মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি

শুভ্র ভেবে পায় না কী করবে। আর মাত্র তিন দিন বাকি। সেদিন মামা এসেছিল। তাকে বলেও বলতে পারেনি। তারপরও বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মামা বলল- ভাগ্নে আজ আর কিছু শুনব না। তোমার যা যা লাগবে সবই পাবে।

তাহমিনা সাথীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2018, 08:34 AM
Updated : 13 Feb 2018, 08:34 AM

মামা বলতে থাকলো, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। শোন এবার যেখানে যেতে চাইবে সেখানেই নিয়ে যাব। চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, জাদুঘর বা নন্দন পার্ক, যেখানে খুশি সেখানে।

এত কথা শুনতে শুনতে শুভ্র আর কিছুই বলতে পারল না। বাবাকে যে বলবে সে সাহস তার নেই। মাকে বললেও মা অজুহাত দেখাবে। আপুর সঙ্গে তো কথা বলাই যায় না। সে এখন মহাব্যস্ত।

শুভ্র মনে মনে ভাবতে লাগলো- ওকে আমি খুব পছন্দ করি। ও আমার বন্ধু। ওকে কথা দিয়েছি। কালই একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ হচ্ছে শুভ্র। ঘুম হচ্ছে না।

ঘুমানোর চেষ্টা করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লশুভ্র। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল ওর বন্ধুটির মা মরে গেছে। স্বপ্ন দেখে তো শুভ্রের আর ঘুম আসল না। এভাবেই সকাল হল। শুভ্র বাসা থেকে বের হবে এমন সময় মা বলল- কিরে খোকা! কোথায় যাচ্ছিস। শুভ্র নিশ্চুপ। কিছুই বলল না। স্বপ্নটা মনে উঠতেই মাকে জড়িয়ে ধরল।

মা বলল, কিরে কী হয়েছে! শুভ্র কিছুই না বলে মায়ের গালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ল।

শুভ্র ওর বন্ধুর কাছে গেল। বন্ধুর নাম তমাল। তমাল হোটেলে কাজ করে। আগে শুভ্রের স্কুলের সামনে বাদাম বিক্রি করত। তখন থেকেই শুভ্রের সঙ্গে ওর পরিচয়। শুভ্র বাদাম না খেলেও ওর কাছ থেকে বাদাম কিনত। তমালকে ওর ভালো লাগে। তমালের চেহারা খুবই মায়াবী। তবে সারাদিনের পরিশ্রমে ওকে অনেক রোগা রোগা লাগে।

একদিন শুভ্রের স্কুল আগেই ছুটি হয়ে গেল। শুভ্র ভাবল আজ তমালের জীবন কাহিনী শুনবে। ও কেন বাদাম বিক্রি করে? ওর কী লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয় না? অবশ্য বাদাম বিক্রি করে এমন আরও অনেক ছেলেই আছে। কিন্তু কেন যেন ওর তমালকে খুব ভালো লাগে। শুভ্র বাসায় গেল না।

তমাল স্কুলের গেটে বসে বাদাম বিক্রি করছে। শুভ্র বলল-তমাল, আজ আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব। তোমার কথা শুনব। যদিও তোমার একটু ক্ষতি হবে। তবে একটা কাজ করতে পারি, আমার কাছে কিছু টাকা আছে সেগুলো তোমাকে দেব। তুমি আরও বেশি বাদাম কিনে বিক্রি করবে।

তমাল বলল, তা লাগবে না। তয় আপনার বাসায় যাইতে দেরি হলে বকা দিবো না! শুভ্র বলল- না, আজ আমার আগেই ছুটি হয়েছে। আমি ঠিক সময়ে বাসায় চলে যাব। শুভ্র বলল- জানো তমা, তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। আমারও খুব ভালো লাগে, তমাল বলল।

শুভ্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। লেখাপড়ায় অনেক ভালো। ক্লাসে সব সময় প্রথম হয়। বই পড়তে অনেক ভালোবাসে। অবসর সময় পেলেই বই পড়ে। গোয়েন্দা কাহিনী, সায়েন্স ওয়ার্ল্ড, এনসাইক্লোপিডিয়া, জীবনী এসব পড়তে তার খুব ভালো লাগে। শুভ্র বড় হয়ে একজন প্রকৌশলী হতে চায়। তবে সেই সঙ্গে মানুষের সেবায়ও নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। চেষ্টাও করে আপ্রাণ।

তমাল শুভ্রের এক বছরের ছোট হবে। শুভ্র তমালকে বলল- শোন তমাল, আজ থেকে আমরা বন্ধু। তোমার সব কিছু আমাকে বলো। তুমি আমাকে ‘তুমি’ করে বলবে। তমাল বলল- আচ্ছা। তমাল তার জীবন কাহিনী শুরু করল।

তমালের বাবা দুই বছর আগে মারা গেছে। তখন ও পড়ালেখা করত। নন্দীপুর গ্রামে ওদের বাড়ি। সেখানেই থাকত ওরা। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আমাকে ও আমার ছোট বোন তিতলীকে নিয়ে ঢাকায় আসে। এসে মিরপুর বস্তিতে ওঠে।

মা ইট ভাঙ্গার কাজ শুরু করে আর একটা বাসায়ও কাজ নেয়। একদিন মাও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশন করতে হবে। প্রথম মালিক কিছু টাকা দিলেও এখন আর দেয় না। মায়ের ওষুধ ও চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লাগবে। ছোট বোনটা স্কুলে যেতে চায়।

প্রতিদিন বায়না ধরে ব্যাগ এনে দাও। খাতা, কলম এনে দাও। আমি স্কুলে যাব। আমারও ইস্কুলে পড়ার ইচ্ছা আছিল। কিন্তু কী করব, এখন ভাবছি বোনটারে স্কুলে পড়ামু। তয় এই টাকায় হয় না। আমার একটা চাকরি হইলে ভালো হইত।

এ কথা বলে নিজেই হেসে ফেলে তমাল বলে, আমার চাকরি দেবে কে? আমি তো শিক্ষিত না। বয়সটাও তেমন না যে চাকরি করবো। একথাগুলো বলে তমাল চুপ হয়ে গেল। শুভ্র ওর হাতটা তমালের হাতে রেখে বলল- শোন দোস্ত, আমরা আজ থেকে পাক্কা দোস্ত। শুধু দোস্ত না দুই ভাই। আমি যতটুকু পারি তোকে সাহায্য করব। কিন্তু তুই কিছুতেই না করবি না। এই নে, এ টাকাটা রাখ। এই বলে শুভ্র বাসায় চলে গেল।

শুভ্র বাসায় এসে একটু চিন্তিত। কী করা যায়! কাউকে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তমালের সঙ্গে আরও আগে পরিচয় হলে ভালো হত। তাহলে হয়ত টিফিনের টাকা ও ভাড়া বাচিয়ে কিছু একটা করা যেত।

তমালের মা অনেকদিন থেকে হাসপাতালে। এই সপ্তাহে অপারেশন। আরও ৫ হাজার টাকা লাগবে।

শুভ্র আর কিছু না ভেবে তার মামার উপহার দেওয়া গেমস খেলার ট্যাবটা নিয়ে গেলো মোবাইলের দোকানে। দিলো বেচে। সে টাকা নিয়ে সে দৌড়ে গেলো হাসপাতালে, তমালের কাছে।

শুভ্র ভিজে ভিজে বাসায় আসল। এসেই শুনতে পেল মা বুয়াকে বকাবকি করছে। শুভ্র বেহুশ হয়ে পড়ল। ওর গায়ে তুমুল জ্বর। শুধু ঘুমের ঘোরে বলছে, ‘মা, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। মা, আমি তোমার ...’।

দুইদিন পর কিছুটা সুস্থ হলো শুভ্র। ঠিক তখন তমালের ফোন, হ্যালো শুভ্র! মা সুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে অপারেশন ভালো হয়েছে।

শুভ্র  দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল- মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।

বাসার সবাই ব্যাপারটা শুনল। তমালের মা সুস্থ হয়েছে শুনে শুভ্র যে কত খুশি তা বলে বোঝানো যাবে না। মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে শুভ্র বলল- আর মিথ্যা বলবো না মা। তোমাকে অনেক ভালোবাসি।