বাংলাদেশের নৌকার যতো মজার নাম

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলেই বাংলাদেশের খাল বিল,নদী-নালাগুলো পানিতে ভরে যায়,বেড়ে যায় বৃষ্টির পরিমাণ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা তাই একটি প্রাচীন ও জরুরী বাহন।

দেবলীনা ঘোষবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2018, 11:26 AM
Updated : 22 May 2018, 11:26 AM

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে নৌকা এখনও স্থানীয় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পণ্য পরিবহনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বর্ষাকালে নৌকা প্রচুর ব্যবহার হয়।

গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে। এসব নৌকার রয়েছে মজার মজার নাম।

ডিঙ্গি

ডিঙ্গি নৌকা আকারে ছোট। এটি বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকা। নদী তীর বা হাওর-বাওরে যারা বাস করেন তারা সবাই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন। এটি নদী পারাপার বা অল্প পরিমাণ পণ্য পরিবহনে কাজে লাগে। আকারে ছোট বলে এ নৌকা চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।

ডোঙা

তালগাছের কাণ্ড কুঁদে এ নৌকা বানানো হয়। ডোঙ্গা বেশ টেকসই,তবে এতে খুব বেশি মানুষ বা মালামাল নেওয়া যায় না। পার্শ্বদেশ বা বিস্তার এতই কম যে,এতে পাশাপাশি দু’জন বসা যায় না। একটু বেসামাল হলে,ডোঙ্গা উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। ডোঙার উপর দাঁড়লে যাতে তলা ফেঁসে না যায়,সে জন্য এর তলদেশ বেশ মোটা রাখা হয়। তাল গাছের কাণ্ড সহজে পচে না বলে ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।

কোষা

বর্ষাকালে চরাঞ্চলে বা বিলে ডোঙা দেখা যায়। অন্যান্য নৌকার মতো এর গলুইয়ের কাঠ বড় থাকে না। অঞ্চল বিশেষে এর আকার কমবেশি দেখা যায়। কোষা মূলত পারিবারিক নৌকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাটবাজার,স্বল্প দূরত্বে চলাচলের কাজে লাগে। একটি আদর্শ কোষা নৌকাতে আটজনের মতো যাত্রী বহন করা যায়। সাধারণত কোষাগুলোতে ছই থাকে না। কোষা বৈঠা দিয়ে চালানো হয়। তবে অগভীর জলে লগি ব্যবহার করে চালানো যায়। একটি ভারি এবং বেশি ওজন বহন করার উপযোগী কোষাকে বলা হয় ‘ঘাসী নৌকা’।

সাম্পান

বাংলাদেশের লোকগীতি ও সাহিত্যে সাম্পানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান। চট্টগ্রাম,কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। এ নৌকাগুলির সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো,পেছনটা থাকে সোজা। প্রয়োজনে এর সঙ্গে পাল থাকে আবার কখনও থাকে না।

একজন মাঝিচালিত এই নৌকাটি মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এক সময় বড় আকারের সাম্পানও দেখা যেত কুতুবদিয়া অঞ্চলে,তবে এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাতজন মাঝি থাকতো আর থাকতো তিনকোণা আকারের তিনটি করে পাল।

গয়না

এ নৌকা আকৃতিতে মাঝারি। এটি কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। মূলত যাত্রী পারাপারের কাজেই এদের ব্যবহার করা হতো। একসঙ্গে প্রায় ২৫-৩০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকার। আবার রাজশাহী অঞ্চলে এর থেকেও বড় আকারের গয়না নৌকা পাওয়া যেত। এরা আকারে যেমন বড় তেমনি এই নৌকায় বেশি সংখ্যক যাত্রীও উঠতে পারতো। বর্তমানে এই নৌকাও বিলুপ্তির পথে।

বজরা

আগের দিনে ধনী লোকেরা শখ করে নৌকা ভ্রমণে যেতেন। তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ‘বজরা’ নৌকা। বজরাতে তারা এক রকম ঘরবাড়ি বানিয়ে নিতেন। ফলে এতে খাবার-দাবারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই থাকতো। কোনটিতে আবার পালও থাকতো। এতে থাকতো চারজন করে মাঝি। বজরা মূলত সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে দেখা যেত।

বাইচের নৌকা

নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ যে এ নৌকাকে ঘিরে হতো অনেক মজার মজার খেলা।  ‘নৌকা বাইচ’ এখনও একটি জনপ্রিয় খেলা। বাইচের নৌকা লম্বায় দেড়শ থেকে দুইশ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রতিযোগিতার সময় এতে পঁচিশ থেকে একশ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতে পারে। আগে নবাব-বাদশাহরা বাইচের আয়োজন করতেন। এইসব বাইচের নৌকার আবার সুন্দর সুন্দর নাম দেওয়া হতো, যেমন- পঙ্খীরাজ,ঝড়ের পাখি,দ্বীপরাজ,সোনার তরী ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জ,পাবনা,ময়মনসিংহ,ফরিদপুর,নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে এসব নৌকা ছিল।

বাতনাই

এর অপর নাম ‘পদি’। এটি মালবাহী বজরার একটি সংস্করণ। খুলনা অঞ্চলে মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই বজরাগুলো অনেক বড় হয়। বর্তমানে এই বজরা আর দেখা যায় না। যান্ত্রিক নৌকার ব্যবহারের কম খরচ ও কম সময় লাগে বলে এ নৌকার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এ নৌকার বড় খরচ ছিল এর লোকবল। এটা এতটাই ভারি হতো যে এটি চালাতে ১৭-১৮ জন মাঝি লাগতো।

ময়ূরপঙ্খী

রাজা বাদশাহদের শৌখিন নৌকার নাম হলো ‘ময়ূরপঙ্খী’। এর সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ময়ূরপঙ্খী’। এই নৌকা চালাতে প্রয়োজন হয় চারজন মাঝির। নৌকায় থাকতো দুটো করে পাল।

বালার

কুষ্টিয়া অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও নৌকা ব্যবহার হয়ে আসছে। সেখানে বিখ্যাত নৌকার নাম হলো ‘বালার’। এ নৌকাগুলি আকারে অনেক বড় হয় এবং প্রায় ১২-৫৬ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। আর বৈঠা বায় ১০-১২ জন মাঝি। এ ধরনের নৌকায় পাল থাকে দুটো করে।

পানসী

নৌকায় চড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার একমাত্র ও অন্যতম মাধ্যম ছিল পালতোলা পানসি। এই পানসীতে চড়ে মাঝি মাল্লার ভাটিয়ালি, মুর্শিদী আর মারফতি গান গেয়ে মন কেড়ে নিতো যাত্রীদের। বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে এটি প্রচুর দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে পানসি নৌকা হারিয়ে গেলেও

ছুঁইওয়ালা বা একমালাই

পালতোলা পানসির মতো ছুঁইওয়ালা একমালাই ছিলো দূরপাল্লার নৌকা। আজও এর দেখা মেলে। বরিশালের দুশুমি গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাসহ উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের শতাধিক পরিবারের সদস্যরা ছুঁইওয়ালা নৌকার মাঝি হিসেবে বাপ-দাদার এ পেশাকে এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

পাতাম

একধরনের যুগল নৌকা। দুটি নৌকাকে পাশাপাশি রেখে ‘পাতাম’ নামক লোহার কাঠাটা দিয়ে যুক্ত করে এ যুগল নৌকা তৈরি করা হয়। একে অনেক সময় ‘জোড়া নাও’ বলা হয়। এ নৌকা মূলত মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে মাঝি ছাড়া চারজন দাঁড় টানা লোক থাকে। এতে  একটি পাল খাটানোর ব্যবস্থা থাকে। এক সময় এই নৌকা  সিলেট ও কিশোরগঞ্জে অঞ্চলে দেখা যেতো। এখন বিলুপ্তপ্রায়।

শ্যালো নৌকা

বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় মোটর লাগানো শুরু হয়। এর ফলে নৌকা একটি যান্ত্রিক নৌযানে পরিণত হয়। এ যান্ত্রিক নৌকাগুলো ‘শ্যালো নৌকা’ বা ‘ইঞ্জিনের নৌকা’  নামে পরিচিতি লাভ করে। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত শ্যালো পাম্পের মোটর দিয়ে ও স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব নৌকা চালানোর ব্যবস্থা করা হয়।

তথ্যসূত্র:

১. উইকিপিডিয়া

২. বাংলাপিডিয়া

৩. বাংলাদেশের নৌকা, এম এ তাহের

৪. বার্জ ফর বাংলাদেশ, ইভ মার