মায়ের নামে জার্সি

আচ্ছা তোমরা কি জানো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মায়ের নাম কী? অথবা তোমার বন্ধু যে প্রতিদিন তোমার সঙ্গে খেলতে আসে? যত সহজে আমরা কারও বাবার নাম জানি, মায়ের নাম জানাটা কিন্তু তত সহজ নয়।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2016, 10:51 AM
Updated : 29 Oct 2016, 04:13 PM

মায়েরা আমাদের জীবনে খুব জরুরী, এটা আমরা কে না জানি! মাকে ছাড়া আমরা চলতেই পারি না। খেতে, ঘুমাতে, স্কুলের কাজ করতে, বলতে গেলে বেঁচে থাকতেই আমাদের মাকে আগে। আমরা যদি সব কাজ একসময় একা করা শিখেও ফেলি, তাও মাকে আমাদের চাইই চাই।

অথচ দেখো আমরা যদি কারও নাম জিজ্ঞেস করি শুনবে কারও নাম, সাদিয়া জামান, কারও বা রবিউল ইসলাম, কারও আশফাক রহমান। মোট কথা আমাদের মধ্যে অনেকেরই, আসলে বলতে গেলে বেশিরভাগ মানুষেরই নামের পিছনে থাকে বাবার নামের বা বাবার পরিবারের পদবীর অংশ। এই অংশ থেকে চট করে বলে ফেলা যায় একজন মানুষের বাবার নাম কী। যেমন, আমাদের ক্রিকেট দলের অধিপতি মাশরাফি বিন মর্তুজার কথাই ধরো। উনার নামের অংশ থেকেই তুমি বুঝবে উনার বাবার নাম ঘুরেফিরে কিছু একটা মর্তুজাই হবে। তবে মজার কথা কি জানো? আমাদের টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের বাবার নাম কিন্তু রহিম না। মুশফিকুর রহিমের মায়ের নাম হল, রহিমা খাতুন। সেই নামের অংশ আমাদের মুশফিকুর রহিম সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। দারুণ না ব্যাপারটা?

তবে সবাই মুশফিকুর রহিমের মায়ের মতো পরিচয় পান না। সামাজিক নানান প্রথায় আমাদের মায়েদের নাম কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অনেক মা একটা সময় ভুলেই যান তার নিজের নাম কী ছিল। সবাই তাকে অমুকের মা, তমুকের স্ত্রী ইত্যাদি নামে চিনে থাকেন।

আমাদের দেশে যদিও ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সরকারী নথি-পত্রে বাবার নামের সঙ্গে মায়ের নামও লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারপরেও নাম শুধু কাগজপত্রে থাকলে হবে না। নামটা সবার চোখের সামনে থাকালে তবেই না সবাই জানবে।

সুজাতার ছেলে মাঠে খেলছে, তোমরা কি জানো তার নাম কী?

সবাই যখন এভাবে নিজ নিজ মায়ের পরিচয় সামনে তুলে আনার চেষ্টা করছে, তখন ভারতীয় ক্রিকেট দল খুব ভালো একটা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। ভারতের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের পাঁচ ম্যাচের একদিনের একটি ক্রিকেট সিরিজ চলছে। আজকে সেই সিরিজের পঞ্চম এবং শেষ ম্যাচ। ভারতীয় ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ঠিক করেছেন, রোজ রোজ তো আমরা বাবার নাম নিয়েই মাঠে নামি, সবাই আমাদের বাবার নামেই চিনে, আমাদের মায়েদের নাম তো কেউই জানে না প্রায়। তাই আজকে তারা সবার জার্সির পিছনে যার যার মায়ের নাম নিয়ে খেলতে নেমেছে।

তোমরা তো জানোই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচগুলো অনেক বড় পরিসরে হয়। সারা পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ এই খেলা দেখেন, এই খেলার সঙ্গে নানানভাবে যুক্ত করেন। তাই সুন্দর একটা ধারণা প্রকাশ এবং প্রচার করার জন্য এই ধরণের ম্যাচগুলো শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। নিজেদের জার্সির পেছনে মায়ের নাম যুক্ত করে ভারতীয় ক্রিকেটাররা আসলে পরিবারে মায়ের অবদানকে স্বীকার করা এবং তাকে ধন্যবাদ জানানোর একটা উপায় তৈরি করেছেন।

এ বছরই ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একদিনে ম্যাচ খেলতে নেমেছিল গোলাপি রঙের জার্সি পরেছিল। এমনিতে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের জার্সির রঙ সবুজ। যতবারই জার্সির নকশা বদল হয়েছে এই সবুজকেই প্রাধান্য দিয়ে নতুন জার্সির নকশা করা হয়েছে। কিন্তু রাতারাতি গোলাপি জার্সি পরায় অনেকেই বিষয়টায় অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়েছে। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দল জানিয়েছে, তারা আসলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে এই গোলাপি রঙের জার্সি পরেছে।

মায়ের নাম পিঠে লাগিয়ে বেজায় খুশি ভারতীয় ক্রিকেট দল।

এতে হয়েছিল কী জানো? যারা মোটেই ব্রেস্ট ক্যান্সারের কথা জানতো না, বা যারা জানতো কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব সেভাবে অনুধাবন করতে পারেনি তারা বিশেষ করে বিষয়টাতে সচেতন হয়, যে একটা ক্রিকেট দল যখন বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার তাহলে অবশ্যই তা গুরুতর কিছু। আবার ক্রিকেটারদের অনেকেই খুব পছন্দ করেন। তাদের কথার গুরুত্বও অনেক বেশি। তাই কেউ যদি বিষয়টাকে মানতে রাজিও না হন, প্রিয় ক্রিকেটার বললে কথাটার প্রতি সে যত্নশীল হন।

আমরা যে সময়টাতে বর্তমানে আছি, সেখানে সারা পৃথিবীতেই মায়েরা বা নারীরা একটু পিছিয়ে আছেন। এ পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ রয়েছে। তবে পিছিয়ে পরার ফলে যেটা হয়েছে তা হল, নারীরা সমাজ থেকে সেই সব সুবিধা সব সময় পান না যেটা একজন মানুষের পাওয়া উচিত।

তোমরা হয়তো জানো, পৃথিবীর অন্য সব দেশে থেকে আমাদের উপমহাদেশীয় অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতের কিছু অংশ মেয়েদের অবস্থান একটু বেশি খারাপ। মেয়েরা সেখানে শুধুমাত্র মেয়ে বলে রীতিমতো নির্যাতনের শিকার হয় এবং এর বিরুদ্ধে তারা খুব বেশি প্রতিবাদও করতে পারে না কারণ সমাজে আসলে তাদের সেই অবস্থানটাই নেই।

আজ মাঠে খেলতে নামার আগে টসের সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছেন, “মায়েদের অবদান একজন সৈনিকের অবদানের সমান গুরুত্বপূর্ণ”। তবে ভারতীয় অধিনায়কের আজকে নাম কিন্তু ধোনি নয়। আজকে তার নাম ‘দেভাকি’। ‘দেভাকি দেভি’ ধোনির মায়ের নাম। আর ধোনি আসলে তার বাবার নামের পদবী।  

স্টার ইন্ডিয়ার একটা প্রচারণা ‘নায়ি সোচ’ বা বাংলায় বললে 'নতুন চিন্তাধারা’র অংশ হিসেবে ভারতীয় দলের আজকের এই মায়ের নাম গায়ে জড়িয়ে মাঠে নামা। হয়তো এভাবে একদিন মায়েরাও দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন নিজেদের পরিচয় নিয়ে। সেদিন আর তাদের কেউ শুধু অমুকের মা বলে চিনবে না, বরং সত্যি সত্যি কেউ জীবনে খুব বড় কিছু হতে পারবে সে গর্ব করে বলতে পারবে, কারণ আমি অমুকের সন্তান।

ছবি কৃতজ্ঞতা: বিসিসিআই