রহস্য উপন্যাস: অলীকের অভিযান, পর্ব ১

আফসানা বেগমআফসানা বেগম
Published : 1 Sept 2018, 12:48 PM
Updated : 1 Sept 2018, 12:59 PM

এক

ওই দূরে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে; যাচ্ছে যাচ্ছে যাচ্ছে... নেই! ওদিকের বিল্ডিঙের পিছনে চলে গেল। কী আর করা, পাখি কি জানে যে অলীক তাকে আকাশের এই মাথা থেকে ওই বাড়ির দেয়াল পর্যন্ত দেখছিল আর দেখছিলই?

চোখের উপরে নীল ফ্রেমের ভারি চশমাটা টাইট করে বসিয়ে অলীক পাখিটার পাখা নাড়ার কায়দাটা বোঝার চেষ্টা করছিল। দাদু বলেছিল, একটা পাখি, মানে, বাদুড়ের ডানা নাড়ানোর প্রত্যেকটা মুহূর্তের ছবি এঁকেছিল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। আর পাখির মতো উড়তে চেয়েছিল বলেই হয়ত রাইট ব্রাদার্স প্লেন আবিষ্কার করে ফেলেছিল।

অলীক অবাক হয়, নাহ্ প্লেন কী করে আবিষ্কার করা হয়েছিল, তা নিয়ে নয়। যাদের মাথায় যা আবিষ্কারের বুদ্ধি থাকে তারা নিশ্চয় তা করতেই পারে। অলীক অবাক হয় এই ভেবে যে একটা সময় পৃথিবীতে প্লেনই ছিল না? এই যে প্রতি বছর বাবা-মা একটা ছুটি পেলে অলীককে নিয়ে প্লেনে করে এখনে-ওখানে চলে যায়, তিন-চার ঘণ্টা পরে তারা দূরের কোনো দেশে গিয়ে হাজির হয়, এই দূরে মানুষ তবে যেত কী করে!

দাদু বলেছে, যেত না। কেউ অবশ্য যেত খুব দরকার পড়লে। নদী বা সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে কিংবা সামান্য কাছে হলে ঘোড়ায় চড়ে আবার পায়ে হেঁটেও। তারা নাকি মাসের পর মাস চলতে চলতে আরেকটা জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হতো। এটা ভাবলেই অলীকের ভীষণ হাসি পায়। মানে, একজন তার বাড়ি থেকে রওনা দিল, ধরা যাক তখন তার বয়স সতেরো বছর তিন মাস। তারপর যেখানে যাচ্ছে সেখানে যখন পৌঁছল তখন তার বয়স সতেরো বছর এগারো মাস হা হা হা... নিজের মনেই হেসে ওঠে অলীক। চলতে চলতেই আট মাস বয়স বেড়ে গেল! হা হা হা... অলীকের এই বারো বছর এগারো মাস বয়সের হিসেবে আট মাস সময় তো বিরাট ব্যাপার।

এখন অলীক ক্লাস সিক্সের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে। তার মানে হলো গিয়ে আট মাস আগে সে ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষাও দেয়নি। সে তো তখন একেবারেই পিচ্চি ছিল! হায় হায়, আর ওদিকে কিনা সেই যুগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একজন শুধু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই পিচ্চি থেকে বড়ো হয়ে গেল! হা হা হা...

‘আকাশের দিকে তাকাইয়া হাসেন ক্যান, ভাইয়া? দুধ দিছি, খাইয়া নেন গা,’ অলীকের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বুয়া বলে।

‘বুঝেছ, বুয়া, একটা মানুষ হাঁটতে হাঁটতেই না তার বয়স বেড়ে যায়! হা হা হা... মজা না?’

‘বয়স বাড়নের মইদ্দে মজার কী? বয়স বাড়লে অনেক কাম করতে অয়। আপনে রইদের মইদ্দে আর খাড়াইয়া থাকেন না য্যান, দুধ খান গিয়া।’

অলীক আবার ফাঁকা আকাশের ওই দিকটায় তাকায়। পাখিটা আর ফিরে আসে না। পাখিটা ওভাল শেপের অর্ধেকটার মতো বাঁকা একটা লাইন ধরে গিয়েছিল। অলীকদের ডাইনিং টেবিলটা ওভাল শেপের। অলীকের ধারণা ছিল পাখিটা আবার ফিরে আসবে আর সামান্য নিচ দিয়ে উড়বে যাতে আকাশে ডাইনিং টেবিলের ওভালের মতো পুরো একটা ওভাল শেপ তৈরি হয়। ওদিকের আকাশে যে একটা অদৃশ্য ওভাল ঝুলছে তা অলীক ছাড়া আর কেউ জানবে না। শুধু সে ওদিকে তাকালেই পাখির যাওয়া আর আসার রাস্তাটা দেখতে পাবে। কিন্তু ওদিকে রেকট্যাঙ্গেল শেপের বিল্ডিংগুলো দাঁড়িয়ে আছে কেবল।

পাখিটা নেই, তাই একের পর এক বিল্ডিং গাদাগাদি করে থাকাতেও ওদিকটা এখন ফাঁকা। গ্রিলের ফোঁকরে চেপে রাখা আঙুলগুলোকে অলীক সামান্য ঢিলে করে ফেলে, তাতে শরীরটা খানিক পিছনের দিকে চলে আসে। আঙুলের উপরে ভর দিয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, পাখিটা আর ফিরবে না জেনে গোঁড়ালিটা মাটিতে ঠেকায়। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে ডাইনিং রুমে চলে আসে। চেয়ার টেনে বসতে গেলেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হয়। বাবা বলেছে চেয়ার আস্তে টানতে। অলীক দাঁড়িয়ে চেয়ারটা আবারো টেবিলের নিচে পাঠায়। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে টেনে নিয়ে ধপ করে বসে পড়ে।

আজ গ্লাসে চুমুক দিয়ে দুধ না খেয়ে অন্যভাবে খেলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। টেবিলের পাশের ফার্নিচারের ড্রয়ারে মা স্ট্র রাখে। ড্রয়ার খুলে তিনটা স্ট্র নেয় অলীক। তারপর একটার প্রান্তে আরেকটাকে আটকালে অনেক লম্বা একটা স্ট্র হয়ে যায়। লম্বা স্ট্র গ্লাসের দুধে ডুবিয়ে অলীককে তাই চেয়ারের উপরে উঠে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়িয়ে নিয়ে চোঁ চোঁ করে টানতে থাকে থাকে। বুয়া কিছু হাতে নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ায়, ‘কত্ত সার্কাস যে দেখাইবেন, ভাইজান! যাউকগা, খাইলেই হইছে।’

দুধ শেষ হতে হতে মজাটাও শেষ। অলীক চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে আবার। এখন কী করবে? ছোটোবেলায় সে নাকি কিছু একটা করতে করতে মাকে সবসময় জিজ্ঞাসা করত, ‘মা, এরপর আমি কী করব?’ হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পরের ছুটির এই সময়টায় হয়েছে সেই এক যন্ত্রণা। বারবার অলীককে ভাবতে হচ্ছে এর পর সে কী করবে।

অলীকের এই ছুটিটাকে দাদু বলে আম-কাঁঠালের ছুটি। অলীক খুব অবাক হয়েছিল শুনে। আম-কাঁঠালের ছুটি আবার কী? দাদু বলেছিল, বছরের মাঝামাঝি এই সময়টাতে আম আর কাঁঠাল পাকে তো, তাই সবাই তখন গ্রামে যায়, গাছ থেকে আম আর কাঁঠাল পেড়ে খায়। সেই জন্যই এই ছুটি। অলীক অবশ্য শুনছিল যে গ্রামে দাদুর বাড়ি ছিল একসময়। পরে দাদুর বয়স বেড়ে গেল আর তিনি একা হয়ে গেলেন, তাই অলীকের বাবা তাকে জোর করে গ্রাম থেকে অলীকদের বাড়িতে এনে রেখেছেন। কিন্তু সে যাই হোক, শুধু আম-কাঁঠালেরই ছুটি কেন, তবে তরমুজের ছুটি, কলার ছুটি, আনারসের ছুটি, সেসবও থাকা উচিত ছিল। কেন নেই তা অলীকের জানা নেই। দাদু প্রায়ই অদ্ভুত সব কথা বলে। মা নিজের ঘরে গিয়ে হাসে, আর বাবা দাদুর সামনেই হাসে। অলীক না ধরতে পারে দাদুর কথা আর না বোঝে বাবা-মায়ের হাসির কারণ।

টেবিল থেকে উঠে পা টিপে টিপে সে যায় দাদুর ঘরের দিকে। ভিডিও গেমে হাত দেবার আগে দেখা দরকার দাদু ঘুমিয়ে আছে কি না। না হলে ওটা খোলাই সার, দাদু এসে খামোখা নানান গল্প শুরু করে দেবে আর অলীকের রেসের গাড়িটা যাবে উলটে কিংবা শুটার মানুষটার গায়ে গুলি লেগে গেমটাতে সে হেরে যাবে। দরজাটা সামান্য খুলতেই দাদুকে দেয়ালের দিকে ফিরে ঘুমাতে দেখা যায়। অলীক নিশ্চিন্ত হয়। দাদু ভোরে উঠে লম্বাসময় ছাদে হাঁটেন। ফিরে এসে নাস্তা করেন। নাস্তা শেষে চা নিয়ে বসে কয়েকটা পেপারের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পড়ে নেন। তারপর সটান হয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেন। কোনো ঝামেলা ছাড়া ভিডিও গেম খেলতে চাইলে অলীকের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।

 

দুই

অলীক নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা ধীরে ধীরে ভিড়িয়ে দেয়। তারপর প্লে-স্টেশনটা চালু করেই শব্দটা কমিয়ে দেয়। তার প্রিয় গেম, কল অফ ডিউটি শুরু হয়। শুধু মানুষ মারতে হবে ঠাই ঠাই ঠাই... মারতে মারতে জিততে পারলে খুব মজা লাগে অলীকের। আগে অবশ্য অলীক আরেকটা গেম খেলত, ব্যাটলফিল্ড। সেখানেও কেবল মারামারি। যুদ্ধ আর যুদ্ধ। দাদু দেখলে বলে, ‘এত মেরে কী হবে? যুদ্ধ কি ভালো? যুদ্ধ তো সবার জন্য ক্ষতি, যে লাগায় তারও, আবার যে লড়ে তারও। মাঝখান থেকে বহু নিরীহ মানুষ মরে যাদের কোনো অপরাধ ছিল না। তারা আক্রমণকারীকেও চায় না আবার তাকে ঠেকানোর শক্তিও থাকে না তাদের।’

অলীক অবশ্য দাদুর এই সমস্ত কথা শুনলে হাসে। দাদু যে কী একটা, গেমে মানুষ মারা কি সত্যি সত্যি মানুষ মারা নাকি? এ তো খেলা! সত্যি সত্যি অলীক ওরকম একটা শুটার মানুষকে রাস্তায় দেখলে অনেক ভয় পাবে, এটা সে ভালো করেই জানে; হাতে ওরকম একটা স্টেনগান আর কোমরে পিস্তল গোঁজা থাকলে তো কথাই নেই। বুয়া বলেছে ওরকম কাউকে দেখলে সে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ওটা শুনেও অলীক হেসেছিল, কেউ কি আগে থেকে বলতে পারে কী দেখে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে? মানুষ তো ইচ্ছে করলেই অজ্ঞান হতে পারে না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে অবশ্য দাদু খুশি। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কিছু ধারণা দেয়া হয়েছে গেমগুলোতে। আগেরটায় ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা আর পরেরটায় দ্বিতীয়। দাদু বলেছে, ‘যাক, শুধু শুধু গুলি করতে করতে হলেও, বিশ্বযুদ্ধের কথা কিছু তো জানলে! এটা ভালো।’

অলীক ভেবেছিল যে যুদ্ধ হয়ে গেছে, শেষও হয়েছে বহু বছর আগে, তার কথা জেনে কী লাভ! দাদু অলীকের কথা শুনে হেসেছিল, ‘আরে বোকা, আগের কথা না জানলে মানুষ সামনে এগোবে কী করে?’ দাদুর কথার মাথামুণ্ডু অলীক কিছুই ধরতে পারেনি। সামনে এগোনোর জন্য সামনে কী আছে তা না-হয় জানতে হবে কিন্তু তাই বলে আগে কি ছিল তা-ও? দাদু বলেছিল, ‘এর নাম হলো গিয়ে ইতিহাস। ইতিহাসই বলে দেয় ভবিষ্যতে আমাদের কী করা উচিত আর কোনটা করা যাবে না। আমাদের ভুলগুলো ইতিহাস থেকেই আমরা জানতে পারি।’ অলীক ঠোঁট উলটে ভেবেছিল, কে জানে হবে হয়ত। অলীক খেলার মধ্যে ঢুকে যায়। নাৎসি বাহিনীর একেকটা ক্যাম্পে ঢুকে ঢুকে গিয়ে নাৎসিদের মারতে হচ্ছে। বন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে হচ্ছে। মোটেও সোজা কাজ নয়। এদিকে নিজের গায়ে গুলি লাগার দুশ্চিন্তা তো আছেই। নাৎসিরা ভয়ানক। ধরতে পারলে কঠিন শাস্তি দিয়ে মারে।

অলীক আরো মনোযোগী হতে চেষ্টা করে। সামান্য ভুলও করা চলবে না। ধূসর দেয়ালগুলো টপকে টপকে অলীক নাৎসিদের খুঁজতে থাকে। মনের মধ্যে অবশ্য বরাবর ভয়টা লেগে থাকে যে দাদুর ঘুম ভেঙে গেলেই এসে গল্প শুরু করবেন যেন সে খেলতে না পারে। দাদুর অনুরোধের জ্বালায় একসময় অলীককে প্লে স্টেশনটা বন্ধই করে দিতে হবে। তার আগে যতটুকু খেলা যায়... কিন্তু অলীকের মাথায় কেন যেন দাদুর আসার ভয়ের মতোই দাদুর কথাটাও ঘুরতে থাকে, আসলেই তো, মানুষ যুদ্ধ করে কেন?

‘অলীক...’

‘এই তো, এখানে।’

ওহ্ নো.. দাদু ঘুম থেকে উঠে গেছে। আর হয়েছে খেলা। অলীক তবু তাড়াহুড়ো করে এলোপাথাড়ি কিছু গুলি ছুঁড়তে থাকে। এই লেভেলটাতে কিছুতেই হারা যাবে না।

‘অলীক, আবার ঠাস ঠুস করে গুলি ছুড়ছ, দাদুভাই?’

অলীক থামে না। এই লেভেলের মাঝখানে থামা যাবেও না। এখনো দুটো লাইফ আছে। উহ্ দাদু আরেকটু পরে ঘুম থেকে উঠতে পারত না? পুরোটা খেললে এবারের স্কোর খুব ভালো হবে। কিন্তু দাদু এসে পড়ে অলীকের ঘরে।

‘আরে ও, অলীক, কখন থেকে খেলছ, দাদুভাই? আমি যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

‘বেশিক্ষণ না দাদু, এই তো এক্ষুণই। দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি গেমটা শেষ করে নিই।’

‘আর কত মারবে, দাদুভাই? বন্ধ করো এবার। গুলির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। মনে হলো কোথায় যেন যুদ্ধ লেগে গেছে।’

‘লাগেনি লাগেনি। কিন্তু এখন থামা যাবে না, এখনো দুটো লাইফ বাকি আছে আমার।’

‘দুটো লাইফ?... আচ্ছা, দাদুভাই, তুমি কখনো ভেবেছ যে আমরা মাত্র একটা লাইফ নিয়ে এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াই?’

‘হুম? একটা লাইফ মাত্র!... ওহ্ নো... দিলে তো গেমটা শেষ করে। এত কথা যে কেন বলো খেলার মাঝখানে!’

‘আচ্ছা, শেষ হয়েছে হোক, পরে আবার খেলবে। এখন আমার সঙ্গে কথা বলো। ভেবে দেখেছ কখনো যে আমার আর তোমার মাত্র একটাই লাইফ আছে? শেষ হলেই শেষ? তা ছাড়া, হাতেও কোনো অস্ত্র নেই?’

অলীক গেম কন্ট্রোলারটা হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তারগুলো গুটিয়ে সেটা প্লে স্টেশনের পাশে রাখে। অদ্ভুত একটা ভাবনার ছায়া পড়ে তার মুখে। তারপর হাত দুটো দুদিকে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে দাদুর পাশে এসে বসে।

‘সেই তো, একটাই মাত্র লাইফ আবার অস্ত্রও নেই। তাহলে এখন কী হবে?’

‘তাহলে তোমার বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হবে অস্ত্রের মতো। আর লাইফ যেহেতু একটাই, তাই প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত যেন কাজে লাগে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।’

‘কিন্তু মরে গেলে যে আর লাইফ পাচ্ছ না!’ অলীক চিন্তায় পড়ে যায়।

‘নাহ্, কোনো আশা নেই। ভিডিও গেম এদিক দিয়ে বেশ ভালো, যাই বলো।’

অলীক হাসে। দাদুও। যাক্, কখনো তো দাদু স্বীকার করেছে যে ভিডিও গেম ভালো! দাদু তাকে কাছে টেনে নেয়। চশমা সরিয়ে দুই চোখে আদর দিয়ে বলে, ‘এই যে ছোট্ট চোখদুটো কেমন লালচে হয়ে গেছে, দেখেছ? চোখদুটো বলছে, আমাদের একটু রেস্ট দাও।’

‘তবে কি আমিও তোমার মতো এই সময়ে ঘুমাব?’

‘না না, তা কেন! চোখ কি শুধু ঘুমালে রেস্ট পায়?’

‘তবে?’

‘চোখ রেস্ট পায় সুন্দর কিছু দেখলে। ধরো, সবুজ দেখছ, মানে গাছপালা।’

‘ও, হ্যাঁ, আমি একটা পাখি দেখছিলাম। তারপর...’

‘তারপর কী?’

‘পাখিটা চলে গেল। কোথায় যে গেল! আমি ওর জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আর ফেরেনি। ওইদিকের বিল্ডিঙের পিছনে গিয়েই উধাও। রমনা পার্কের দিকে চলে গেছে বোধ হয়।’

‘মন খারাপ কোরো না, দাদুভাই। ও হয়ত ওর বাড়িতে ফিরে গেছে। বাড়িতে ওর নিশ্চয় বাবা-মা আছে, আমার মতো একটা দাদুভাইও থাকতে পারে।’

অলীক খিলখিল করে হাসে, ‘পাখির দাদুভাই আরেকটা পাখি। তার বাবা-মা, তারাও পাখি, তার বন্ধুরাও পাখি, কী মজা না?’

‘হুম, খুব মজা। চলো বারান্দায় গিয়ে আমরা আবার ওই পাখিটাকে খুঁজি। কে জানে, এতক্ষণে হয়ত সে আবার বেড়াতে বেরিয়েছে?’

 

তিন

বাবা-মা ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। মায়ের অফিস ছয়টায় শেষ। সেই থেকে রাস্তায় আসতে আসতে কয়েকবার ফোন চলতে থাকে, ‘অলীক, কী করছ এখন? আজ দুধ খেয়েছ? দুপুরে খাবার পরে রেস্ট নিয়েছিলে? সারাদিন ভিডিও গেম খেলনি তো? হোম-ওয়ার্ক করেছ?’ উত্তরে অলীকের হুম, হ্যাঁ, না চলতে থাকে। আর ফিরে এসে যেদিন বুয়ার কাছে রিপোর্ট পায় যে অলীক আজকে বেশিরভাগ সময়েই ভিডিও গেম খেলছিল, সেদিন বাবা-মায়ের মধ্যে একটা ঝগড়া লেগে যায়।

অলীককে মা কয়েকবার সাবধান করে, ‘চোখ নষ্ট হবে, এতক্ষণ খেলার কী হলো! আর কোনো কাজ ভালো লাগে না তোমার?’ অলীক চুপ। কখনো মিনমিন করে বলে, ‘কাল থেকে আর এত খেলব না, মা।’ ব্যস ওই বলা পর্যন্তই। তা বাবা-মাও জানে। তারপর তাদের বেডরুম থেকে শোনা যায় তর্কের আওয়াজ।

‘তখনই বলেছিলাম, ওই প্লে স্টেশনটা কিনে দেবার দরকার নেই,’ মা বলে বাবাকে।

‘আশ্চর্য, আমি কখন কিনে দিতে চাইলাম? তুমিই না বললে ফোন আর ট্যাবের ছোটো স্ক্রিনে চোখ-মাথা ব্যথা করবে বাচ্চাটার। তার চেয়ে বড়ো টিভির স্ক্রিনে খেলুক,’ বাবা মাকে মনে করিয়ে দেয়।

‘তুমিই তো নতুন টেকনলজি কিছু একটা বাজারে বেরোলেই তা না কিনে থাকতে পার না।’

‘আমি আমার ইচ্ছেয় কিনিনি। স্কুলের বন্ধুদের আছে, অলীক প্রতিদিন এসে বলত না? বাচ্চাটার মনটা ছোটো হয়ে যাবে তার নেই তার নেই ভাবতে ভাবতে। তা ছাড়া, আমার ছেলেটা পিছিয়েইবা থাকবে কেন।’

‘হয়েছে। খুব এগিয়েছে। এখন যে অ্যাডিকশন হয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠেকাও।’

‘অ্যাডিকশন? অ্যাডিকশন কোথায় দেখলে? বাবা তো বাড়িতে আছেন, অলীক নিশ্চয় তার সঙ্গে কিছু সময় কাটায়?’

এই কথার পরে মা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর স্বরটা খানিক নীচু করে আবারো শুরু।

‘তা আমি জানি না। তবে ওর যদি ভিডিও গেমে অ্যাডিকশন হয়, তবে তার জন্য তুমিই দায়ী থাকবে, বুঝলে?’

‘আশ্চর্য, আমি কেন দায়ী হতে যাব! এসব গেম তো আর আমি আবিষ্কার করিনি। আর এটা তুমি স্বীকার করবেই যে আজেবাজে কাজে ব্যস্ত থাকার চেয়ে বাচ্চারা গেমের মধ্যে ব্যস্ত থাকলে ভালো।’

‘ভালো মানে? তুমি জানো, আমেরিকায় টিনেজ একটা ছেলেকে খেলতে দিচ্ছিল না বলে সে তার মাকে মারার জন্য রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে ধাওয়া করেছে? অ্যাডিকশনের তুমি দেখেছ কী!’

এরপর বাবা চুপ। অলীক তার নিজের ঘরে ভেজানো দরজার পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দাদু পা টিপে টিপে অলীকের ঘরে আসেন। মাথার চুলে আঙুল ঢুকিয়ে আদর করেন। অলীক অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকায়। সে ভেবেছিল আজ বাবা-মায়ের মেজাজ খারাপের কারণে সে শুধু বকাই খাবে। উলটো যা হয়, দাদু তাকে জড়িয়ে ধরে, তারপর হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। অলীক অপরাধীর মতো মাথা কোলের দিকে রেখে বসে থাকে। দাদু খেতে বললেও খায় না। বাবা-মা এসে দুদিকের চেয়ারে বসে। অলীককে পুরোপুরি চমকে দিয়ে মা মজা করার মতো গলায় বলে ওঠে,‘অলীক, বলো তো আজ কত তারিখ?’

‘আজকে... সেভেনটিন।’

‘সেভেনটিন অফ হুইচ মান্থ?’

‘মা যে কী, মাসটাও জানো না? এটা জুলাই মাস, জুলাই।’

‘আর জুলাই মাসে আমাদের কী যেন একটা সেলিব্রেশন আছে?’

‘জুলাই মাসে...’ ভাবতে ভাবতে মুখের খাবার তাড়াতাড়ি গিলে ফেলে অলীক চিৎকার করে ওঠে, ‘আমার জন্মদিন!’

‘ইয়ে... য়ে...’

খেতে খেতে সবাই হাত-পা নাড়ে। অলীকের বাবা টেবিলে গ্লাস ঠুকে অলীকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ইয়োর অনার, এবারের জন্মদিনে আপনার জন্য আমরা কী করতে পারি?’

অলীক হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। দাদু জানতে চায়, ‘কী অলীক, বাবাকে বলে দাও, জন্মদিনে কী চাও?’

অলীক বলে, ‘হয়েছে কী দাদু, এখন আর আমার বন্ধুবান্ধব ডেকে কেক কাটতে ভালো লাগে না। মানে আমি বড়ো হয়ে গেছি না?’

‘ওরে বাবা, এত্ত বড়ো হয়ে গেলি নাকি রে তুই?’ বাবা চোখ বড়ো বড়ো করে অলীকের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তা, জন্মদিনে এখন আপনার কী ভালো লাগে, জনাব?’

‘এই বাড়িতেই আর কী, ধরো, মা আমার জন্য একটা কেক বানাল আর বাবা একটা গিফট কিনে আনল।’

‘আর আমি?’ দাদু জানতে চায়।

‘তুমি আর কী করবে, তুমি তো সিনিয়ার সিটিজেন।’

‘তুই আমাকে বুড়ো বললি, তাই না? বল, বললি কি না?’

দাদুর কথায় অলীক খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসি থামলে বাবা বলে, ‘তা, কী গিফট চাও বলো তো?’

‘গিফট দিতে পার একটা নতুন ভিডিও গে...’

‘অলী... ক!’ একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে বাবা-মা আর দাদু।

অলীকের খিলখিল হাসি আরো বাড়ে।

 

চার

জন্মদিন আসলে কেমন যেন একটা দিন! মনে মনে যতই বড়ো হবার কথা ভাবা যাক না কেন, জন্মদিন আসতে আসতে আবারো একটু ছোটো হতে ইচ্ছে করে। না, মত বদলে লোকজনকে ডাকতে বলবে না অলীক, আবার বড়োসড়ো কেকও কাটতে চাইবে না। কেক কাটা, বেলুন ফোলানো, বাঁশি বাজানো, এসব খুবই বাচ্চাদের ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু বিকেল নাগাদ অস্থির লাগতে থাকে। মা-বাবা কেন এখনো আসছে না? খালামণিরাও তো কেউ চলে আসতে পারে!

অলীক কাউকে দাওয়াত দিতে মানা করেছে বলে কি তারা সবাই একসঙ্গে তার জন্মদিন ভুলে যাবে? এমনকি ঘরের মধ্যে দাদুও অলীকের সামনে ঘুরছে ফিরছে কিন্তু একবারও বলছে না তার জন্য কোনো বার্থডে গিফট এনেছে কি না, আনলে সেটা কী। সকালে নাস্তার টেবিলে যদিও তারা সবাই তাকে আদর করে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলেছে, কিন্তু তবু এখন এই অস্থিরতা অলীকের ভালো লাগে না। এতই খারাপ লাগে যে ভিডিও গেমে একের পর এক লেভেলে সে হেরে যায়। দাদুর কাছে বলে কয়ে ঠিক এক ঘণ্টা খেলবে বলে ঘরে এসে দরজা ভিড়িয়েছিল। কিন্তু এক ঘণ্টায় কয়েকবার হারতে হয় তাকে। শেষে কন্ট্রোলারটা টেবিলে রেখে দাদুর কাছেই চলে যায় আবার।

‘কী, অলীক বাবু, স্কোর ভালো হয়নি?’ গোমড়া মুখ দেখে দাদু জানতে চায়।

অলীক জোর করে মুখে হাসি হাসি ভাব আনার চেষ্টা করে। দাদু বিছানায় শুয়ে ছিলেন। উঠে বসে অলীককে টেনে নেন কাছে, হাত ধরে বলেন, ‘কী হয়েছে দাদুভাই?’

‘তোমার মনে হয় না বাবা-মা আজকে অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি করছে?’ বলতে বলতে গাল খানিক ফুলে যায় অলীকের।

দাদু দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নেয়; বলে, ‘কই, না তো! এত তাড়াতাড়ি তো তারা কখনো আসে না। বাবা-মায়ের জন্য মন খারাপ করছে?’

‘না, মানে অন্য কেউ তো আসতে পারে, এই যেমন মনে করো সিনথিয়া খালামণি বা বড়ো খালামণি?’

‘তাই বলো,’ দাদুর হাসি চাপতে কষ্ট হয়। তবু কষ্ট করে চেপে নিয়ে বলে, ‘তা, চলো দেখি আমরা তাদের ফোন করে জিজ্ঞাসা করি যে তারা কেন এখনো আসছে না?’

‘না না...,’ অলীক চিৎকার করে ওঠে।

‘কাউকে কিছু বলতে হবে না। কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না,’ বলতে বলতে অলীকের কান্না পেয়ে যায়। সে কি এমনই একজন যে তার জন্মদিনের কথা কারো মনেই থাকবে না? অলীক জানে তার কান্না কান্না গলা শুনলে দাদু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু দাদু কেন যেন সাইড টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে নাকের উপরে বসায়, আর তারপর বিছানার উপরে উপুড় করে বুকমার্ক রাখা বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। বিছানায় তার পাশে অলীকের বসে থাকার ব্যাপারটা দাদু যেন ভুলেই যায়। অলীকের এবারে জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কান্না ঠেকাতে সে ছুটে চলে যায় বারান্দায়।

রমনা পার্কের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। বিকেলে ওদিকে কী হয়? পাখিদের সম্মিলন? তাদের একেকজন কি একেকদিন বক্তৃতা করে? শুনুন ভাইসব... বারান্দায় পড়ে থাকা একটা পেপার মুড়িয়ে অলীক মুখের সামনে ধরে, ‘অ্যাই পাখি, তুমি কি ওই ঝাঁকের মধ্যে আছ? কাল যে আর এলে না? তোমরা এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাও?’

বুয়া পিছনে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসে, ‘পাখিদের সাতে কী কথা কন, ভাইজান? হ্যারা কি আপনের কতা বুঝব?’

‘বুঝবে কি না সেটা পাখিদের ব্যাপার। বুঝবে না কেন?’

‘হ বুজছে। জবাব দিসে আপনেরে? কই যায় তারা?’

অলীক চিন্তায় পড়ে যায়। বুয়া বলে, ‘অগোর লগে এইগুলা কইরা লাভ নাই। তয় একখান কতা আছে। আইজ রাইতে জব্বর মজা হইব।’

‘কী মজা?’

‘হেইডা কওন যাইব না। কিন্তু প্যাটের মইদ্দে খকরমকর করে, এট্টুক না কইয়া থাকনও যায় না।’

‘তাহলে বলো না...’

‘হইছে কি, আইজকা রাইতে এত্ত প্যালেট-বাসন লাগব যে আমি খালি ধুইতেই আছি আর ধুইতেই আছি, কারণ রাইতে হইল গিয়া...’

দাদু এসে তাদের মাঝখানে দাঁড়াতেই বুয়া চুপ। তারপর বাসার ভিতরের দিকে এক দৌড়। অলীকের কেমন যেন সন্দেহ হয়। রাতে কীসের মজা? আর দাদু আসতেই বুয়াকে পালিয়ে যেতে হলো কেন? অলীক দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকে। দাদু কেন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে রমনা পার্কের দিকে ইশারা করে বলে, ‘একদিন সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে চড়ুইদের মেলা দেখতে যাবে, দাদুভাই? ওই যে ওই পার্কে ফ্লাড লাইটের নীচে সন্ধ্যায় চড়ুইদের মেলা হয়।’

‘ধ্যাৎ, ওখানে শুধু বৈশাখি মেলা হয়।’

‘সে তো বছরে একবার। কিন্তু চড়ুইদের মেলা হয় প্রতিদিন সন্ধ্যায়।’

‘সম্মিলন! চলো তাহলে যাই?’

‘আজ না। আরেকদিন।’

‘আজ না কেন?’

‘বললাম তো, আজ না।’

অলীকের সন্দেহ বাড়ে। আজ কী, হুম? সন্ধ্যা প্রায় হয়েই আসছে। চারদিকে ছায়া ছায়া হয়ে গেছে। অলীক জানে চোখের সামনে এখন রমনা পার্কের গাছগুলো সবুজ থেকে গাঢ় সবুজ হয়ে যাবে আর তারপর কালোমতো হয়ে হারিয়ে যাবে। সকাল বেলা আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালে মনে হবে আকাশ থেকে সে মাটিতে নামছে আর হঠাৎ করে গাছপালা ঘেরা জায়গাটা চোখের সামনে ঝকঝকে হয়ে ভেসে উঠবে। কিন্তু তবু প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবকিছুকে কালো হতে হতে উধাও হতে দেখতে অলীকের মোটেও ভালো লাগে না। আজ তো আরো বেশি খারাপ লাগছে, জন্মদিনটা চলেই গেল!

মনমরা অলীক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর কোমর জড়িয়ে ধরে। দাদু তার মাথায় হাত রাখে, ‘কিছু বলবে, দাদুভাই?’

‘তুমি যে রাস্তায় আমার মতো কতকগুলো ছেলেমেয়ে দেখিয়েছিলে না, যাদের বাবা নেই, বাড়ি নেই, বই-খাতা নেই, ভিডিও গেম... আচ্ছা, তাদের তো জন্মদিনও নেই, তাই না?’

‘মনটা খারাপ, দাদুভাই? একদিন আমরা তাদের জন্য গিফট নিয়ে যাব, কেমন? আমরা তো আর জানি না যে কবে তাদের জন্মদিন, তাই যেদিন ইচ্ছে গিফট দিতে পারি।’

দাদুর কথায় অলীক মাথা নাড়ে কিন্তু সত্যি সত্যিই তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে তার কি মন খারাপ নিজের জন্য নাকি রাস্তার ফুটপাথে শুয়ে-বসে থাকা ওই বাচ্চাগুলোর জন্য? মনে মনে ভাবতে চায়, তাদের জন্যই হবে। দাদু বলে, ‘সন্ধ্যা হলো, অলীক, চলো ঘরে যাই।’ আর তখনই দরজার বেল বেজে ওঠে। বারান্দা থেকে দেখতে না পেলেও কেন যেন মনে হয় একসঙ্গে অনেক মানুষ ঢুকে যাচ্ছে বাড়িতে। অলীক ছুটে বসার ঘরের দিকে যায়। তারপর হা করে তাকিয়ে দেখে, এ কী! বাবা-মা, খালামণিরা, তাদের বাচ্চারা, বাবার বন্ধুরা, একে একে সবাই ঢুকে পড়ছে। তাদের কারো হাতে কেক, কারো হাতে অনেকগুলো বলপ্রিন্টের বেলুন, কারো হাতে র‌্যাপিং পেপার প্যাঁচানো গিফট। ঢুকতেই সবাই হইচই শুরু করে দেয়।

অলীক কিছুক্ষণ আগের মন খারাপ করার কথা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যায়। বাবা-মাসহ সবাই একসঙ্গে গান গেয়ে ওঠে, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু ডিয়ার অলীক... দাদু ভাই কখন যেন অলীকের পাশ থেকে সরে গিয়ে তাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পিছনে বুয়াও দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগে। এমন হয় নাকি যে তুমি যা চাচ্ছ তাই হুট করে পেয়ে গেলে?

অলীক গিফটের ভারে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। খেলনা, বই, কাপড় আরো কত্ত কী! বড়ো মামা সবচেয়ে ভালো, একটা নতুন ভিডিও গেমের কার্ড অলীকের হাতে ধরিয়ে দেয়। সব গিফট যখন খোলা শেষ, অলীককে চমকে দেয়ার মজাও অনেকটা শান্ত, তখন সবাই বসার ঘরে বসে। নিজেদের মধ্যে গল্প করে। তাদের দেখে অলীকের অবাক হওয়া চোখ-মুখ নিয়ে হাসাহাসি করে। সিনথিয়া খালামণি বলে, ‘কী রে তুই নাকি অনেক বড়ো হয়ে গেছিস? কেক-টেক, বার্থডে পার্টি তোর আর ভালো লাগে না? তা এখন কেমন লাগছে?’ অলীক লজ্জা পেয়ে হাসে। এরওর নানান দুষ্টুমির মাঝখানে দাদু যোগ করে, ‘ভাগ্যিস তোমরা বেশি দেরি করোনি, আরেকটু হলে কান্নাটা যে আমি কী করে সামলাতাম কে জানে।’ দাদুর কথা শুনে অলীক ক্ষেপে যায়, ‘আমি কাঁদলাম কখন? আশ্চর্য।’ দাদুও মুখে ভেংচি কেটে বলে, ‘তা আমিইবা সে কথা কখন বললাম!’

বাকিদের হাসাহাসির মাঝখানে দাদু উঠে নিজের ঘরে যায়। বাবা-মা বাইরে থেকে আনা খাবারের প্যাকেট আর কেক টেবিলে রাখে। বুয়া প্লেট-গ্লাস টেবিলে আনতে থাকে, বলে, ‘সারাদিন কইতেও পারি না, আর আগ থেইকা রেডি কইরাও রাখতে পারি না। তাই এখন দেরি হইতেছে।’ মা তাকে বলে, ‘দেরি হলে অসুবিধা নেই। কিন্তু বলতে না পারার জন্য তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে, সেটা বুঝতে পারছি।’ বুয়া বলে, ‘তা ঠিক, খালাম্মা। সারপ্রাইস যে কন আপনেরা, হেইডা দেওন বড়ো কষ্টের।’

টেবিলের পাশে দাদু এসে দাঁড়ায়, ‘আরেকটু হলে তো হয়েছিলই, আমি এসে পড়াতে মুখ বন্ধ হয়েছে।’ মা দাদুর দিকে তাকিয়ে হাসে। দাদু পকেট থেকে সরু আর লম্বা একটা বাকসো বের করে অলীকের দিকে বাড়ায়। বাকসোটা লাল র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো, উপরে সোনালি ফিতে দিয়ে বাঁধা। অলীক বলে, ‘এরকম সাইজের বাকসে কী থাকে, দাদু?’

‘খুলেই দেখ না, দাদুভাই। তোমাকে জন্মদিনে দেবো বলে ক’দিন আগে পছন্দ করে কিনেছি। দেখ তো তোমার পছন্দ হয় কি না?’

অলীক র‌্যাপিং পেপারটা খুলে ফেলে। শক্ত বাকসোর ঢাকনাটা উপরের দিকে ঠেলতেই দেখা যায় একটা চকচকে লাল কলম। অলীক বুঝতে না পেরে দাদুর দিকে তাকায়, ‘কলম!’

‘হুম, কলম। তোমার জন্য।’

‘আমি কলম দিয়ে কী করব?’

‘তুমি লিখবে। কাহিনি লিখবে। ধরো, অভিযানের কাহিনি।’

‘আমি তো বারান্দার বাইরে কোথাও যেতে পারি না, তাহলে অভিযান হবে কী করে?’

‘মনে মনে হবে। আর কাগজের উপরে এই কলম দিয়ে তুমি সেটা লিখবে।’

অলীক বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে। বাবা তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘বাবা, তুমি যে কি না, এত দামি একটা শেফার্স পেন দিয়ে ও কী করবে? ওর তো একটা বলপেন হলেই চলে। আর দুদিন পরপরই স্কুলে কলম বা পেনসিল হারিয়ে আসে।’

‘অলীক এটা দিয়ে লিখবে, দেখিস, বাড়িতে বসে লিখবে।’

‘বাবা, তুমি যে কী মনে করো আজকালকার বাচ্চাদের, ওরা আর এখন কাগজ-কলমে লেখে নাকি তেমন? খালি খালি পয়সা নষ্ট।’

বাবা মনে হয় দাদুর উপরে একটু রাগই করে। বাবার রাগের কারণ অলীক তেমন বোঝে না, আবার কলমটা দিয়ে যে সে কী করবে সেটাও ঠিকমতো জানে না। তবে লাল টুকটুকে ঢাকনাওলা কলমটা কেন যেন এক দেখাতেই বড়ো ভালো লেগে যায় তার। মনে হয় আশেপাশে ছড়ানো জমজমাট গিফটগুলোর থেকে ওটা অনেক আলাদা। কলমটা দুই আঙুলে ধরে চোখের কাছে নিতেই তাতে আলো পড়ে ঝকমক করে ওঠে। অলীকের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাসি হাসি মুখ করে সে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘থ্যাংক ইউ, দাদু!’ বাবার বকায় দাদুর মুখে যে থতমত ভাব ছিল তা কাটিয়ে তিনি অলীককে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুমু খান।

খাওয়া-দাওয়া হইহল্লা শেষ হলে মেহমানরা চলে যায়। বাড়িটা আবারো আগের মতো নীরব হয়। অলীক গিফটগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। কোনোকোনোটার প্যাকেটও এত সুন্দর যে ফেলতে ইচ্ছে করে না। রঙিন আর জরিওলা দুটো ফিতে অলীক যত্ন করে পেঁচিয়ে ড্রয়ারের এক কোণে রেখে দেয়। মা এসে ঘুমানোর তাগাদা দিয়ে চলে যায়। অলীক সব রেখে হাতে দাদুর দেয়া কলমটা নিয়ে বিছানায় যায়। ঘরের বাতি নিবিয়ে দিলেও জানালা দিয়ে বাইরের কিছু আলো আসে। কলমটা চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে এক জায়গায় হঠাৎ আঙুলে কেমন যেন খরখরে মনে হয়। মসৃণ কলমের গায়ে কিছুটা জায়গা জুড়ে গর্তমতো লাইন অলীককে চিন্তায় ফেলে। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে যায় সে। দরজাটা কোনোরকমে ভিড়িয়ে বাতি জ্বালে। আর কলমের গায়ে আলো পড়তেই চমকে ওঠে। এ কী! এ তো অলীকের নাম! কলমের চকচকে লাল শরীরে যেন পিনের মতো কলম দিয়ে খোদাই করে লেখা, AULEEK.

খোদাই করা লাইনগুলোর ভিতরে রূপালি রং দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দোকানের একটা কলমে কী করে তার নাম লেখা থাকতে পারে, হাজার ভেবেও সে কোনো কূলকিনারা পায় না। অক্ষরগুলো বইয়ের লেখার মতো সোজা সোজা নয়, প্যাঁচানো লেখা, বাবা যাকে বলে কার্সিভ রাইটিং। অলীক মুগ্ধ হয়ে নিজের নামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে খাবার ঘরে কারো আসার শব্দ পাওয়া যায়। অলীক তাড়াতাড়ি বাতি নিবিয়ে দেয়। এত রাতে জেগে আছে জানলে মা খামোখা চেঁচামেচি করবে। খাবার ঘরের শব্দ থেমে গেলে অলীক ধীরে ধীরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে দাদুর ঘরের দিকে যায়।

দাদু ঘুমিয়ে আছে কি না বোঝা যায় না। কিন্তু সেসব কিছু না ভেবেই অলীক মশারি উঠিয়ে তার ভিতরে নিজের মাথা গলিয়ে দেয়।

দাদু মনে হয় জেগেই ছিল। কপাল থেকে হাত সরিয়ে অলীকের দিকে তাকায়, অলীককে এত রাতে আসতে দেখে একটুও অবাক হয় না। আবছা আলোয় অলীক দাদুর একটা হাত টেনে নিয়ে আঙুল দিয়ে কলমের নাম লেখা জায়গাটা স্পর্শ করায়। ফিস ফিস করে বলে, ‘জানো, এখানে আমার নাম লেখা আছে?’

‘তাই নাকি!’ বিস্ময়ের ভাব ধরে রেখে দাদুও অলীকের মতো ফিস ফিস করে উত্তর দেয়।

‘হুম! কিন্তু কী করে? মানে, ওই লোকটা কী করে আমার নাম জানল?’

‘কোন লোকটা?’

‘যে কলমটা বিক্রি করেছে।’

‘বুঝতে পারছি না, কী করে জানল!’

‘আর কলমের গায়ে অত ছোটো করে লিখলইবা কী করে?’

‘জানি না।’

‘আগে কখনো তুমি কারো নাম লেখা কলম দেখেছ?’

‘না তো!’

‘তবে কি লোকটা ম্যাজিক জানে?’

‘হুম, তাই হবে।’

‘কিন্তু আমার নামই লিখতে গেল কেন?’

‘কারণ, মনে হয় ওই কলমটা দিয়ে শুধু তোমাকেই লিখতে হবে।’

(চলবে...)

অলঙ্করণ: হ্যাডলি হোপার

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!