রহস্য উপন্যাস: অলীকের অভিযান, পর্ব ২

আফসানা বেগমআফসানা বেগম
Published : 7 Sept 2018, 06:49 AM
Updated : 7 Sept 2018, 06:50 AM

পাঁচ

দাদুর কথাটা অলীকের খুব পছন্দ হয়। যার যার কলম তার তার নামে আগে থেকেই ঠিক করা, ব্যাপারটা মজার। তার মানে ওই কলমওলা জানে যে অলীক লিখতে পারবে। কিন্তু অলীক তো জানে যে সে কিছুই লিখতে পারে না।

তাহলে? অলীক পারে ভিডিও গেম খেলতে। বন্ধুদের মধ্যে তার মতো স্কোর আর কেউ ওঠাতে পারে না। তারা যেন হারার জন্যই অলীকের সঙ্গে খেলে। কিন্তু অলীক জানে না এছাড়া অন্য কী সে পারে? আর দাদু একটা কলম এনে দিলেই হলো, সেকি ভিডিওগেম খেলা বাদ দিয়ে কাহিনি লেখা শুরু করে দেবে? মানে, চাইলেই পারবে?

বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গালে হাত রেখে অলীক এইসমস্ত কথা ভাবছিল। দাদু ছাদে হাঁটাহাঁটি শেষ করে ফিরে এসে হাঁক দেয়, ‘কই, অলীকবাবু? নাস্তা খেতে চলে আসো তো দেখি...’অলীক হেলে দুলে খাবার টেবিলের দিকে আসে। দাদু বলে, ‘কী ব্যাপার? রাতে ঘুম হয়নি বুঝি?’ আসলেই অলীকের রাতে ঘুম হয়নি ঠিকমতো। পাশ ফিরতে গিয়ে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। আর যতবার ভাঙছিল ততবারই হাতের মুঠিতে চেপে ধরছিল কলমটা। এলোমেলো ভাবনাও এসে জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কয়েকবার। পরেরবার জাগার পরে আগের ভাবনাটা আর মনে করতে পারেনি। তাই সিদ্ধান্তও নেয়া হয়নি যে কলম দিয়ে মানুষ কী লেখে।

‘কী হলো, খাচ্ছ না যে? শরীর খারাপ?’ খেতে খেতে দাদু জানতে চায়। অলীক দুদিকে মাথা দোলায়। ‘তবে কি, মন খারাপ?’ দাদু নাছোড়বান্দা। অলীক আবারো দুদিকে মাথা দোলায়। কিছুক্ষণ চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। শেষে দুম করে জানতে চায়, ‘আচ্ছা, দাদু, কলম দিয়ে মানুষ কী লেখে?’ দাদু মনে মনে হাসে। আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেয়। অলীকের উত্তেজনা বাড়তে থাকে। উত্তরের অপেক্ষায় সে একটানা তাকিয়ে থাকে দাদুর দিকে।

হাতের কাপ নামিয়ে রেখে দাদু উত্তর দেয়, ‘সে মানুষ চাইলে কী না লিখতে পারে! এই ধরো, তোমার বইয়ে যেসব গল্প-কবিতা আছে সেসব তো নিশ্চয় কখনো কলম দিয়ে মানুষ কাগজে লিখেছিল। আবার ধরো, এই যে পেপার পড়ছি, এর কত খবরও মানুষ লিখেছিল কলম দিয়ে!’ দাদু টেবিলে রাখা পেপারটা উঁচু করে ধরে অলীককে দেখায়, ‘তারপর ধরো, ভ্রমণ কাহিনি, অভিযানের কাহিনি, কত্ত কী যে লিখতে পারে মানুষ!’ অলীক হা করে তাকিয়ে থাকে দাদুর দিকে। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘তুমি কখনো লিখেছিলে নাকি?’

‘নাহ্ দাদুভাই। কী করে লিখব, আমাকে কেউ কখনো কলম এনে দেয়নি যে! আর কোনো কলমে আমার নামও লেখা ছিল না।’

‘কিন্তু তুমি কি কখনো অভিযানে যাওনি?’

‘তুমি যখন বড়ো হবে তখন দেখবে যে জীবনটাই একটা অভিযান। কত্ত রহস্য যে আছে জীবনে! এই ধরো, কাল কী হবে তা আমরা আজ বলতে পারি না; রহস্য না?’

‘হুম। কিন্তু অনেককিছুই তো আমরা আগে থেকে বলতে পারি, যেমন ধরো, আর দশ দিন পরে আমার স্কুল খুলবে।’

‘আহা, ছুটি শেষ হবার ভয়ে আছ বুঝি? দশ দিন তো অনেক সময়। দশ দিনে একটা আস্ত অভিযান হয়ে যেতে পারে।’

‘কী করে?’

‘কলম দিয়ে লিখে, আর কী করে?’

দাদু অন্যমনষ্কভাবে মুখের সামনে পেপার মেলে ধরে। যেন কথা বন্ধ করে অলীককে ভাবনার জন্য খানিক সময় দিতে চায়। দাদুর মুখ ঢেকে গেলে অলীকের চোখ চলে যায় বারান্দার দিকে। গ্রিলের ফোঁকরে দুটো চড়ুই এসে বসেছে। তারা নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে। তাদের কথা কেউ বুঝতে পারছে না, কিন্তু তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অলীক যদি কিছু লিখেই ফেলে আর তা অনেক মানুষ না-ও বোঝে, শুধু অলীকের মতো মানুষেরা বোঝে, তাতেই তো হয়!

কড়মড় শব্দে পেপারটা মুড়ে রেখে দাদু বলে ওঠে, ‘আমি কখনো অভিযানের গল্প লিখিনি, কিন্তু অনেকবার অভিযানে গেছি, বুঝেছ?’ অলীকের ভাবনার মাঝখানে দাদুকে কথা বলতে দেখে মনে হয় দাদু যেন অলীককে চুপিচুপি লক্ষ করছিল। অলীকও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘তাই নাকি? কী করে?’

‘আমার বাড়ির পাশেই ছিল কয়েকটা টিলা। আর সেদিকটা একেবারেই জঙ্গল। গাছের ডাল ভাঙা একটা লাঠি হাতে নিয়ে আমি সকাল সকাল জঙ্গলে ঢুকে যেতাম।’

‘লাঠি হাতে কেন?’

‘ওমা, না হলে এগোব কী করে? ওটা দিয়ে ঝোপঝাঁড় সরিয়ে সামনে যেতে হতো। আবার ধরো কেউ আমাকে ধরে ফেলতে চাইল, তখন ওই লাঠিটাই হবে আমার অস্ত্র।’

‘মানে, উইপন? ভিডিও গেমের মতো?’ অলীকের চোখেমুখে উত্তেজনা।

‘হ্যাঁ রে বাবা, উইপন।’

অলীক বোঝে যে অভিযানের গল্পের মাঝখানে ফট করে ভিডিও গেমের কথা বলাতে দাদু বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু কী করবে, তাকে বেশিরভাগ জিনিসই বুঝতে হয় ভিডিওগেমের ভিতর দিয়ে। যা হোক, কথা সামলে অলীক জানতে চায়, ‘জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে কী দেখতে?’

‘কত্তকিছু দেখতাম! কোথাও বনবিড়ালের বাচ্চা হয়েছে, গাছের ফোকরে লুকিয়ে রেখেছে, কোথাও দুটো বানর হয়ত সারাদিন ধরে অমার পিছনে পিছনে হাঁটল। মানে, আমি চললে চলে আর আমি থামলেই দাঁড়িয়ে পড়ে।’

‘সারাদিন জঙ্গলে থাকতে? মা খুঁজত না?’

‘খুঁজত। জঙ্গলের ধারে গিয়ে চিৎকার দিয়ে ডাকত। কোনোদিন বনবিড়ালের একটা বাচ্চা হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মা বকত, দিয়ে আসতে বলত, বলত ওইটুকু বাচ্চা মা ছাড়া বাঁচে না।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী, খাওয়ানোর চেষ্টা করেও খাওয়াতে না পারলে, মায়ের বকুনিতে জঙ্গলের পথ চিনে চিনে আবার ফেরত দিয়ে আসতে হতো বাচ্চাটাকে।’

অলীক দাদুর গল্প শুনতে শুনতে জানালার বাইরে তাকায়। সাদা মেঘগুলো রোদের মধ্যে তুলোর মতো লাগছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মেঘের নকশাটা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। মেঘগুলো যেন ফাঁকা আকাশে পথ খুঁজে খুঁজে সামনে এগোচ্ছে। অলীকের হঠাৎ নিজেকে হালকা লাগে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, সে-ও যেন তাদের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে। দাদু হঠাৎ বলে, ‘কী অলীকবাবু, কিছু ভাবছ নাকি?’ অলীক চমকে ওঠে, ‘দাদু, জানো, আমার কেন যেন হঠাৎ মনে হলো আমি ওই যে ওই মেঘটার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছ? ওই যে ওইটা।’

‘হুম, এটাকেই তো বলে কল্পনা। তুমি বসে আছ চেয়ারে কিন্তু মনে মনে চলে গেছ মেঘের উপরে।’

অলীক দাদুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তো তবে কল্পনায় অনেক দূরে চলে যেতে পারে! চাইলে যে কোনা জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারে। এসে আবার যেতে পারে। তারপর চলে যেতে পারে আরেকখানে। কী মজা! আর এসব করার জন্য তাকে ঘর থেকে মোটেও বেরোতে হবে না। অদ্ভুত তো!

অলীক নিজের ঘরে যায়। পড়ার টেবিলের উপরে কলমের বাকসোটা রাখা। অলীক ঠাস করে বাকসোটা খোলে, লাল টুকটুকে কলমটা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অলীক হাতে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে তাকে আদর করে। তারপর চেয়ারে বসে পড়ে। উপরের তাক থেকে গত বছরে স্কুলে শেষ না হওয়া একটা খাতা টেনে নামায়। এখনো অনেকগুলো পাতা বাকি আছে। অলীক প্রথম ফাঁকা পাতাটায় লিখতে শুরু করে।

 

ছয়

সেদিন স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে আমরা সবাই মন খারাপ করে বসে ছিলাম। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল বলে টিচার মাঠে যেতে মানা করেছিলেন। কিন্তু ওরকম বৃষ্টিতে মানুষ চাইলেই খেলতে পারে। আসলে ওরকম বৃষ্টিতে কয়েকটা ছুট দিয়ে এলেও কারো স্কুলের শার্ট ভিজবে না। খুব বেশি হলে নীল শার্টের উপরে পানির গোল গোল ফোঁটা দেখা যেতে পারে। কিন্তু ওরকম ফোঁটার ছাপঅলা শার্ট দেখলেই টিচার বুঝে ফেলেন যে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।

আমার বন্ধুরা, মানে আমি, অনন্ত, জিয়ন আর নাভিদ, আমরা কয়েকজন মন খারাপ করে বারান্দায় বসে ছিলাম। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ বাইরে না যাওয়ার কড়াকড়ি আর স্কুলে এলে আরো বেশি, ইচ্ছেমতো মাঠেও যেতে পারব না। অনেকের স্কুলে নাকি মাঠও নেই।

তবে আমাদের স্কুলে ছোট্ট একটা মাঠ আছে। বাবা-মা বলেন ছোটো, কারণ, তাদের স্কুলে নাকি এর চেয়ে অনেক বড়ো মাঠ ছিল। আমার কাছে অবশ্য আমার স্কুলের মাঠটা বড়োই মনে হয়। এ মাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে যেতে অনেকক্ষণ লাগে। মা বলে আমি ছোটো বলেই নাকি আমার ওরকম লাগে। বড়োরা সহজেই বলতে পারে যে আমি ছোটো বলে আমার কাছে এরকম লাগছে, ওরকম লাগছে, কারণ, ওরা কোনোদিন ছোটো ছিল।

কিন্তু আমি বলতে পারি না যে বড়োদের কেন ওরকম লাগে, কারণ, আমি কখনো বড়ো ছিলাম না। যদিও বড়োদের সবই মনে আছে যে বাচ্চাদের কীসে কেমন লাগে, কিন্তু বড়োদের শুধু এটা মনে নেই যে বাচ্চাদের অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে আর বড়োদের যন্ত্রণায় তা তারা করতে পারে না। এই যেমন বৃষ্টির মধ্যে মাঠে যেতে বাচ্চাদের খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু বড়োদের জ্বালায় সেটা সম্ভব না।

জিয়ন বারান্দার পাশ দিয়ে পায়চারি করতে করতে মাঠে পড়ে যাবার ভান করছিল। তাতে সামান্য বৃষ্টি তার হাতে আর মুখে লেগেছে। ফিরে এসে আমাদেরকে দেখাল। আমরা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নেড়ে নেড়ে দেখলাম। নাভিদ কয়েকটা ফোঁটা নিয়ে খেয়ে ফেলল। বলল, ‘আমাদের পানির মতোই।’ আমরা সবাই মিলে হাসলাম। অনন্ত বলল, ‘তুমি কি ভেবেছিলে বৃষ্টি খেতে আইসক্রিমের মতো হবে?’ আমি বললাম, ‘হয় তো! শিলাবৃষ্টি দেখনি? আমাদের বারান্দায় একবার শিলাবৃষ্টিতে অনেক শিলা জমা হয়েছিল। বুয়া আমাকে খেতে বলেছিল। খেয়ে দেখলাম ললির মতো লাগে।’

‘হ্যাঁ, তুমি ভেবেছ শুধু তোমাদের বারান্দাতেই শিলাবৃষ্টি এসেছিল। আমিও খেয়েছি,’ ঠোঁট উলটে বলল অনন্ত।

সে বলতে গেলে চুপচাপ থাকে। বেশিরভাগ সময়ে চুপচাপ বসে আমাদের গল্প শোনে। তারপর হঠাৎ কখনো একটা কি দুটো কথা বলে। আমি তাই তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কেমন লেগেছে খেতে?’ সে সামান্য হাসল। আপাতত হয়ত আর কথা বলবে না।

জিয়ন বলল, ‘আমাদের যদি মাঠে নামতে দিত তবে সবাই গিয়ে ভিজে আসতাম, তাই না? আর যদি তখন শিল পড়া শুরু হতো?’

‘তাহলে মাথা ফাটত। তখন আর মানা করতে হতো না। আমরা এমনিতেই বারান্দায় বা ক্লাসরুমে গিয়ে ভদ্র হয়ে বসে থাকতাম,’ আমি বললাম।

নাভিদ তখন বলল, ‘কিন্তু এমন হতে পারে না যে আমরা সবাই বাইরে কোথাও? বৃষ্টি হলেও আমরা রাস্তায়, শিল মাথায় পড়লেও রাস্তায়ই থাকতে হচ্ছে?’

‘সে তো যদি আমরা সবাই মিলে কোথাও চলে যেতাম, তবে,’ জিয়ন বলল। আর তখন সাথে সাথেই আমি বললাম, ‘তাহলে আমরা কোথাও চলে যাই না কেন?’ খুব কম কথা বলা অনন্ত আমার কথা শুনে চমকে উঠল। বলল, ‘মাথা খারাপ নাকি? শুনলে কেউ যেতে দেবে?’ আমি বললাম, ‘কাউকে বলব কেন আমরা?’ অনন্ত ভয় পেয়ে বলল, ‘আর যদি আমরা হারিয়ে যাই?’ জিয়ন বলল, ‘ধ্যাৎ হারাব কেন? আমরা তো সবাই বাবা-মায়ের ফোন নম্বর আর বাসার ঠিকানা জানি। জানি না?’ সবাই এক সঙ্গে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি’ বলে উঠল।

আমি তখন গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘আসলে কদিন ধরেই আমি একটা ভিডিও গেমের কাহিনির পরিকল্পনা করছিলাম। আমি আসলে বড়ো হয়ে একটা ভিডিও গেম প্রোগ্রামার হতে চাই। ভাবলাম, প্রথমে তো গল্পটা ঠিক করতে হবে, নাকি? গেম কী করে বানায় সেটা না-হয় বড়ো হয়ে আমি শিখে নেব।’

বাকিরা আমার কথা শুনে খানিকটা কাছে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। তারপর একসঙ্গে বলল, ‘তো?’

‘তো ভাবছিলাম আমরা বেরিয়ে পড়ি আর ভিডিও গেমের কাহিনিটা বানানো শুরু করি।’

‘কাহিনি কী করে বানায়?’ নাভিদ বোকা বোকা চোখে জিজ্ঞাসা করল।

‘আরো বাবা, এই যে আমরা ঘুরে বেড়াব, তার মধ্যে কত্তকিছু ঘটবে না? কত মজা হবে, কত ঝামেলাও হতে পারে, আবার ধরো কোনো বিপদ...’

‘বিপদ!’ নাভিদের চোখ গোল গোল হয়ে গেল।

‘মানে, বিপদ-টিপদ আসতে পারে না?, পারে তো,’ তার ভয়কে পাত্তা না দিয়ে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলাম আমি।

‘আর তখন আমরা কী করব?’ নাভিদকে দেখে মনে হলো সে সত্যিই বিপদে পড়ে গেছে।

‘আমরা এতজন আছি, সবাই মিলে বিপদটার সঙ্গে যুদ্ধ করব। এতে চিন্তার কী?’

অনন্ত আর জিয়ন আমার কথায় রাজি হলো। জিয়ন বলল, ‘ভিডিও গেমে আমরা কি বিপদের মোকাবেলা করি না? তখন কি আমরা ভয় পাই?’ আমরা সবাই একসঙ্গে মাথা নেড়ে বোঝালাম, নাহ্ আমরা ভয় পাই না। সবাই রাজি হলে আমি তখন সবচেয়ে দরকারি কথাটা বলে ফেললাম, ‘কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আমাদের প্রত্যেকের হাতে মাত্র একটা লাইফ। তাই গেমের প্ল্যানটা করতে হবে খুব সাবধানে।’

তারপর যেই ভাবা সেই কাজ। ক্লাসরুমে গিয়ে আমরা যে যার ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ঘাড়ে ব্যাগ উঠিয়ে করিডোরে হেঁটে স্কুলের গেটের দিকে যেতে শুরু করলাম। টিফিন পিরিয়ড প্রায় শেষ তখন, ছেলেমেয়েরা ক্লাসের দিকে যেতে শুরু করেছে। সামনের দিকের ছোট্ট মাঠটা বলতে গেলে ফাঁকা। গেটের দারোয়ান টিফিন খেয়ে পানি খেতে গেছে, আমরা জানতাম ওই সময়ে সে পানি খেতে যাবে। সেই সুযোগে গেট খুলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

স্কুলের বাইরে এসেই আমরা ফুটপাথ ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম। এমনভাবে দৌড়াচ্ছিলাম যেন পিছনে দারোয়ান আমাদের ধাওয়া করছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সেরকম কিছুই না। মোড়ের কাছাকাছি গিয়ে দৌড়ানোর গতি কমিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের পিছনে কেউ নেই। এমনকি রাস্তার লোকরাও আমাদের লক্ষ করছে না। মোড়ের পাশের ঘেরা দেয়া ছোট্ট পার্কে ঢুকে পড়লাম আমরা। তারপর ঘাসের উপরে বসে হাঁফাতে লাগলাম। পার্কের চারদিকে রাস্তা, শোঁ শোঁ করে গাড়ি যাচ্ছে আর জোরে জোরে হর্ন বাজাচ্ছে। কিছুক্ষণ আমরা সেখানে বসে বৃষ্টিতে ভিজলাম। কিন্তু বৃষ্টির জোর তখন কমে এসেছে।

নাভিদ বলল, ‘এই বৃষ্টিতে এখানে বসে ভিজে লাভ নেই।’

‘আর এখানে খুব শব্দও, কানে তালা লেগে যাচ্ছে,’ জিয়ন যোগ করল। আমি বললাম, ‘চলো, তাহলে দূরে কোথাও চলে যাই।’ জিয়ন জানতে চাইল, ‘কত দূরে?’ আমি বিজ্ঞের মতো একটা বাস দেখিয়ে বললাম, ‘ওই বাসটা যত দূরে যায়, তত দূরে।’ নাভিদ বলল, ‘হুম, তাহলে কেউ আমাদেরকে চিনতে পারবে না আর দূরে কোনো শব্দও থাকবে না আর দূরের জায়গাটাতে আমরা খুব করে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব।’ অনন্ত সবার কথার শেষে ধীরে ধীরে উপর-নীচে মাথা দোলাল। তার মানে হলো গিয়ে আমাদের কথা তার পছন্দ হয়েছে। ব্যাগ ঘাড়ে উঠিয়ে আমরা বাসটার দিকে যেতে লাগলাম।

ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে তখনো সেটা একই জায়গায় আটকে ছিল। আমরা গেটের কাছে যেতেই গেটে দাঁড়ানো লোকটা সরে দাঁড়াল। আমরা দুমদাম করে বাসে উঠে পড়লাম। লোকটা এসে জানতে চাইল আমরা কোথায় যাব। নাভিদ ফট করে বলে বলতে শুরু করল, ‘ওই যে দূরে বৃষ্টিতে...’ আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে জানতে চাইলাম, ‘এই বাস কোথায় যাবে?’ লোকটা দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, ‘যাইবে তো অনেক জাগায়, তুমরা কুথায় যাবা?’ আমি আগের চেয়েও গম্ভীরভাবে বললাম, ‘মানে, জানতে চাচ্ছি, বাসটা শেষ কোথায় যাবে?’ লোকটা বলল, ‘কালিয়াকৈর।’ জিয়ন আমার মনের ইচ্ছা ধরতে পারল। লোকটাকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্য কালিয়াকৈরের চারটা টিকেট দেন।’

তার হাতের টাকায় যথেষ্ট হলো না, তাই আমাদের ব্যাগ থেকেও দিতে হলো। লোকটা টিকেট দিয়ে চলে গেল। বাস চলতে শুরু করল। জিয়ন তখন নাভিদের দিকে তাকিয়ে ধমকে বলল, ‘তুমি কথা কম বলবে। রাস্তায় বাচ্চাদের কত বিপদ তা জানো? আর সবচেয়ে বেশি বিপদ সত্যি সত্যি তোমার ইচ্ছার কথাটা বলে ফেললে।’

কলমটা দেখতে যত সুন্দর, লেখে তার চেয়েও সুন্দর। একটানা খসখস করে এই পর্যন্ত লিখে অলীক খাতা বন্ধ করে। বন্ধ করে চারদিকে তাকিয়ে দেখে সে তার ঘরে পড়ার টেবিলে বসে আছে। আশ্চর্য, এই না মনে হচ্ছিল সে তার বন্ধুদের সঙ্গে বাসে চলে কালিয়াকৈর যাচ্ছে? বাস সামান্য দুলছে আর নাভিদ বেফাঁস কথা বলে ফেলার জন্য কাচুমাচু হয়ে আছে, অনন্ত গম্ভীরভাবে রাস্তাঘাট লক্ষ্য করছে, জিয়ন আর সে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে নিচ্ছে যে কালিয়াকৈরে গিয়ে তারা কী কী করবে... ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে ফেলে অলীক। তারপর কলমটায় খাপ আটকে দেয়।

‘কী দাদুভাই, লিখছিলে মনে হয়?’ দাদু হঠাৎ ঘরে আসে।

‘তোমার ঘুম শেষ?’ অলীক লজ্জা পেয়ে খাতাটা লুকায়।

‘বাব্বা, আজ মনে হয় ভিডিও গেম বন্ধ? এতক্ষণ ধরে লিখছিলে? বেশ তো! একটা কাহিনি হয়ে গেছে নিশ্চয়?’

‘মাত্র তো শুরু করলাম। তবে এখন দেখাব না। শেষ হলে দেখাব।’

‘আচ্ছা,’ বলে দাদুভাই অলীককে জড়িয়ে ধরেন।

 

সাত

বাসের ঝাঁকুনিতে আমরা কখন একজন আরেকজনের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। জোরে একটা ব্রেক করাতে আমার চোখ হঠাৎ খুলে গেল। টের পেয়ে দেখি জিয়ন, অনন্ত আর নাভিদ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাস আবারে জোরে চলতে শুরু করল। আমি নড়ে ওঠাতে পাশাপাশি ওদেরও ঘুম ভেঙে গেল।

নাভিদ চোখ কচলে বলল, ‘আমরা কতদূর এলাম?’

বাইরে খানিক পরপর বড়ো গাছ দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে ছোটো ছোটো জঙ্গলের মতো। মাটিটার রং ঢাকার চেয়ে আলাদা। মানে হচ্ছে মাটিতে সামান্য লাল রং মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। নাভিদের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য জানালার বাইরে তাকিয়েছিলাম। কোনো দোকান বা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল না। তাই উত্তরও পেলাম না। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখি পাশের সিটে দুটো লোক আমাদের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। আমাদেরকেই দেখছে অথচ ভাব দেখাচ্ছে যে আমাদের পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

মাঝেমাঝে নিজেদের মধ্যে ইশারায় বা ফিসফিস করে দু’একটা কথাও বলে নিচ্ছে। তারা যেমন আমাদেরকে লুকিয়ে দেখছিল, আমিও তেমনি তাদের দিকে লুকিয়ে নজর রাখলাম।

খানিকক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে আমি কানে কানে অনন্তকে তাদের ব্যাপারে জানালাম। অনন্ত তাদের দিকে তাকিয়েই বলে দিল, ‘লোকদুটোর কিন্তু কোনো মতলব আছে। আমাদেরকে বিপদে ফেলবে।’ ঠিক তখনই তাদের মধ্যে একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় যাইতেছ, বাবুরা? গায়ে ইসকুল ডেরেস দেখি, এদিককার কোনো ইসকুল তো মনে হয় না...’

আমি আর অনন্ত চুপচাপ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নাভিদ রেগে গিয়ে বলল, ‘তাতে আপনাদের কী?’ লোকদুটো হাসল। একজন হাসতে হাসতে বলল, ‘জিগাই আর কী। সঙ্গে কেউ নাই মনে হয়?’ নাভিদ যেন আর কিছু না বলে তাই আমি আগেই তার হাতে চিমটি কাটলাম। অনন্ত বাসের পিছনের দিকে আঙুলের ইশারা করে বলল, ‘আছে। আমাদের টিচার আছে।’

লোকদুটোর মুখ কালো হয়ে গেল। ‘ও আচ্ছা’ বলে বোকা বোকা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।

তখনকার মতো আমরা নিশ্চিন্ত হলাম কিন্তু মনে মনে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। লোকগুলো যদি বুঝে ফেলে যে আমাদের সঙ্গে কেউ নেই, আমরা শুধু বৃষ্টিকে ধাওয়া করতে করতে ঢাকা থেকে কালিয়াকৈরের বাসে চড়ে বসেছি আর আমরা আসলে রাস্তাঘাট চিনি না?... আমি আর বেশিদূর ভাবতে পারলাম না। জিয়নের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে-ও একই কথা ভাবছে। আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘লোকদুটো দেখতে কিডন্যাপারের মতো।’

‘আশ্চর্য, তুমি কিডন্যাপার দেখেছ নাকি কখনো?’

‘না, মানে আমি যদি কিডন্যাপারের ছবি আঁকতাম, তবে এদেরকেই আঁকতাম।’

আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম। সে খুব ভালো ছবি আঁকে। ছবি আঁকার জন্য প্রতিবছর স্কুলে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি পুরস্কার পায়। টিচাররা তার আঁকা ছবি দেখে বলে, দেখতে একেবারে রিয়েল লাইফের মতো। যাই হোক, আপাতত লোকদুটোর চোখ থেকে কী করে বাঁচা যায়, ঠাণ্ডা মাথায় সেটা ভাবতে হবে। আমরা ভাবতে লাগলাম আর নাভিদকে বললাম যেন দয়া করে কথা না বলে। তবে ভাবনার সময়টা খুব কঠিন হলো। কারণ, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে, দুশ্চিন্তায় মাথাটা এমন ঘুরছে যে মনে হচ্ছে সামনে আয়না থাকলে মাথার বনবন করে ঘোরাটা দেখতে পেতাম। অথচ এইসবকিছুর মধ্যে মুখটা রাখতে হচ্ছে শান্ত, স্বাভাবিক।

আমি একবার জানালার দিকে আরেকবার লোকদুটোর দিকে তাকাতে লাগলাম। তাদের দিকে তাকালে তারা চমকে ওঠে আর আমি হাসি হাসি মুখ করি। কিন্তু আমি জানি, আসলে চমকে উঠি আমি। সেটা ঢাকতেই আমাকে হাসতে হয়। আমাকে দেখে তখন নাভিদও হাসে।

বাস চলতে চলতে একখানে এসে ক্যাচ ক্যাচ করে ব্রেক করল। আমরা সবাই আরেকটু হলে সামনের সিটের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। ভাগ্যিস আগেভাগেই সিটের পিছনের দিকটা চেপে ধরলাম। সামনে দেখা গেল একের পর এক অনেক বাস আর গাড়ি দাঁড়ানো। উল্টোদিক দিয়ে প্রথমে কিছু গাড়ি ধীরে ধীরে এলো, কিন্তু একসময় তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। আর তারপর সবকিছু ছবির মতো স্থির হয়ে থাকল অনেকক্ষণ। বাইরে তখন বৃষ্টির মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে।

বাস কেন দাঁড়িয়ে আছে বুঝলাম না। আর বৃষ্টিও কেন যেন আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। মাথা ঘোরা আর দুশ্চিন্তা আরো বাড়ল। ড্রাইভার একসময় গেটে দাঁড়ানো লোকটাকে জোরে ডেকে বলল, ‘ওই, সামনে গিয়া দ্যাখ কী হইছে।’ লোকটা ‘জি, উস্তাদ’ বলে হাওয়া হয়ে গেল। ফিরে এল বেশ খানিক পরে। গেটের বাইরে থেকে হাঁক দিয়ে বলল, ‘সামনে অ্যাক্সিডেন হইছে, উস্তাদ। চাইরটা বডি। মনে কয় বহুত সময় লাগব।’

শুনে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। এখন এখানে বসে থাকতে থাকতে যদি ওই কিডন্যাপারগুলো, মানে, ওই লোকগুলো বুঝে ফেলে যে আমাদের সঙ্গে আসলে কোনো টিচার নেই? কতক্ষণ মিথ্যে বলে চালানো যাবে? ভয়ে ভয়ে তাদের দিকে তাকালাম। দেখলাম লোকদুটো অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে বড়ো বড়ো হাই তুলল। তারপর পিছনের দিকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করতে লাগল। আমি আর জিয়ন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। চোখে চোখে আমরা কথা বলতে লাগলাম, ওরা কি আসলেই ঘুমোবে নাকি ঘুমের ভান ধরে আমরা কী করি সেটা আরো ভালোমতো লক্ষ করবে?

অনন্তও আমাদের চোখের ইশারার কথায় যোগ দিল, লোকদুটো যদি সত্যিই ঘুমের ভান করে তবে চট করে আমাদের ধরে ফেলতে পারবে না। আমাদের কথায় শেষে যোগ দিল নাভিদও। আমরা সবাই একমত হলাম যে কালিয়াকৈর পর্যন্ত গিয়ে লোকদুটোর ফাঁদে পড়ার চেয়ে আমরা বরং এখানেই নেমে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা শব্দ না করে উঠে দাঁড়ালাম। যার যার ব্যাগ ধীরে ধীরে পিঠে চাপালাম। তারপর পা টিপে টিপে সিট থেকে উঠে দরজার দিকে যেতে শুরু করলাম। সবার শেষে জানালার দিক থেকে বেরিয়ে এল অনন্ত। দরজার কাছে এসে পিছনে তাকিয়ে দেখি সে বাসের পিছনের দিকে ইশারা করে হাতের সবচেয়ে ছোটো আঙুলটা দেখাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমি ধরতে পারলাম না যে সে ওরকম করছে কেন। কিন্তু সে যখন আমার দিকে তাকাল তখনই বুঝলাম, লোকদুটো যদি ঘুমের ভান করে আমাদের দিকে লক্ষ করতে থাকে তবে ভাববে যে পিছনে বসা টিচারকে ইশারায় আমরা টয়লেটে যাবার কথা বলছি।

নিচে নামতেই এক সারিতে অনেক গাড়ি দেখতে পেলাম। গাড়িগুলো থেকে মানুষ নেমে এদিকওদিক ঘোরাফেরা করছে। সামনে কতদূরে কী অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। জায়গাটাও অদ্ভুত। দুদিকে হালকা জঙ্গল আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা। একদিকের জঙ্গলের ধার পর্যন্ত চলে গেলাম আমরা। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখি লোকদুটো বাসের জানালা দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কি তাহলে সত্যিই ঘুমের ভান করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল?

ভয়ে আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আর অনন্ত হাসিহাসি মুখ করে বাসের পিছনের দিকের একটা জানালার দিকে হাত নাড়ল। তার দেখাদেখি আমিও নাড়লাম। লোকদুটো তখন বাসের পিছনের দিকে উঁকিঝুকি দিতে শুরু করল। বাসের অনেক মানুষই তখন জানালার বাইরে মাথা বের করে সামনে দেখতে চেষ্টা করছিল। তাদের সবার মুখ লোকদুটোর দেখতে পাবার কথা না। তাই তারা কিছু বুঝল কি না কে জানে, কিন্তু দুজনে মিলে যেই বাসের পিছনে ভালোমতো তাকাল ওমনি আমরা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে উধাও হয়ে গেলাম।

 

আট

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেন যেন লেখার খাতাটা উলটে দেখতে ইচ্ছে করে অলীকের। চোখ ঘসতে ঘসতে প্রতিদিনের মতো ভিডিও গেম কন্ট্রোলারের দিকে তার হাত যায় না; বরং হাত চলে যায় পড়ার টেবিলে রাখা খাতাটার দিকে। নিজেই সে এখন একটা ভিডিও গেমের মতো কাহিনি লিখতে পারে, ভাবতে গিয়ে নিজে নিজে হাসে। গেমের মধ্যে এমনটাই হবে, চার বন্ধু, মানে, চার জন প্লেয়ার গেমটা শুরু করবে। তারা নিরুদ্দেশে যাবে। কিন্তু তারপর? চিন্তায় ডুবে যায় অলীক।

হাসি হাসি মুখে সামনে বাকসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা কলমটাকে একবার খুলে দেখে নেয়। শেষে খাতার পাতা উল্টোতেই তার ঘুমঘুম সরু চোখ বড়ো গোল হয়ে খুলে যায়, এ কী! এসব কে লিখেছে? পুরো লেখাটায় দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে অলীক। তারপর খাতাটা হাতে নিয়ে খাবার ঘরে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘দাদু... দাদু, তুমি কেন করেছ এটা?’

দাদু ঠিক তখনই ছাদ থেকে হেঁটে বাসায় এসে ঢুকছিল। দরজা লাগাতে লাগাতে তার চিৎকারও শোনা যায়, ‘আমি আবার কী করলাম রে, দাদুভাই?’

‘আমার খাতায় তুমি কেন লিখেছ?’

‘আমি কেন লিখতে যাব তোমার খাতায়? কই দেখি, কোথায়?’ বলে দাদু অলীকের হাত থেকে খাতাটা নেয়। তারপর খাবার টেবিলে রেখে পাতাগুলো উলটে দাদুর চোখ ছানাবড়া, ‘এইসমস্ত তুমি লিখেছ!’ অলীক কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতে থাকে, ‘আমিই তো লিখছিলাম, একটা চ্যাপ্টার লিখেছি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি কে যেন তার পর থেকে অনেকটা লিখে রেখেছে, মানে হলো গিয়ে পরের চ্যাপ্টার। সত্যি করে বলো, তুমি লেখনি?’

‘কী আশ্চর্য, তোমার লেখার জন্য আমি কলম কিনে এনেছি, সেটা দিয়ে আমি লিখতে যাব কেন?’

‘তাহলে এগুলো কে লিখেছে? এই যে দেখ, আমি তো বন্ধুদের নিয়ে বাসে করে কালিয়াকৈর যাচ্ছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে কিন্তু দেখ গল্পটা কোনদিকে চলে গেছে। আমরা তার আগেই একটা জঙ্গলের মাঝখানে নেমে গেছি,’ অলীক খাতার পাতায় আঙুল রেখে দাদুকে দেখায়। দাদু ভালো করে পড়ে নিয়ে হো হো করে হাসে।

‘তুমি খামোখা হাসছ কেন বলো তো?’ অলীকের খুব রাগ হয় দাদুর উপরে।

দাদু কষ্ট করে হাসি বন্ধ করে। তারপর বলে, ‘এই দেখ, এই যে দ্বিতীয় চ্যাপ্টার, এই হাতের লেখাটা কি তোমার নয়?’

অলীক বোকা বোকা চোখে দাদুর দিকে তাকায়, ‘হুম, দেখতে তো আমার লেখার মতোই!’

‘সেটাই বলছি। আমার হাতের লেখা তো এমন নয়। আমি তোমার মতো করে লিখব কী করে?’

‘কিন্তু বিশ্বাস কর, দাদু, ওগুলো আমি লিখিনি। আমি তো ভেবেছিলাম আমি ঘুমিয়ে যাবার পরে তুমিই... ’

‘আচ্ছা, তোমার বন্ধু জিয়ন যে এত ভালো ছবি আঁকে আর ছবি এঁকে পুরস্কার পায়, একথা কি তুমি কখনো আমাকে বলেছিলে?’

অলীক কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ‘না মনে হয়। বলিনি।’

‘তবে? আমি সেটা কী করে জানব?’

দাদুর কথা শুনে অলীক চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবতে ভাবতে একসময় তাকে বিশ্বাস করতেই হয় যে দাদু লেখেনি। কিন্তু সে নিজেও তো লেখেনি! তবে লিখলটা কে? ভাবনায় কোনো কূলকিনারা না পেয়ে অলীক দাদুর কাছে জানতে চায়, ‘কিন্তু এখন যে আমরা সবাই জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেলাম, এবারে কী হবে?’

‘কী আর, তোমরা তো নিরুদ্দেশেই যাচ্ছিলে, তাই না? তাহলে রাস্তায় আছ নাকি জঙ্গলে, তাতে কী আসে-যায়?’

এবারে দাদুর কথা অলীকের পছন্দ হয়। অলীক হাসে। দাদু বলে, ‘আমার তো খুব খিদে পেয়ে গেছে। এবারে চলো খাই আর খেতে খেতে তুমি ভাবো জঙ্গলে ঢোকার পরে তোমাদের কী হতে পারে।’ দাদু টেবিল থেকে আজকের পেপারটা হাতে তুলে নেয়, হতাশ হয়ে বলে, ‘আজও ভদ্রলোককে পাওয়া গেল না। উহ্, দিন দিন কী সব যে হচ্ছে শহরটায়!’

‘কী হয়েছে?’

দাদু পেপারের উপরের পাতায় স্যুট-টাই পরা একজনের ছবি দেখিয়ে বলে, ‘এই যে রবিন চৌধুরি। বিরাট ব্যবসায়ী। তিন দিন আগে তাকে তার অফিসের সামনে থেকে কারা যেন কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী, টাকা চেয়েছে। এদিকে ফ্যামিলির লোকজন টাকা দিতে চাইলেও এখন কী করবে তা হয়ত বুঝতে পারছে না। কারণ ব্যাপারটা এখন পুলিশ হ্যান্ডেল করছে। আর এদিকে কিডন্যাপাররা রবিনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তা-ও পুলিশ এখনো বের করতে পারেনি।’

‘ও আচ্ছা। আমি পুলিশ হলে কিডন্যাপারদেরকে ধরে মোটা রশি দিয়ে বেঁধে...’

‘হয়েছে, দাদুভাই। এখন খেতে বসো,’ বলে দাদু অলীকের কথার মাঝখানে পেপার বন্ধ করে রেখে খেতে শুরু করে দেয়। হাঁটাহাঁটি করে তার হয়ত সত্যিই খিদে পেয়ে গেছে।

অলীক ‘আমি আসছি’ বলে খাতাটা নিজের ঘরে রাখতে যায়। টেবিলের উপরে খোলা বাকসে শুয়ে থাকা কলমটার গায়ে হাত দিতে তার হাত কাঁপে। রাতে অলীক ঘুমিয়ে পড়ার পরে এই কলমটা তবে নিজে নিজে এতটা লিখল! অলীকের নাম লেখা কলম বলেই হয়ত তার ব্যাপারে এত কথা জানে। কিন্তু তারা কি তবে কলমের ইচ্ছাতেই বাস থেকে নেমে পড়েছিল?

দাদু ঠিকই বলেছে, তারা তো নিরুদ্দেশেই যাচ্ছিল, কোথায় না কোথায় বাস থেকে নেমে পড়েছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। তাহলে কলমের ইচ্ছাই বহাল থাকুক। অলীক ঠিক করল নাস্তা খেয়ে সে তার পর থেকে আরেকটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলবে।

(চলবে...)

আগের পর্ব

অলঙ্করণ: হ্যাডলি হোপার

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!