাগল। কেন যে আজ লাইব্রেরিতে আসতে গেলাম। নির্ঘাত আজ বুঝি  আমার রক্ষে নেই!

চেয়ে দেখি লাইব্রেরিয়ান কাকু ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সাহস হয়ে উঠছে না ওনাকে গিয়ে ডেকে তোলার। কারণ ওনাকে ডাকতে হলে ওই লোকটিক যে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি পকেট হতে মোবাইলখানা বের করে ফ্লাশ লাইটটি অন করলাম। কমদামি মোবাইল হওয়াতে ফ্লাশ লাইটের আলোও বেশি দূর যাচ্ছে না। ফলে তেমন কিছুও দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টি কিন্তু অঘোরে ঝরে যাচ্ছে। লোকটি যে পাশে বসে আছে ওদিকটাই আলো ফেললাম। ওমা, উনি যে ওখানে নেই!

কোথায় গেল লোকটি? মনের মধ্যে সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হলো। উনি নিশ্চয় সত্যিকারের মৃত লাইব্রেরিয়ানের আত্মা। না হলে মিনিটের মধ্যে এভাবে কি কোনো লোক উধাও হয়ে যেতে পারে! পেছন থেকে জোরে জোরে একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হয়তো লাইব্রেরিয়ান কাকু ঘুমের মধ্যে ঘোর কাটছে। তবুও ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখার জন্য পেছনে ফিরলাম। আবছা আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মৃত লাইব্রেরিয়ান কাকু ঘাড় বাঁকা করে হাতে একটা বই নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, যে বইটা উনার মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি উনার কাছ থেকে নিয়ে গেছি।

কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল নিচে। মোবাইলটা নিচ থেকে নেওয়ার সাহস করলাম না আর। যদি লোকটা ঝাপটে চেপে ধরে, এই ভয়ে। জোরে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হায়! কণ্ঠ দিয়ে আওয়াজ যে বের হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখলাম কতগুলো মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি লাইব্রেরির মেঝেতে পড়ে আছি। নতুন লাইব্রেরিয়ান কাকু পানির বোতল হাতে পানি ছিটাচ্ছে আমার মুখে আর জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে, কী হয়েছে? আমি বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখছি লাইব্রেরির দেয়ালে পুরোনো লাইব্রেরিয়ানের ছবিসমেত একটা ব্যানার টাঙানো। আর ওখানটাতে লেখা আছে ‘আমাদের সবার প্রিয় হরিপদ লাইব্রেরিয়ানের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’

লেখক: শিক্ষার্থী, কক্সবাজার সরকারি কলেজ

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-বিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!