মোসলেহ উদ্দীন সাহেব মহল্লার সবার ছোট বড় সবার দাদু। রাস্তার শেষ মাথার ছোট্ট একটা দোতালা বাড়িতে একাই থাকেন, সঙ্গী বলতে একটা কুকুর আর ঘর ভর্তি বই। তিনি ইদানিং কালের মানুষদের মতো বাড়িটা এপার্টমেন্টওয়ালাদের হাতে তুলে দেননি। বাড়ির চারপাশে নানা রকমের গাছ পালা ঘেরা সাদা বাড়িটা দেখলেই খুব শান্তি শান্তি লাগে। বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁর খুবই বন্ধুত্ব। সুযোগ পেলেই বাচ্চারা চলে আসে দাদাইর বাড়িতে, কোনোদিন চলে সামনের লনে খেলা, কোনদিন গল্প শোনা আবার কোনদিন প্রজেক্টরে মজার সব সিনেমা বা ডকুমেন্টরি দেখা।দাদাই গল্প এক আশ্চর্য গুপ্তধন। ওরা মাঝে মাঝেই আবদার ধরে সেই সব গল্প শোনার।
Published : 11 Oct 2016, 03:39 PM
নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ, সকাল-সন্ধ্যা শিউলী ফুলের গন্ধ শরতের জানান দিচ্ছে। বছরের এই সময়টা মোসলেহ উদ্দীন সাহেবের খুব প্রিয়। বর্ষার পানি নেমে গিয়ে চারিদিকে সবুজ ঘাস আর বুনো গাছপালার খুব ফূর্তির চলছে। সাদা কাশফুলের দল বলে দিচ্ছে দুর্গা পূজার দিন চলে এসেছে। তাদের মহল্লা সার্বজনীন পূজা হয়, বাঁশের চালা ঘর বেঁধে সেখানে প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে। বাচ্চার দল প্রতিদিন তাই দেখার জন্য ওখানে কিছু সময়ের জন্য ভীর জমায়; আরতি করা, অঞ্জলি দেওয়া মাঝে মাঝে গান নাচের মধ্যে তাদের পাওয়া যায়। মোসলেহ উদ্দীন সাহেব তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে প্রতিদিন এসব দেখেন, তাঁর নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পরে যায়। একদিন ওদের দেখে মনে হলো কী নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুব তর্ক করছে ওরা আর বারবার মন্ডপের দিকে তাকাচ্ছে। মোসলেহ উদ্দীন সাহেবের একটু আগ্রহ হলো ব্যাপারটা জানার জন্য, তিনি ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।
দাদাইকে দেখে টুনু, স্বাতী, বেলী, সব বাচ্চার একসঙ্গে হৈচৈ করে উঠলো। দাদাইয়ের সঙ্গ আর সবার মতো ওরাও খুব পছন্দ করে, কত মজার মজার সব গল্পই না জানেন দাদাই। টুনু বললো, দাদাই তোমাকে এখানে পেয়ে খুব ভাল হলো হল।
- কেন রে আমাকে খুজছিলি কেন? বিলু এগিয়ে এসে মোসলেহ উদ্দীন সাহেবের হাত ধরে বললো, দাদাই বলো তো মহিষাসুরমর্দিনী আর দুর্গা কী একজন।
- একই জন, ভিন্ন ভিন্ন নামে।
বিলু বলল, দেখো দাদাই এই কথাটা ওরা বিশ্বাই করছে না।
-বাহ, এই গল্প তো তোদের কতবার বলেছি। শোন তবে মহিষাসুর ছিলেন একজন অত্যাচারী অসুর, একে দমন করার পর দেবী দুর্গার নাম হলো "মহিষাসুরমর্দিনী"। আর যেই অসুরকে বধ করার পর দেবীর নাম "দুর্গা" নাম হয়েছিল, সে ছিল হিরাণ্যক্ষবংশের এক দানব। এই দানবের নাম ছিল দুর্গম, সে রুরুদৈত্যের পুত্র। অন্যান্য অসুরদের মতো পরাক্রমী তো বটেই, তার উপর সে ছিল খুব নিষ্ঠুর আর চতুর। দুর্গম দৈত্য কে দমন করার পর দেবীর নাম হলো দুর্গা, বুঝলি এবার?
- ঠিক কবে থেকে শুরু হলো তাতো এখনও গবেষকগণ খুঁজে বের করতে পারেননি।
- আর আমাদের বাংলাদেশে? বড় বড় চোখ করে বলল স্বাতী।
- সেটা নিয়েও অনেক মতভেদ বুঝলি? কেউ কেউ বলেন খ্রীঃ ১৫০০ সালে বাংলায় প্রথম দুর্গা পূজা শুরু হয়। কারও মতে দিনাজপুর ও মালদহের জমিদাররা প্রথম দুর্গাপূজা শুরুর পরিকল্পনা নেন। অনেকে বলেন তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম ঘটা দুর্গাপূজা শুরু করেন। কারও দাবি নদীয়ার ভাষানন্দ মজুমদার প্রথম শারদীয়া পূজার সূচনা করেন বাংলায়।
- আর ঢাকায় কবে শুরু হলো? বলল টুনু।
- সেটাও নিশ্চিত নয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নাম তো জানিস, ঢাকার প্রাচীনতম মন্দির। খ্রীঃ ষোড়শ শতকে এখানে কালী পূজার সাথে সাথে দুর্গা পূজাও হতো বলে জানা যায়। ঢাকায় আরেকটা খুব পুরানো, সুন্দর আর অনেক উঁচু একটা মন্দির ছিল রমনাতে, রমনা কালীবাড়ি মন্দির, সেখানেও এক সময়ে কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজাও হত।
- রমনাতে? কই কোনো উঁচু মন্দির তো সেখানে দেখিনি দাদাই। দুইদিকে মাথা নেড়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল বেলী।
অন্যরাও বেলীর সাথে একমত হলো। ওরা কেউই সেখানে কোনো উঁচু মন্দির দেখেনি।
-আহা, সেই মন্দির কী আর আছে? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের গভীর রাতে রমনা কালী মন্দির ও শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রমে হালমা চালিয়ে সেখানকার আনুমানিক দেড়শো মানুষকে হত্যা করে, মন্দিরটাও গুড়িয়ে দেয়। তবে একটা খুব বিখ্যাত ছবিতে কিন্তু সেই মন্দিরের ছবি তোমরা দেখেছো।
- বিখ্যাত ছবি! কোন ছবি, বলো না দাদাই।
- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষনের ছবিতে দূরে এই মন্দিরের চুড়া কিন্তু দেখা যায়। সেই সময় অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিচিত ছিল রেসকোর্স ময়দান নামে, আর এই পাশেই ছিল রমনা কালী মন্দির।
- কে বানিয়েছিল মন্দিরটা দাদাই?
১৮৫৯ সালের ঢাকার এক মানচিত্রে মন্দিরটিকে কৃপাসিদ্ধির আখড়া নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক যতীন্দ্রমোহন রায়ের তাঁর ‘বিবরণ’ নামের একটা বইতে মন্দিরটির বেশ ভাল একটা বর্ণানা দিয়ে গেছেন, তিনি লিখেছেন ‘১২টি সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের বারান্দায় উঠতে হত। বারান্দার মধ্যখানে কাঠের সিংহাসনে ছিল লাল পাড়ের শাড়ী পরা স্বর্ণ মনি-মুক্তার অলঙ্কারে ভূষিত কষ্ঠি পাথরের কালীক ও ভদ্র কালী মূর্তি। এই কালীমূর্তিটি বিক্রমপুরাধিপূত চাঁদরায়ের প্রতিষ্ঠিত বলে জনশ্রুতি আছে।
মন্দিরটির পাশে ছিল একটা আশ্রম, নাম “মা আনন্দময়ীর আশ্রম”। এই আনন্দময়ী ছিলেন ঢাকার নবাবদের শাহবাগ বা রাজকীয় বাগানেরর তত্ত্বাবদায়ক রমনীমোহন চক্রবর্তীর স্ত্রী। মন্দিরের একদম পাশে প্রায় বর্গাকার একটি পুকুর ছিল, এটা করে দিয়েছিলেন ভাওয়ালের মহারানী বিলাসমণি।
১৮৯৭ সালে বাংলাদেশে একটা খুব বড় রকমের ভুমিকম্প হয়েছিল, সেই সময়ে এই মন্দিরটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন এই মন্দিরটি আবার নতুন করে সংস্কার করা হয়েছিল। সেই সময়ে এই এলাকায় উঁচু কোনো ভবন না থাকায় মন্দিরের চূড়া অনেক দূর থেকে দেখা যেতো।
- তারপর কী হলো দাদাই?
-তারপর আর কী! এভাবেই দিন যাচ্ছিল ১৯৭১ সালে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত। এখনও সেখানে পুজো হয় তবে সেভাবে আর মন্দির করা হয়নি। তোরা যদি রমনার কালীবাড়ি যাস তবে গেঁটে ইতিহাস আর মন্দিদের ছবিও দেখতে পাবি।
বেলী বলে উঠলো সান্তনুরা নাকি যাবে চল গিয়ে আমাদের মাকে বলি আমরাও যাবো। বাচ্চারা হই হই করতে করতে রমনার কালীবাড়ি যাওয়ার তাল তুলল। তাদের দাদাই আবার নিজের মতো বইয়ের ভূবনে ঢুবে গেলেন।
ছবি কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভের ফেইসবুক পেইজ।