রহস্য উপন্যাস: অলীকের অভিযান, পর্ব ৪

আফসানা বেগমআফসানা বেগম
Published : 21 Sept 2018, 11:36 AM
Updated : 21 Sept 2018, 11:36 AM

চৌদ্দ

‘দাদু, আজ আমি রাতে ঘুমাব না। দেখব কলমটা কী করে লেখে,’ ভাত খেতে খেতে অলীক বলে।

‘এটা ভালো বুদ্ধি। দেখতে পারলে আমাকেও ডেকো। আমি কখনো একটা কলমকে নিজে নিজে লিখতে দেখিনি।’

‘ঠিক আছে। বাবা-মাকে কিন্তু বলা যাবে না। প্রতিদিন জানতে চায় আমি পড়াশোনা কিছু করছি নাকি খালি ভিডিও গেম খেলেই কাটাচ্ছি।’

‘আমার কাছেও জানতে চেয়েছিল। কী যে বলব, শুধু বললাম, কই, অলীক তো আজকাল ভিডিও গেমে তেমন হাতই দেয় না।’

‘বাবা বিশ্বাস করল তোমার কথা?’

‘না মনে হয়। কেমন যেন সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।’

‘আর বড়ো সমস্যা হয়েছে কি জানো, বুয়া মাকে বলেছে যে আমি নাকি আজকাল সারাদিন পড়ালেখা করি। সেটা শুনে মা একেবারে ভড়কে গেছে। বাড়িসুদ্ধো সবাই কেন মিথ্যে কথা বলছে মা ভেবে পাচ্ছে না।’

‘তোমাকে তাই বলল?’

‘নাহ্, শুধু জানতে চাইল স্কুল কবে খুলবে। তারপর বলল, তুই স্কুলে গেলেই ভালো, বুঝলি? বাড়িতে থাকলে চিন্তা হয়। বাবাও মাথা দোলাল। আমি বুঝলাম না, এরকম বাবা-মা কখনো পেয়েছে নাকি কেউ? ছেলে সারাদিন পড়ালেখা করছে শুনে চিন্তায় পড়ে গেছে!’

‘হা হা হা...’

‘তুমি হাসছ, দাদু? আমার কিন্তু খুব রাগ হয়েছে।’

‘রাগ কোরো না, দাদুভাই। পরে যখন ওরা তোমার কাহিনীটা পড়বে, তখন ঠিকই বুঝবে। যা হোক, কিডন্যাপারদের হাত থেকে বাঁচা গেল তো?’

‘তা কি অত সোজা? ওরা তো প্রফেশনাল, বুঝেছ? তবে বাচ্চাদের ব্যাপারে তাদের অ্যালার্জি আছে। বাচ্চাদের কান্না তাদের ভালো লাগে না। ওদের হাত থেকে বাঁচা কঠিন হবে।’

‘তা তো হবারই কথা।’

‘আর আরেকটা ব্যাপার, ওই যে একটা লোক আগে থেকেই তাদের হাতে বন্দি হয়ে আছে, তাকে উদ্ধার করতে হবে না? শুধু নিজেদের বাঁচালেই তো হলো না, তাকে সেখানে ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসাটা খুবই অমানবিক হবে। আর আমরা তো ভালো ছেলে, এরকম কিছু করতে পারি না, তাই না?’

‘তা ঠিক তা ঠিক, দাদুভাই। কাহিনি হলে কী, তাতেও অমানবিক হওয়া ঠিক না। তোমাদের উচিত তাকে বাঁচানো।’

‘হুম, সেটাই। কিন্তু লোকগুলো এত বড়ো আর আমরা এত ছোটো, তাদের হাতে আবার ছুরিও আছে! আমাদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধেও ফেলেছে। এখন কী যে করব তাই ভাবছি। তুমি তো বলেছ অস্ত্র ব্যবহার ভালো না, ওটা ছাড়াই চলে। কিন্তু তাদের কাছে আর কী কী অস্ত্র আছে তার কি কোনো ঠিক আছে?’

‘তবু, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই ওখান থেকে বেরোতে পারবে, দেখ।’

পনেরো

আমাদের চোখের সামনে হুড়মুড় করে দরজা খুলে দাঁতঅলা লোকটা হাতে কাগজের একটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকল। তারপর দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দিল। ঘরে পরোটা আর ডিমভাজির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল সাথে সাথে। খিদেয় আমাদের পেট চোঁ চোঁ করে উঠল। সেই কখন স্কুলে টিফিন খেয়েছিলাম। তারপর কেবল বিলের পানিফল।

আর এখন হয়ত বেশ রাত। পিছনে হাত বাঁধা তাই ঘড়ি দেখতে পারলাম না। জিয়ন আমার কানে কানে বলল, ‘নাভিদ খাবার চেয়ে ভালোই করেছে। আমার খুব খিদে পেয়েছে।’ আমি ফিস ফিস করে জবাব দিলাম, ‘আমারও।’ তারপর বললাম, ‘কিন্তু তোমার কি মনে হয়, মানে, ওই হ্যান্সেল আর গ্রেটেলের যা হয়েছিল, মানে, খাওয়ানোর পরে এরা কি আমাদেরকে মেরে ফেলবে?’ জিয়ন জবাব দেবার আগেই দাঁতঅলা আমাদের খুব কাছে চলে এল, ‘কী ফুসুর ফাসুর চলতে আছে? কুনো লাভ নাই। হাত খুইলা দিতাছি খাওনের লাইগা। খাওয়া শ্যাষ হইলে আবার বাইন্দা দিমু। চালাকি করনের কুনো কায়দা নাই।’

হাত খুলে আমাদের হাতে হাতে পরোটা আর ডিমভাজি দেয়া হলো। গরম গরম সাদা পরোটা খেতে মোটেও সময় লাগল না আমাদের। কোনো দিকে তাকালাম না, তাকাবই-বা কীসের দিকে, পা সামনে ছড়িয়ে বাঁধা আর চারজনের পিঠ একসঙ্গে লাগানো, সামনে শুধু দেয়াল। ঘরটাতে কিছুই নেই। না চেয়ার না খাট। এটা নিশ্চয় কারো বাড়ি নয়। বাড়ি হলে কিছু তো একটা থাকত। মানুষ ধরে এনে আটকে রাখার জায়গা হয়ত এটা।

পরোটা খাওয়া শেষ হলে আরেকটা প্যাকেট থেকে সত্যি সত্যি আমাদেরকে রসগোল্লাও দেয়া হলো। হাত থেকে রস চুইয়ে কনুই বেয়ে প্যান্টের উপরে পড়তে লাগল। কী আর করা, ওদের কাছে টিস্যু চাওয়ার সাহস হলো না। কিন্তু সে যাই হোক, এটা আমার কাছে একেবারেই অবিশ্বাস্য লাগল। যাকে তুমি বেঁধে রেখেছ আর মারবে বলে ভাবছ তাকে কখনো রসগোল্লা খাইয়ে মুখ মিষ্টি করার কথা ভাববে? কে জানে বাবা, এই কিডন্যাপারগুলো বড়ো আজব! তবে খাওয়া শেষ হলে দাঁতওলা আর মোচঅলা আমাদের সামনে গুছিয়ে বসল।

‘এইবার এক এক কইরা নিজেদের ফোন নম্বর আর ঠিকানা বলেন তো বাবুরা?’

‘কেন বলব?’ নাভিদ ফোঁস করে উঠল। আমার ভয় লাগল, অনন্ত যে ভুল ঠিকানা বলতে বলেছে সেটা আবার ফাঁস করে দেয় নাকি।

‘কেন বলবা মানে? তোমাদের আদর কইরা খাওয়াইলাম, বাড়িত পৌঁছায়ে দিয়া আসব না?’

‘আমরা নিজেরাই যেতে পারি। আমাদের ছেড়ে দাও,’ নাভিদ রশির উপরে জোর খাটাতে লাগল।

‘ওই চুপ। একদম চুপ। বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর আর নিজেদের নাম এক এক কইরা বইলা যাও। অন্য কুনো কথা কইলেই... ’ মোচঅলা তার ছুরিটা বের করে নাভিদের নাকের উপরে ছোঁয়াল।

আমাকে দিয়ে শুরু হলো। আমি বলতে লাগলাম, ‘আমার নাম অলীক। বাবার নাম রাজিব রহমান,’ এটুকু বলেই অনন্তর উপদেশের কথা ভেবে কেঁপে উঠলাম। সত্যি কথা বলছি কেন! দেখলাম একে তো সামনে ছুরি, আর যে কথা জীবনে হাজার বার বলা হয়ে গেছে তা নিয়ে ফট করে মিথ্যা বলা খুব কঠিন। সত্যটাই মুখে আগে এসে পড়ে। নাম অলীকইবা বলতে গেলাম কেন, আরিয়ান, আশফাক, রাসেল... কত হাজার নাম ছিল। বাবার নামটাও ভুলভাল বলতে পারতাম।

‘ওই, কী হইল? দম আটকাইয়া গেল নিকি?’ আমাকে চুপ থাকতে দেখে দাঁতঅলা ধমকে উঠল। ধমকের চোটে আমি বলে ফেললাম, ‘মায়ের নাম রুবিনা আর বাসা বেইলি রোডে, সিদ্ধেশ্বরী কলেজের পিছনে।’

এত ঠিকঠাক না বললেও পারতাম। অনন্ত পাশ থেকে নড়ে উঠে ঠেলা দিল। তখন ফট করে বলে ফেললাম বাসার নম্বর ১৬/১৩-এ, যেখানে কিনা আসল নম্বর ৬/৩-সি। কাঁপতে কাঁপতে ওইটুকু মিথ্যা বলতে পেরে খুব ভালো লাগল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম অনন্ত মিটিমিটি হাসছে। বুঝতে পারলাম বাসার নম্বর মিথ্যে বলেছি বলে সে খুশি হয়েছে।

‘বাপের ফোন নম্বর কও’ মোচঅলা জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, ‘০১৮২৩৫৮৬৭৪১’ অন্তত তিনটা ডিজিট উলটে পালটে বললাম। বলাটা খুব কঠিন হলো। যেমন ৩২ না বলে বললাম ২৩, ১৪ না বলে ৪১, আর বলে নিয়ে মনে মনে হাসলাম। আমার মিথ্যা বলা দেখে বাকিরা সাহস পেল। একে তো পেট ভরে খাওয়া আর তার উপরে আমাকে অনর্গল ভুল কথা বলতে দেখা, দুইয়ে মিলে মিথ্যা বলার শক্তি পেয়ে গেল তারা। আমার পরে জিয়ন আমার চেয়েও বেশি মিথ্যা বলল। নাভিদের মতো মানুষও কিনা বাবা-মা কারো নাম ঠিকঠাক বলল না। আর অনন্তকে দেখে অবাক হলাম, সে নিজের নাম বলল, স্বাধীন। একটা সত্যি কথাও তার মুখ থেকে বেরোল না। শুনে মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে প্র্যাকটিস করছিল।

সব লিখে নেবার পরে দাঁতঅলা আর মোচঅলা খুশি মনে পাশের ঘরে চলে গেল। আমরা ভাবলাম এখনই বাড়িতে ফোন করতে চেষ্টা করবে আর আমাদের মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। অনন্ত বলল, ‘ওরা এখান থেকে ফোন করবে না। অন্য কোথাও থেকে করবে।’

লোকদুটো বেরিয়ে এল কিছু পরে। তাদের হাতে ইঞ্জেকশন। নাভিদ চিৎকার করে বলল, ‘আমি ইঞ্জেকশন ভয় পাই, খুব ভয় পাই...’ তারা নাভিদের হাতে সবচেয়ে আগে সূঁচ বসিয়ে দিল। তারপর নাভিদের গালে কষে লাগাল এক চড়। নাভিদ তো বটেই, আমরাও ভয়ে চুপ হয়ে থাকলাম। তারা একে একে সবার হাতে ইঞ্জেকশন লাগাল। হাত-পা বাঁধা আর মনের মধ্যে ছুরির ভয়। সব মিলিয়ে আমাদের মানা করার কোনো উপায় ছিল না। আমরা হয়ত মারা যাচ্ছি কিংবা মরে গেছি কি না তা-ও বুঝতে পারলাম না। শুধু কেন যেন চুপ করে থাকতে ইচ্ছা করল। রাত কি অনেক হয়েছে? নাকি অনেকক্ষণ পরে পেট ভরে খাওয়ার জন্য হঠাৎ এত ঘুম পেয়ে গেল, বুঝলাম না! . . .

‘অলীক, অলীক?’ প্রথমে মনে হলো এত মিষ্টি গলা আমি জীবনেও শুনিনি। না না, মিষ্টি গলাটা আমি চিনি। ‘অলীক, অলীক?’ হ্যাঁ, আমি গলাটা শুনেছি। অনেকবার শুনেছি মনে হয়। কোনোরকমে চোখ মেলে দেখি আমাদের স্কুলের ভূগোল টিচার। ম্যাডামকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। যেদিন ভূগোল ক্লাস থাকে, আমার মেজাজটা আগের রাত থেকেই খারাপ থাকে। পৃথিবীর কোথায় কোন জায়গা, কোন নদী কোথায় গিয়ে গতি পরিবর্তন করেছে, কোথায় মালভূমি তৈরি হয়েছে আর কবে হিমবাহ গলে কোন দিক দিয়ে ঝরণা হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সেসব তো যার যার জায়গায় আছে বা সময়মতো যা হবার হবেই, তাদের কথা আমাকে জানতে হবে কেন? জানলেও মনে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব। সাবজেক্টটা অপছন্দ করি বলে ম্যাডামকেও আমার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু বুঝলাম না তখন ম্যাডামের গলাটা এত সুন্দর লাগল কেন। আমি চোখ খুলে বললাম, ‘জি ম্যাডাম...’

‘এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে? তাহলে তো ওরা জিতে যাবে,’ বলে ম্যাডাম সামান্য হাসলেন। কিন্তু তার হাসিটা দেখাল দুশ্চিন্তার মতো। তবু, ম্যাডাম কি ক্লাসে কখনো এত সুন্দর করে হেসেছেন? মনে পড়ল না।

ম্যাডাম খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছেন। সাদা রঙের উপরে পাহাড়-পর্বত, নদী, উপত্যকা আর ঝরনার ছবি, আর সেসবের ফাঁকে ফাঁকে ছোটোবড়ো শহর। হাঁটু গেড়ে বসে ম্যাডাম আমার থুতনির নীচে হাত রেখে মুখটা তুলে ধরলেন, ‘এই যে, অলীক, শুনতে পাচ্ছ? আবার ঘুমিয়ে পড়লে যে...’

‘না না ঘুমাইনি। আটকে রেখেছে তো তাই একটু ঝিমুনি এসে গেছে।’

‘সেটাই তো বলছি, এভাবে ঝিমুলে চলবে? তাহলে এখান থেকে বেরোবে কী করে? এই যে এদিকে দেখ,’ বলে ম্যাডাম তার শাড়ির কুঁচির মাঝখান থেকে একটা কুঁচি টেনে দেখাতে লাগলেন।

‘জি, ম্যাডাম, দেখছি। আপনার শাড়িতে অনেক শহর আর নদী আর পাহাড় আর...’ ম্যাডামের শাড়ির ছবিগুলো এত সুন্দর অথচ ইচ্ছে থাকলেও তাকিয়ে দেখতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল।

‘হ্যাঁ, এই শাড়ির ছবি দেখে দেখেই তো আমি এখানে চলে এলাম। এটা রোড ম্যাপ,’ ম্যাডাম বললেন।

‘রোড ম্যাপ! ম্যাপ দেখে দেখে কি বাড়ি ফেরা যায়?’

‘যায়। তবে সেটা ক্লাসে আরেকদিন বুঝিয়ে দেব। ম্যাপ আমার সবসময় লাগে। আমাকে সব জায়গার খবর রাখতে হয়। না হলে পড়াব কী করে?’

‘তা ঠিক তা ঠিক, ম্যাডাম...’ ম্যাডামের প্রশ্নের উত্তর দেবার পরেই প্রতিবার কেন আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বুঝতে পারছিলাম না। ম্যাডাম বললেন, ‘এবারে ভালো করে শোনো দেখি, ওই যে লোকটা তোমাদেরকে বাসাটার পাশ থেকে ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলো, তখন কিন্তু সে বাইরে যাবার দরজা দিয়ে বেরোয়নি। মনে আছে?’

আমি ম্যাডামের কথা শুনে সামান্য বড়ো করে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, দাঁতঅলা আমাদেরকে ধরে আনছিল। আর মোচঅলা তখন দরজা খুলে আমাদেরকে ভিতরে ঢুকিয়েছে। কিন্তু তার আগমুহূর্তে জিয়ন উঁচু জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাদের দুজনকেই ঘরের ভিতরে দেখেছিল। তাহলে দাঁতঅলা কোন দিক দিয়ে চুপি চুপি আমাদের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল?

‘অলীক, শুনতে পাচ্ছ?’

‘জি, ম্যাডাম।’

‘তাহলে এই ঘর থেকে বেরোনোর আরেকটা রাস্তা আছে, তাই না?’

‘মনে হয়। কিন্তু আপনি কী করে সেটা জানলেন?’

‘আরে আমি জিওগ্রাফি টিচার না? পৃথিবীর কোথায় কী আছে আমাকে সব জানতে হয়, বুঝেছ?’

ম্যাডামের ‘বুঝেছ?’ কথাটা কেন যেন বারবার আমার কানে বাজতে লাগল। বুঝেছ? বুঝেছ? বুঝেছ? টেনে টেনে চোখটা খুললাম। ম্যাডাম কোথাও নেই। সামনে দেয়াল। জোরে ডাকলাম, ম্যাডাম, ম্যাডাম... কিন্তু কেন যেন ডাকটায় জোর নেই। ম্যাডামের কোনো জবাবও শোনা গেল না। তবে নাকে ম্যাডামের পারফিউমের গন্ধটা এসে লাগল, জিওগ্রাফি ক্লাসে ম্যাডাম ক্লাসরুমে ঢুকলেই যে গন্ধটা আমরা পাই। তার মানে ম্যাডাম সত্যিই এখানে এসেছিলেন। কিন্তু এলেনই যদি তবে আমাদেরকে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে দিলেন না কেন? তারপর নিজে নিজেই আমি নিজেকে উত্তর দিলাম, ম্যাডাম তো জিওগ্রাফি টিচার, ম্যাপ বলা তার কাজ, দড়ি খোলা নয়।

ষোলো

‘দাদুভাই, তোমার না রাতে আমাকে ডাকার কথা ছিল? কলম কী করে লিখল, দেখেছ নাকি?’

‘হুমম?...’

দাদুর ডাকাডাকিতে অলীকের ঘুম ভাঙে। লাফিয়ে বিছানায় বসে। আশ্চর্য, মনে আছে কলমটার দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল সে। বেশ রাতে বাবা এসে লাইট নিবিয়ে গেল। বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে ঘুমের ভান করল। লাইট বন্ধ হলে আবছা আলোয় কলমটার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর? তারপর কি ঘরের আলো আর জ্বলেনি? কিছুই মনে পড়ছে না। কলম কি তাহলে অন্ধকারেই লেখে?

অলীকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দাদু জানতে চায়, ‘সারা রাত জেগে জেগে কলমকে লিখতে দেখলে নাকি যে এত বেলা করে ঘুমাচ্ছ? আমি তো হাঁটাহাঁটি শেষ করে ফিরলাম।’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না, দাদু। কলমটা যেমন লেখে তেমন ঘুমও পাড়ায় মনে হয়। কাল রাতে আমি সোজা কলমটার তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।’

দাদু হাসলেন, ‘তাই নাকি? কী এক কলম রে বাবা! যা হোক, ওঠো, অনেক দেরি হলো, খেতে এসো।’

‘তুমি খেতে শুরু করো, আমি দেখে আসছি কলম কিছু লিখে রেখেছে নাকি!’

চোখ কচলে অলীক খাতাটার দিকে তাকায়... এ কী! জিওগ্রাফি টিচার আবার এর মধ্যে এল কোত্থেকে? অলীকের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। জিওগ্রাফি সে দুই চোখে দেখতে পারে না আর তাই ম্যাডাম যত ভালো করেই পড়াক না কেন, তার পছন্দ হয় না। টিচার অবশ্য অলীককে একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি জিওগ্রাফি তোমার একদম ভালো লাগে না। আর যে সাবজেক্ট আমাদের সবচেয়ে কম ভালো লাগে, রেজাল্ট ভালো করার জন্য সেটাতে তত বেশি মনোযোগ দিতে হয়।’ অলীক পালটা উত্তর দিয়েছিল, ‘কিন্তু ভালো না লাগলে মনোযোগ দেব কী করে?’ টিচার হেসে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।’ তারপর টেবিলের উপরে রাখা গ্লোবটা আঙুল দিয়ে ঠেলা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘পরের ক্লাসে আমি তোমাদের ইন্টারন্যাশনাল টাইম লাইন শেখাব। দেখবে কত মজা। একই পৃথিবীতে একই সময়ে কেউ রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে, আবার কেউ দিনের আলোয় রাস্তায় ছোটাছুটি করছে, প্রত্যেকের ঘড়ি আলাদা সময় বলছে।’

অলীক তখন ম্যাডামের কথা কিছুই বোঝেনি। পরের ক্লাসে তার তেমন মনোযোগও ছিল না। গ্লোবের উপরে আঙুল রেখে একটা লাইন দেখিয়ে ম্যাডাম কী সব বলছিলেন। আর এখন এটা পড়ে মনে হচ্ছে ম্যাডাম যেন ওই কিডন্যাপারদের বাড়িতেও ক্লাস নিতে চলে এলেন। কিন্তু ম্যাডাম সেখানে কেন এলেন অলীক ভেবে পায় না। ম্যাডাম কি তাকে সাহায্য করতে চান নাকি তিনিও ওই কিডন্যাপারদের মতো তাকে আটকে রেখে জিওগ্রাফি পড়াতে চান? যা হোক, ওই খারাপ লোকগুলো তাদের সবাইকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে গেলইবা কোথায়। অলীকের মনে হলো এত সমস্যার সমাধান করা তার পক্ষে ওই মুহূর্তে সম্ভব না। আগে হাতমুখ ধুয়ে ভালোমতো খেয়ে নিতে হবে তারপর দেখা যাবে।

সতেরো

‘ম্যাডাম ম্যাডাম... ম্যাডাম...’

‘অ্যাই, অলীক, কী তখন থেকে শুধু ম্যাডাম ম্যাডাম করছ? এখানে এই বন্ধ ঘরের মধ্যে কোন ম্যাডামকে ডাকছ, হুম?’ অনন্তের প্রশ্নে আমার ঘুমটা একেবারে ছুটে গেল। জানালার কপাট আর চৌকাঠের মাঝখানের সরু ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো আসছে তখন। তার মানে সকাল হয়ে গেছে। রাতটা কীভাবে কাটল বলতেই পারব না। বসে বসে একটানা ঘুমিয়েছি সবাই। আমার আর অনন্তের নড়াচড়ায় জিয়নও নড়ে উঠল। নাভিদ তখনো ঘুমে কাদা।

‘অনন্ত, জিওগ্রাফি ম্যাডাম এসেছিলেন। তাকেই ডাকছি,’ আমি বললাম।

‘কী যে বলো না, আমাদের হাতে পায়ে দড়ি টাইট হয়ে বসে গেছে, দরজাও বন্ধ, এখানে জিওগ্রাফি ম্যাডাম কোত্থেকে আসবেন বলো তো?’ অনন্ত হাসল। তার সঙ্গে জিয়ন জোরে জোরে হাসল আর বলল, ‘ম্যাডাম কি ইন্টারন্যাশনাল টাইম লাইন বুঝিয়ে গেল তোমাকে?’

‘আরে নাহ্, বলল যে এই বাড়ি থেকে বেরোনোর আরেকটা রাস্তা নিশ্চয় আছে যেটা দিয়ে ওই দাঁতঅলা বেরিয়ে গিয়ে আমাদেরকে পিছন থেকে চুপ করে ধরে ফেলেছিল।’

‘তুমি মনে হয় স্বপ্ন দেখেছ, অলীক,’ অনন্ত বলল।

‘কিন্তু ব্যাপারটা তো সত্যি। আর তোমরা কি ম্যাডামের পারফিউমের গন্ধটা পাচ্ছ না? ভালো করে শুঁকে বলো তো দেখি...’ আমি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলাম। তারা দুজন কুকুরের মতো মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করল। গুমোট ঘরটায় জোরে নিশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে ওদের নাক-মুখ আরো কুঁচকে গেল। তারপর জিয়ন ঘুমজড়ানো গলায় বলল, ‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অলীক।’

আমি ঠিক করলাম এ নিয়ে আর ওদের সঙ্গে কথা বলব না। আমাদের কথাবার্তা শুনে নাভিদ নড়েচড়ে বলল, ‘আমরা কি বেঁচে আছি?’ অনন্ত বলল, ‘তুমি কি তাহলে মরে গিয়ে কথা বলছ?’ নাভিদ লক্ষ্মী ছেলের মতো বলল, ‘আমরা তাহলে এখন কী করব?’ আমি মনে মনে বললাম, সেটাই, আবোলতাবোল কথা বাদ দিয়ে এখন কী করা যায় সেটাই আমাদের ভাবতে হবে। বললাম, ‘লোকদুটোর তো কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না, চলো ওই দরজার ওদিকে কী আছে দেখি।’

‘মানে? আমরা কি নড়তে পারব নাকি? ওরা দেখতে পেলে যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে?’ নাভিদ আঁৎকে উঠল।

‘অত ভয় পেলে চলে? মারলে ওরা আমাদেরকে এমনিতেও মারবে। চলো দেখি,’ জিয়ন বলল। তারপর খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমি সত্যিই ওই ঘরে একজন মানুষকে দেখেছিলাম যাকে ওরা ইঞ্জেকশন দিচ্ছিল।

অনন্ত সবচেয়ে আগে হাঁটুমুড়ে সেদিকে এগোতে চেষ্টা করল। আমরা যে যার মতো করে তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে দরজাটার দিকে এগোলাম। অনন্ত পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। একদিকের উঁচু জানালা দিয়ে ওই ঘরে আলো এসেছে। ঘরটা বেশ বড়ো। আমাদের ঘরটাতে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। ওটাতে ওরকম অবস্থা নয় কিন্তু বিশ্রী একটা গন্ধ কেন যেন ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনন্ত বলল, ‘লোকটা কই যাকে জিয়ন দেখেছিল?’ জিয়ন তার পিঠে পিঠ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ভালো করে দেখ, আমি সত্যি দেখেছি। একটা লোক, যাকে ওরা ইঞ্জেকশন দিল আর লোকটা মরে গেল।’

‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পুরো ঘরে কিছুই নেই। এটা কোনো বাড়ি না, বাড়ি হলে অন্যরকম হতো,’ অনন্ত বলল।

‘হ্যাঁ, এটা মনে হয় কোনো জিনিস রাখার বাড়ি। মানে, ওয়্যার হাউজ,’ আমি বললাম।

‘তাই মনে হচ্ছে। এটা এখন মানুষ আটকে রাখার ওয়্যার হাউজ,’ জিয়ন বলল।

মেঝের মধ্যে ওইটুকু গড়িয়ে এসেই আমরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মাথা কাত করে ওদিককার ঘরের সামান্য একটুখানি দেখতে পাচ্ছিলাম। যেটুকু দেখছিলাম সেটুকুর মধ্যে শুধু দেয়াল। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু ম্যাডাম যে বলল ওদিকে বেরোনোর আরেকটা রাস্তা আছে? সেরকম কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’

‘উহ্ তখন থেকে শুধু ম্যাডাম ম্যাডাম করছ। আচ্ছা, ম্যাডাম এখানে কোত্থেকে আসবেন, অলীক?’ অনন্ত বিরক্ত হলো। তাই কথা ঘুরিয়ে আমি বললাম, ‘অনন্ত, লোকদুটো তো ওই ঘরে নেই, চলো গিয়ে দেখে আসি তাহলে ওখানে কী আছে।’

কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিয়ে অনন্ত আবার চলতে শুরু করল। জিয়ন পিছন দিকে ঠেলল, আমি আর নাভিদ দুই দিক থেকে। আমাদের অবস্থা হয়েছে কচ্ছপের মতো। যেন আমাদের হাত-মাথা সব একসঙ্গে কচ্ছপের পেটের মধ্যে বাঁধা আর চারদিকে চারটা পা। আমরা চলিও কচ্ছপের গতিতে, খুবই ধীরে। ওই ঘর থেকে এই ঘরে আসতে আমাদের এক বছর লাগল।

দরজাটা পার হতেই জিয়ন প্রথমে দেখতে পেল লোকটাকে, বলল, ‘ওই যে, ওই লোকটাকেই দেখেছিলাম। ওই দেখ।’ আমরা মাথা যতটা পারা যায় ঘুরিয়ে পিছনের দেয়ালের দিকে তাকালাম। দরজার পিছনে কপাটের সাথে লেগে আছে লোকটা। মুখটা দেয়ালের দিকে ঠেসে রাখা তাই দেখা যাচ্ছে না। খালি গা, খালি পা, শুধু নেভি-ব্লু প্যান্ট পরা, কোমরে কালো একটা বেল্টও আছে। পিছনে হাত বাঁধা আর পা দুটো ছড়িয়ে জোড়া করে বাঁধা। একনজরে মনে হবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। কিন্তু কোমরে ভাঁজ করে লোকটা পিছনে দেয়ালের দিকে ঘুরে গেছে। আমি তার চুল দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম না, নিজের ইচ্ছেতে ওরকম অদ্ভুত ভঙ্গিতে থাকা যায়? লোকটা নিশ্চয় মরে গেছে। তা ছাড়া, আমরা ঘস ঘস শব্দ করে মেঝের উপর দিয়ে এগোচ্ছি আর নিজেদের মধ্যে কথাও বলছি, বেঁচে থাকলে এসব শুনতে পেয়ে সে কি ঘুম থেকে উঠত না?

আরো কিছুক্ষণ কচ্ছপের মতো এগোতে এগোতে আমরা ঘরটার প্রায় মাঝখানে চলে এলাম। এসে দেখি বামদিকে একটা জানালা যেটাকে বাসার মতো সাধারণ জানালা বলা যায়, তবে বেশ সরু। আমি অনন্তকে বললাম, ‘ওই জানালাটার দিকে যাও, খুলে দেখি বাইরে কেউ আছে নাকি।’ অনন্ত বলল, ঠিক। বাইরে কেউ থাকলে বলতে পারব যে আমাদেরকে আটকে রেখেছে।’ জিয়ন ভয় পেয়ে বলল, ‘আর বাইরে যদি ওই লোকদুটো দাঁড়িয়ে থাকে?’ আমি বললাম, ‘আরে একেবারে খুলে ফেলব নাকি? চুপি চুপি দেখব শুধু।’

আমরা তখন জানালাটার দিকে রওনা দিলাম। সে-ও প্রায় এক বছরের রাস্তা। ধীরে ধীরে বহুক্ষণ পরে আমরা সেখানে পৌঁছলাম। তারপর মাটি থেকে যতটুকু উঁচু হওয়া যায় ততটুকু পর্যন্ত হয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়াই সার, আমাদের তো আর হাত বলে কিছু নেই যে জানালা খুলব। হাত পিছনে পিঠের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। জানালার দুই কপাটের মাঝখানের সরু লাইন দিয়ে বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে, ব্যাস এটুকুই। অনন্ত ওই ফুটো দিয়ে আরেকটু ভালো করে দেখে বলল, ‘ওদিকে জঙ্গল। শাল গাছ দেখা যাচ্ছে।’

শুনে খুব হতাশ লাগল। জানালার পাশেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম আমরা। ওদিকে মানুষ আসার কোনো আশা নেই হয়ত। সেখানে বসে দেখলাম ঘরের আরেক কোণে একটা সাদা শার্ট, নেভি-ব্লু কোট আর লাল টাই মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওগুলো হয়ত ওই লোকটারই হবে। তার পাশে কাগজের প্যাকেটের উপরে কাচের ছোটো ছোটো টিউব আর কয়েকটা সিরিঞ্জ, দেখতেই কেমন যেন ভয় ধরে গেল। আমাদের হাত খোলা থাকলে ওগুলো নিয়ে নির্ঘাত ওই দুটো দুষ্টু লোকের হাতে বসিয়ে দিতাম। ঘরের আরেকদিকে কিছু খাবারের প্যাকেট আর কবেকার কিছু খাবার, ছেঁড়া পাউরুটি পড়ে ছিল।

নাভিদ বলল, ‘এই যে আংকেল, শুনতে পাচ্ছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে আমরা একে একে তাকে ডাকলাম, ‘আংকেল, আপনি কি বেঁচে আছেন?’

‘আংকেল...’

‘উঠুন না, আংকেল, কবে থেকে আছেন এখানে?’

‘ও আংকেল, শুনতে পাচ্ছেন?’

‘ভাই, আপনাকে কি ওরা মেরে ফেলেছে?’ লোকটার কোনো নড়াচড়া না দেখে শেষপর্যন্ত নাভিদ তাকে ভাই ডাকা শুরু করল। তাই শুনে ওই অবস্থায় আমরা হাসতে লাগলাম। হাসির মাঝখানে অনন্ত বলল, ‘চলো আমরা আমাদের জায়গায় ফিরে যাই, ওরা হয়ত এক্ষুণই চলে আসবে।’ আমাদের হাসাহাসি, কথা, মেঝের ঘষ ঘস শব্দ, কোনো কিছুতে লোকটা একটুও নড়ল না। আমরা আমাদের আগের জায়গার দিকে রওনা দিলাম। বাড়ি কিংবা ওয়্যার হাউজ, যাই হোক, একমাত্র সামনের দরজাটা, যেটাতে এখন তালা লাগানো, সেটা ছাড়া আর কোনো বেরোনোর রাস্তা ওখানে ছিল না। জিওগ্রাফি ম্যাডাম সত্যি এসেছিলেন কি না জানি না তবে যা বলেছিলেন তা সত্যি না।

অনেক চেষ্টা করে আমরা আমাদের জায়গায় পৌঁছতেই সামনের দরজার তালায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পাওয়া গেল। সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। লোকদুটো ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। ঢুকেই আমাদের দিকে তেড়ে এল আর আমাদের চুল টেনে ধরে ধরে চড়-থাপ্পড় মারা শুরু করল। মোচঅলা চড় মারতে মারতে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘উইঠা গেছেন আপনেরা? এত্ত সহজেই ঘুম ভাঙল?’

আমরা কিছুই বুঝলাম না। যেন ঘুম ভেঙে উঠে পড়াটাই আমাদের অপরাধ হয়েছে যে কারণে মার খেতে হচ্ছে। আমাদের হাত পিছনে বাঁধা, তাই ইচ্ছে থাকলেও তাদেরকে মারতে পারলাম না। বেশ কিছু চড় মেরে মোচঅলা সামনে বসল, বলল, ‘সক্কলে মিল্যা ফোন নম্বরগুলা ভুল দিছেন ক্যান আপনেরা? নাম-ধাম ঠিকানা ঠিকাছে, নাকি ওইগুলাও ভুয়া? বহুত সেয়ানা! বাচ্চা দেইখা ভাবছিলাম হাবা, পরে দেখি একটার চাইতে একটা শয়তান।’

আমরা তাদের কথা শুনে অপরাধীর মতো চুপ করে থাকলাম আর চুপচাপ মারও খেলাম। মারতে মারতে দাঁতঅলা হঠাৎ উঠে চলে গেল পাশের ঘরে। তারপর সেখান থেকে ডেকে বলল, ‘উস্তাদ, কাইল মনে কয় সত্যিই অ্যার ডোজ এট্টু বেশি হইয়া গেছে গা।’ উস্তাদ তখন আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটে গেল। তারপর ওদিকে চড়-থাপ্পড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।

‘কাইলকাই আমি তরে কইছিলাম। দ্যাখ গিয়া মইরা গেছে নাকি। তাইলে আর বাকি ট্যাকাটুকা পাওয়ার কুনো আশা নাই। বস তাইলে আমাগোরে খাইয়া ফালাইব।’ উস্তাদ লোকটা মনে হয় খুব রেগে গেল। এর মধ্যে আবার বস এল কোত্থেকে বুঝলাম না। কিন্তু মেঝেতে বসে থাকা লোকটা মরেই গেছে নাকি কে জানে। কিছুক্ষণ পরে দাঁতঅলা কিছু আবিষ্কারের মতো করে বলল, ‘না উস্তাদ, শ্বাস চলতে আছে। কোনোরকমে বাইচা আছে এখুনও!’

‘ঠিক আছে। থাউক। আইজকাই শ্যষ দিন। বস কইছে, কাইল অ্যারে পার করতে হইব। আর সময় দেওয়া চলব না,’ মোচঅলার গম্ভীর গলা শুনলাম। তারপর তারা ফিরে এল আমাদের দিকে।

‘মিথ্যা কতা কওনের জন্যি শাস্তি হইল গিয়া খাওন বন্ধ। আইজকা কুনো খাওন নাই,’ মোচঅলা ঘোষণা দিল। তারপর আমাদের প্রত্যেকের নাকের উপরে ছুরি রেখে রেখে বাবা-মায়ের ফোন নম্বর সুন্দর করে টুকে নিল। ছুরির খোঁচায় ইচ্ছা না থাকলেও ফোন নম্বর সত্যি ভুলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু চেষ্টা করে মনে করে ঠিকঠাকমতোই বললাম। দেখলাম সত্যি সত্যি ভয় পেলে আর মিথ্যা বলা যায় না।

আঠারো

লোকগুলো আবারো পাশের ঘরে গেল। মোচঅলা দাঁতঅলাকে বলল, ‘ওই, যা পানি নিয়া যায়। লুকটার মুখের উপরে ছিটা।’ দাঁতঅলা মুহূর্তের মধ্যে বাইরে থেকে পানি নিয়ে এল। তারপর লোকটার মুখের উপরে দিতেই তার গলা আমরা শুনতে পেলাম। সে সামান্য উঁ উঁ শব্দ করল প্রথমে। তারপর কোনোরকমে বলল ‘পানি পানি...’ তারপর কেঁদে উঠে বলল, ‘ছেড়ে দাও, প্লিজ, ছেড়ে দাও আমাকে।’

‘আহহারে, এত্ত সোজা? কইলেই ছাড়ন যায়? কাজ চলতেছে, অনেক ভাবনাচিন্তার বিষয়ও আছে, অপেক্ষা করতে হইব।’

‘টাকা কি তোমরা পাওনি?’

‘ওই চুপ। একদম চুপ। নাইলে আবার ইঞ্জেকশন দিমু বসাইয়া,’ মোচঅলা বলল।

‘দেওয়াই তো উচিত, নাইলে যদি আবার চিল্লায়?’ দাঁতঅলা বলল।

‘আরে এই জঙ্গলে চিল্লাইলেও কেউ শুনব না। আর চিল্লানির শক্তিও নাই এর। এখনই আবার ঘুমাইয়া পড়ব। তা ছাড়া, আবার ইঞ্জেকশন দিলে মইরা যাইতে পারে। আমরা মুশকিলে পড়ব তাইলে।’

তারপর ওই ঘর থেকে আর কোনো কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম না। লোকগুলো ওই ঘরে কী করছিল তাও বোঝা গেল না। একসময় আমাদের ঘরে এল। আমাদের দিকে তাকিয়ে এক হাতে ছুরিটা সোজা করে বলল, ‘সামান্য দূরে গিয়া ফোনগুলা কইরা আসি। এইবার কিছু উলটাপালটা হইলে ফির‍্যা আইসা এক্কেরে শ্যাষ কইরা দিমু।’ কথাটা বলতে বলতে আরেক হাতে নিজের শার্টটা উঠিয়ে দেখাল প্যান্টের মধ্যে একটা রিভলভার গুঁজে রাখা। আমি দেখেছি। আমার ধারণা, পাশ থেকে অনন্তও দেখেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল কিন্তু পানি চাওয়ার সাহস হলো না।

দাঁতঅলা দরজা লাগাতে লাগাতে বলল, ‘কুনো কতা কইবা না কিন্তু। ঘরের সামনেই খাড়াইয়া আছি। জোরে কতা শুনলে আইসা এক্কেরে ইঞ্জেকশনের ডবল ডোজ মাইরা দিমু।’

সত্যি সত্যি ইঞ্জেকশন না লাগালেও আমরা তখন প্রায় ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে তারা চলে যাবার কিছু পরে পাশের ঘর থেকে খুব আস্তে উহ্ আহ্ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর মনে হলো গুনগুন করে কাঁদছে লোকটা। বেশ খানিকক্ষণ মূর্তির মতো বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ নাভিদ বলে উঠল, ‘আংকেল, শুনতে পাচ্ছেন?’ তার গলা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। ভয় পেলাম কিন্তু মানা করলাম না। খানিক পরে আমি আর জিয়নও বললাম, ‘আংকেল, শুনতে পাচ্ছেন?’ ‘আংকেল, আপনি কি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন?’

ওদিকের ঘর থেকে কোনো উত্তর এল না। নাভিদ হঠাৎ বলল, ‘আপনি মরে গেলেন নাকি, ভাই? শুনতে পাচ্ছেন না?’ অনন্ত তখন গম্ভীর গলায় বলল, ‘চলো, ওই ঘরে আবার যাই। দেখে আসি।’

‘বলো কী, ওই লোকটা বলে গেল না যে সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে?’ জিয়ন ভয় পাওয়া গলায় বলল। অনন্ত বলল, ‘ফিরে এসে আমাদেরকে ওই ঘরে দেখলে কী আর বলবে, আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।’ আমি বললাম, ‘সেটাই ভালো, চলো আমরা ওই ঘরে যাই, লোকটার সঙ্গে কথা বলে আসি।’

যেই বলা সেই কাজ। আমার কেউ এগোতে, কেউ ঠেলতে শুরু করলাম। যেতে যেতে একসময় ওই ঘরের দরজা পেরোলাম। আমি ছিলাম লোকটার থেকে একেবারেই উলটো দিকে। তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর তার দিকে এগোতে এগোতে আমরা কিছুটা ঘুরে গেলাম আর তখনই হুট করে আমি তার মুখ দেখতে পেলাম। চমকে তাকালাম, আরে এনাকে তো আমি চিনি! কিন্তু উনি যেন কে তা কিছুতেই মনে পড়ল না।

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আছি দেখে পাশ থেকে অনন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী হলো এগোচ্ছ না কেন?’ আর তখন লোকটা সামান্য নড়ে উঠে চোখ টেনে খোলার চেষ্টা করল। তার গালের উপরে একটা কাটা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে শুকিয়ে আছে। চুলে ধুলা আর সারা গায়েও ময়লা আর এখানে ওখানে রক্ত। লোকগুলো নিশ্চয় তাকে অনেক মেরেছে।

লোকটার মুখটা তুলতে তুলতেও আবারো বুকের দিকে ঝুলে গেল। আমার মনে হচ্ছিল আর সামান্য একটু তুলে ধরে থাকলে আমি বুঝতে পারতাম লোকটা কে। নাভিদ ফিসফিস করে ডাকা শুরু করল, ‘ভাই, শোনেন, ও ভাই...’

লোকটা কোনোরকমে মাথা ওঠাল। চোখগুলো পুরো খুলল না। কিন্তু আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে খুলে গেল। এ কী! ইনি তো রবিন চৌধুরি, রবিন অ্যাপারেলসের মালিক, যাকে অফিসের সামনে থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল বেশ কয়েকদিন আগে... পেপারে তার ছবি উঠেছিল, আমি দেখেছিলাম... মানে, দাদু আমাকে দেখিয়েছিল!

(চলবে...)

আগের পর্ব

অলঙ্করণ: হ্যাডলি হোপার

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!