করোনাভাইরাস সম্পর্কে শিশুদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন

[ড. জ্যাকলিন স্পার্লিং একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল’ এর একজন অধ্যাপক। ওই স্কুলের ব্লগে প্রকাশিত করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এ লেখাটি অনুবাদ করেছেন মাজহার সরকার]

জ্যাকলিন স্পার্লিংবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 04:13 AM
Updated : 31 March 2020, 04:13 AM

প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে করোনাভাইরাস সম্পর্কে একের পর এক সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। কভিড-১৯ আমাদের অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরা তাদের স্কুলে এ নতুন ভাইরাস সম্পর্কে আগেই শুনেছে এবং খেয়াল করেছে যে বড়রা এটা নিয়ে চিন্তিত।

এতো এতো আলোচনার মাঝে আপনার শিশু এই করোনাভাইরাস সম্পর্কে  শুনে থাকতে পারে এবং এ বিষয়ে আপনার কাছে তার প্রশ্ন থাকতে পারে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে শিশুদের পর্যাপ্ত তথ্য দিন। তাদের উদ্বেগ আর বাড়তে না দিয়ে তাদের প্রশ্নের জবাব দিন, কথা বলার মধ্যে দিয়ে চিন্তার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করুন। মনে রাখতে হবে যে শিশুদের কল্পনা বিস্তৃত। করোনাভাইরাস তাদের মনের মধ্যে অহেতুক বিপর্যয়কর গল্প তৈরি করতে পারে যদি পিতা-মাতা এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ কথা না বলেন। অন্যদিকে, অতিরিক্ত তথ্য দেওয়াও অতিরিক্ত সতর্কতা তৈরি করতে পারে।

তাহলে এ অবস্থায় আপনি কী করতে পারেন? ভাইরাস কী এবং এ ব্যাপারে কী করা উচিত এ বিষয়ে আপনার সন্তানকে কি কি জানতে হবে তা একবার চিন্তা করুন। করোনাভাইরাস সম্পর্কে আপনার নিজের কোনো প্রশ্ন থাকলে, নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম ও তাদের তথ্যগুলো আগে পরীক্ষা করুন, জানুন। যেমন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ পদ্ধতি, যা ভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের তথ্য দেয়। ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ এর তথ্যগুলো জেনে নিতে পারেন। এতে করোনাভাইরাস সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়া নানা গালগল্প, ভুল তথ্য ও গুজব জানতে আপনাকে সাহায্য করবে।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে শিশুদের চারটি প্রশ্ন থাকতে পারে। আপনি শুরু করার আগে, আপনারও কোনো বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। দরকার হলে আপনার শিশু এখন পর্যন্ত কী কী জানে তা জিজ্ঞাসা করুন এবং আপনার সন্তানের কি প্রশ্ন আছে তা জানার চেষ্টা করুণ। আপনার শিশু জিজ্ঞাসা করতে পারে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে এমন চারটি সাধারণ প্রশ্ন নীচে দেওয়া হলো।

করোনাভাইরাস কী? করোনাভাইরাস হলো এক ধরণের জীবাণু যা মানুষকে সুস্থ থাকতে দেয় না। এতে আক্রান্ত হলে মানুষের কেমন লাগে? কিছু লোক কিছুটা অসুস্থ বোধ করে। কিছু লোকের জ্বর ও কাশি হয়। কখনও কখনও কাশির কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে।

করোনাভাইরাস কীভাবে একজনকে আক্রান্ত করে? এ ভাইরাস ফ্লু এর মতো বা সর্দি-কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কারোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির যদি হাঁচি বা কাশি হয় তবে শরীরের অভ্যন্তরে থাকা জীবাণুগুলো শরীরের বাইরে চলে আসে। তার অসতর্ক হাঁচি ও কাশি বাতাসে ভাইরাসের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে পারে।

জীবাণুগুলো যখন বাতাসে ছড়ায় তখন তারা ছয় ফুট দূরত্ব পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে, সম্ভবত আপনি যতটুকু লম্বা তার থেকেও বেশি। এজন্য আপনার পরিবার ছাড়া অন্য ব্যক্তিদের থেকে ছয় ফুট দূরত্বে দাঁড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। যে বাতাসে জীবাণু আছে তাতে আপনি নিশ্চয়ই নিশ্বাস নিতে চান না।

একজন সুস্থ ব্যক্তিরও হাতে জীবাণু থাকতে পারে। অসুস্থ যে কোনও ব্যক্তির স্পর্শ করা বস্তুতে সুস্থ ব্যক্তি স্পর্শ করলে জীবাণু চলে আসতে পারে। অসুস্থ কেউ হাঁচি ফেলেছে বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে এ পৃষ্ঠগুলো স্পর্শ করেছে তাতেও জীবাণু থাকতে পারে। জীবাণু থেকে বাঁচতে আপনার হাত সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন বা পরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। হাত দিয়ে আপনার মুখ, চোখ বা আপনার নাকের ভিতর স্পর্শ করবেন না। কারণ এগুলো এমন জায়গা যেখানে জীবাণুগুলো দেহের ভেতরে ঢুকতে পারে।

শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা এ স্বাস্থ্যকর আচরণগুলো অনুশীলন করে সুস্থ থাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারে:

১. হাঁচি বা কাশি দিলে টিস্যু ব্যবহার করুন এবং তা নিরাপদ জায়গায় ফেলে দিন। অথবা হাঁচি-কাশি দিন আপনার কনুইতে। এতে জীবাণুগুলো ছড়াতে পারবে না এবং অন্যান্য লোককে অসুস্থ করে তুলবে না।

২. আপনি সাধারণত যে সময়ে হাত ধোন তখন সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোবেন। যেমন বাথরুমে যাওয়ার পর, খাওয়ার আগে এবং নাক ফুঁকানোর পর। হাত ধোবেন ২০ সেকেন্ড সময় ধরে।

৩. মুখ, চোখ ও নাক থেকে আপনার হাত দূরে রাখার চেষ্টা করুন।

লোকে মাস্ক পরে কেন? আমারও কি মাস্ক পরা উচিত? মাস্ক হলো অসুস্থদের জন্য যেন তাদের কাছ থেকে জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে। চিকিৎসক ও নার্সদের মতো চিকিৎসা-কর্মীরা মাস্ক ব্যবহার করেন, কারণ তারা ভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দেন। সুস্থ লোকের মাস্ক পরার দরকার নেই।

করোনাভাইরাসে আপনি কি মারা যেতে পারেন? ফ্লু এর মতো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও বেশিরভাগ লোক সুস্থ হয়ে ওঠে। যারা অসুস্থ বোধ করছেন তাদের প্রতি নজর রাখতে চিকিৎসকরা সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করছেন। তারা নিশ্চিত করতে চান যে প্রত্যেকেই তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে এবং ভাইরাসটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে না।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি যা করতে পছন্দ করেন তা চালিয়ে যাওয়া এবং আপনার চারপাশে ভাইরাস নিয়ে অহেতুক উদ্বেগ ছড়াবেন না। কনুইতে হাঁচি দেওয়া, নিয়মিত হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যকর আচরণের অনুশীলন যদি আপনি করেন তাহলে ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ জানানোর কিছু নেই।

নিজে প্রশান্ত হোন ও শিশুদের প্রশান্ত করুন

ভাইরাস সম্পর্কে কথা বলার সময় আপনি নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন না, আপনার শান্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে শিশুরা কী পরিমাণ ভয় পাবে তা ভেবে দেখুন, আপনি কতোটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তা দেখার জন্য তারা আপনার দিকে তাকাবে। শান্ত না থাকতে পারলে কল্পনা করুন আপনি বিমানে করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন। একজন বিমানবালাকে দেখে আপনি আতঙ্কিত হতে পারেন এই ভেবে যে সত্যিই কিছু ভুল আছে এবং এতে আপনার চিন্তিত হওয়াই উচিত। কোনো ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট যদি শান্তভাবে হাসি দিয়ে আপনাকে একটি পানীয় দেয়, আপনি মনে করতে পারেন যে খুব শীঘ্র এই বৈরি বাতাস বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে যাবে।

শিশুদের আড়ালে সংবাদ পড়ুন ও দেখুন

যদিও সংবাদ সবাইকে তথ্য জানাতে সহায়তা করে, তবুও কখনও কখনও সংবাদের গল্পগুলো এমন সব শব্দ ব্যবহার করে যা শিশুদের জন্য ভীতিকর। শিশুরা ঘুমোতে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে সংবাদ-দেখা বন্ধ করার চেষ্টা করুন। অথবা এমনভাবে সংবাদ পড়ুন না দেখুন যাতে শিশুরা এগুলো জানতে না পায়।

শিশুদের প্রশ্নের উত্তরে ভরসা দিন

শিশুদের পক্ষে প্রশ্ন করা, কোন কিছু নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করাই স্বাভাবিক, বিশেষত তাদের কাছে যা নতুন তা সম্পর্কে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবারই তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করুন। প্রশ্ন করে তারা আসলে আপনার আশ্বাস পেতে চায়, সে ভরসাটুকু তাদের দিন।

দেখা যায় কোনো কোনো শিশু বারবার একই বা অনুরূপ প্রশ্ন করছে, তবুও আপনি যতবার প্রশ্নের উত্তর দিন না কেন সন্তান আপনার উত্তরে সন্তুষ্ট নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে জরুরি হলো তার উদ্বেগ কমানো, তাকে আশ্বস্ত করা যে সব ধরণের পরিস্থিতিতে আপনি তার পাশে আছেন সহায়তা করার জন্য। তাকে মানসিক শক্তি দিন। 

মনে রাখবেন, পুরো বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবাই কঠোর পরিশ্রম করছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। বিশ্বব্যাপী এ প্রচেষ্টায় সবার সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুযোগ আপনার আছে, আর সেটা হলো উপরে উল্লেখিত স্বাস্থ্যকর আচরণগুলো অনুশীলন করা এবং এগুলো আপনার শিশুদের মাঝে শিক্ষা দেওয়া।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!