একদিন গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে, তখনও পুতুল কারখানায় জেপেতো কাঠ খোদাই করছে। কাঠ কেটে কেটে সে বানালো একটা পুতুল।
পুতুলটাকে সামনে মেলে ধরলো জেপেতো। দেখলো উল্টেপাল্টে। তারপর বললো, ‘এবার তোমাকে একটা নাম দিতে হয়। আচ্ছা, তোমার নাম দিলাম পিনোকিও।’
কিন্তু জেপেতোর মনে একটা দুঃখ থেকে গেলো। সে ভাবলো, পিনোকিও যদি সত্যি মানুষ হতো!
বিছানায় শুয়ে জেপেতো আকাশ দেখছে। একটা তারা মিটমিট করে হাসছে জেপেতোর দিকে। জেপেতো মনে মনে বললো, ‘রাতের তারা, তুমি পিনোকিওকে সত্যিকারের মানুষ বানিয়ে দাও।’ ভাবতে ভাবতে একসময় জেপেতো গেলো ঘুমিয়ে।
হঠাৎ আকাশে দেখা দিলো আলোর রেখা। তারার বুক থেকে নেমে এলো নীল পরী। ডানা নাচাতে নাচাতে উড়ে এলো জেপেতোর কারখানায়। নীল পরী বললো, ‘জেপেতো, তুমি খুব ভালো। তোমার বানানো পুতুল শিশুদের আনন্দ দেয়। আজ তোমার মনও আনন্দে ভরে উঠুক। বলো তুমি কী চাও?’
জেপেতো বললো, ‘আমি শুধু চাই পিনাকিও কাঠের পুতুল থেকে মানুষ হয়ে উঠুক।’
এ কথা শুনে জাদুর কাঠি নাড়লো নীল পরী। আর অমনি প্রাণ পেলো পিনাকিও, নড়েচড়ে উঠলো।
মানুষের মতোই হাঁটাচলা করতে লাগলো। তাই দেখে ঝিঁঝিঁ পোকা জেমিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জেপেতো অবাক! পিনোকিও প্রাণ পেয়েছে। এবার তার আশা সত্যি হয়েছে। পিনোকিওকে স্কুলে ভর্তি করে দিলো জেপেতো। আর সব শিশুদের মতো পিনোকিও তাই স্কুল চললো।
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে শেয়ালের সঙ্গে দেখা হলো পিনোকিওর। শেয়াল ভাবলো, ‘বাহ! মজা তো। কাঠের পুতুল সুতো ছাড়াই চলছে! একে পুতুল নাচের দলে অনেক দামে বেচে দেওয়া যাবে।’
তাই ভেবে শেয়াল পিনোকিওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেলো পুতুল নাচ দলের সর্দারের কাছে। তারপর বেচে দিলো।
পুতুল নাচের আসরে সবার মন জয় করলো পিনোকিও। কিন্তু রাতে সর্দার তাকে খাঁচায় আটকে রাখলো। মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলো পিনোকিও।
এমন সময় ঝিঁঝিঁ পোকা জেমিনি উড়ে এসে বললো, ‘ভেবো না পিনোকিও, তোমাকে বের করে আনবোই।’ জেমিনি খাঁচার তালা ধরে টানলো, ঝাঁকাঝাঁকি দিলো, কিন্তু কোনো কাজ হলো না।
এবার এলো নীল পরী। জিজ্ঞেস করলো, ‘পিনোকিও, স্কুলে যাওনি কেন?’ পিনোকিও বললো, ‘আমাকে বড় এক দৈত্য ধরে নিয়ে এসেছে। সে নাকি আমাকে ভেজে খাবে, তাই আটকে রেখেছে।’ যেই না মিথ্যা বললো অমনি নাক লম্বা হতে লাগলো পিনোকিওর।
নীল পরী বললো, ‘তুমি মিথ্যা বলেছো। তাই তোমার নাক লম্বা হয়ে গেছে।’
ঝিঁঝিঁ জেমিনি অনুরোধ করলো, ‘এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দাও, সে আর কখনও মিথ্যা বলবে না।’ নীল পরী বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারের মতো ক্ষমা করা গেলো।’
পিনোকিওকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে আনা হলো। পিনোকিও প্রতিজ্ঞা করলো সে আর কোনোদিন মিথ্যা বলবে না।
পরদিন পিনোকিও চললো স্কুলে। আবার তার পথ আটকালো শেয়াল। সুন্দর গলায় বললো, ‘প্রতিদিন স্কুল-টিস্কুল করতে ভালো লাগে খোকা! চলো তোমাকে মজার দ্বীপে নিয়ে যাই।’
পিনোকিও তার প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে ভাবলো, ‘তাই তো! স্কুল কোনো যাবার জায়গা হলো’। যেই কথা সেই কাজ। স্কুলের রাস্তা ফেলে দু’জন যেতে লাগলো মজার দ্বীপে। যেতে যেতে কিছু বুঝে উঠার আগেই শেয়াল পিনোকিওকে বেচে দিল গাধার গাড়ির চালকের কাছে।
গাড়োয়ানের গাড়ি টেনে চলেছে ছয় গাধা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোটো ছোটো ছেলেদের মন ভুলিয়ে বা চুরি করে নিয়ে আসাই তার কাজ। গাড়ি চলছে ফেরি ঘাটে, সেখান থেকে পৌঁছে গেলো মজার দ্বীপে।
সেখানে অনেক বন্ধু জুটলো পিনোকিওর। কারও কান কুলোর মতো বড়, কারও দাঁত কোদালের মতো বড়, কারও লেজ নারকেল পাতার মতো লম্বা। তাই দেখে পিনোকিও বুঝতে পারলো, ছয় গাধা আসলে কোথা থেকে এসেছে? ভাবতে ভাবতে সে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, ততোক্ষণে তারও ছোট্ট একটা লেজ গজিয়ে গেছে।
এদিকে পিনোকিওর পিছু ছাড়েনি ঝিঁঝিঁ জেমিনি। পেছন পেছন সেও চলে এসেছিলো মজার দ্বীপে। সব দেখে জেমিনি চেঁচিয়ে বললো, ‘আর দেরি করো না পিনোকিও, জলদি বেরিয়ে এসো আমার সঙ্গে।’ পুরোপুরি গাধা হয়ে যাবার আগেই মজার দ্বীপের লোহার বড় দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো তারা।
তারপর পাহাড়ের উপর দিয়ে ঝাঁপ দিলো সাগরে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে এসে পৌঁছলো তীরে। গেলো জেপেতোর পুতুল কারখানায়।
কিন্তু জেপেতো কোথাও নেই। পিনোকিও বললো, ‘বাবার কোনো বিপদ হতে পারে।’ জেপেতোকে বাঁচাতে পিনোকিও আর জেমিনি আবার ঝাঁপ দিলো সাগরে। শুরু করলো খোঁজাখুঁজি। এক সময় তারা গভীর সাগরের তলে পেয়ে গেলো তিমিকে।
সাগরের নিচে আরাম করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলো তিমি। শব্দ শুনে বিশাল মুখের একটু ফাঁক করেছিলো সে। আর সেই ফাঁকে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক ঝাঁক মাছ। ঢেউয়ের তোড়ে পিনোকিও ঢুকে গেলো তিমির পেটে।
তিমির পেটের ভেতর ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলো জেপেতো। হঠাৎ তার ছিপে টান পড়লো। সুতা গুটিয়ে এনে অবাক হয়ে গেলো জেপেতো, বড়শিতে ঝুলছে পিনোকিও!
জেপেতোকে দেখে কেঁদে ফেললো পিনোকিও। বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কোনোদিন আমি মিথ্যা বলবো না।’
তারপর দু’জনে মিলে বের হবার পথ খুঁজতে লাগলো। তিমির পেটে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো তারা। তাতে তিমির নাকে হাঁচি এলো। তিমি হাঁচি দিলো। আর অমনি সাগরের বুকে ছিটকে পড়লো পিনোকিও আর জেপেতো।
তারপর ঝিঁঝিঁ জেমেনিকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে ফিরে এলো তারা। পিনোকিও আর কোনদিন স্কুল ফাঁকি দিলো না। এখন প্রতিদিন সকালে সে সেজেগুজে স্কুলে যায়।
অনুবাদকের কথা: ইতালিয়ান শিশুসাহিত্যিক কার্লো কলোডির লেখা রূপকথা ‘দ্যা অ্যাডভেনচার্স অব পিনোকিও’। ১৮৮৩ সালে ‘দ্যা টেইল অব অ্যা পাপেট’ নামে এ বইটি প্রকাশিত হয়। শিশুদের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে এটি গল্প আকারে প্রকাশিত হলো।