‘ফিজিক্যাল বইমেলার সঙ্গে চাই ডিজিটাল বইমেলা’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশুকিশোরদের নিয়ে নিজের ভাবনা ও পরিকল্পনা জানাচ্ছেন শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফা।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 12:30 PM
Updated : 31 Jan 2023, 12:30 PM

শিশুকিশোরদের জন্য প্রায় এক যুগ ধরে লিখছেন শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফা, প্রকাশিত হয়েছে গল্প-অনুবাদ-ভ্রমণ কাহিনি-কমিকস-সহ চল্লিশটি বই। পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ইউনিসেফ থেকে মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং কবি হাবীবুর রহমান সাহিত্য পুরস্কার।

লেখালেখির পাশাপাশি আশিক মুস্তাফা দৈনিক সমকাল পত্রিকার ছোটদের পাতা 'ঘাসফড়িং' সম্পাদনা করছেন। এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার তিনটি বই। ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিশুকিশোরদের নিয়ে তিনি তার ভাবনা ও পরিকল্পনা জানাচ্ছেন।

শিশু-কিশোরদের জন্য এবার আপনার কী বই প্রকাশিত হচ্ছে? বিষয়বস্তু কী?

তিনটি বই প্রকাশিত হচ্ছে এবার। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ছোটদের পছন্দের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়েছি। ছোটরা কমিকস পড়তে পছন্দ করে। আর সেই কমিকসটা যদি হয় প্রিয় লেখক ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনভিত্তিক, তবে তো কথাই নেই! নজরুল ইসলামের জীবনভিত্তিক এ বইটি প্রকাশ করছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। এছাড়া সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশ করছে ‘তারা খেলে মিলেমিশে’ শিরোনামের একটি বই। এ বইটি একেবারে ছোটদের জন্য। ছোটরা ঝগড়া করে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে না। খেলায় নেয় না- এমন সব বিষয়কে মাথায় রেখে লেখা হয়েছে বইটি। আর ‘শৈশব’ প্রকাশ করছে ‌'জুটুন মামার বাঘযাত্রা' নামে পাঁচটি গল্পের একটি বই। এ বইয়ের গল্পগুলো ছোটদের ভাবনার খোরাক হবে আশা করি। তাদের সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনায় সহায়ক হবে গল্পগুলো।

বাংলাদেশে শিশুদের জন্য কি বিজ্ঞানবিষয়ক লেখার অভাব রয়েছে মনে করেন? শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে কী করা উচিত?

খুব যে অভাব রয়েছে তা বলবো না। তবে আরও বেশি লেখা উচিত। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিষয়ে অভিজ্ঞদের আরও বেশি বই লেখা উচিত। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর উন্নত এবং উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশেই ছোটদের বই প্রকাশনায় সরকারের বড় একটা ভূমিকা থাকে। সেখানে আমাদের দেশে একেবারে নেই বললেই চলে। শিশু একাডেমি নামমাত্র ছোটদের কিছু বই প্রকাশ করলেও গত চার বছরে তাদের কোন বই-ই প্রকাশ হয়নি, যা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

আর বাংলা একাডেমি তো ছোটদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে একেবারেই উদাস। অথচ এই বাংলা একাডেমি থেকে একসময় বিশ্বের সেরা ক্লাসিক বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেসব এখন অতীত! দিন যতো যাচ্ছে ততো আমরা ছোটদের ক্ষেত্রে উদাসীন হচ্ছি আর তাদের দোষারোপ করছি। শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে শিশু একাডেমির উচিত ছোটদের জন্য বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করা। বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি আরও বেশি বিজ্ঞানবিষয়ক বই প্রকাশ করে সেসব বই স্কুল লাইব্রেরিগুলোতে পৌঁছে দিতে পারে।

একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে শিশুকিশোরদের সৃজনশীল করে তুলতে, বইমেলার দিকে আকৃষ্ট করতে আপনার পরামর্শ কী?

সময় বদলাচ্ছে। এখন ফিজিক্যাল বইমেলার সঙ্গে ডিজিটাল বইমেলায়ও জোর দিতে হবে। গড়তে হবে অনলাইন লাইব্রেরি। বড়রা ছোটদের উপর বই চাপিয়ে দিলে হবে না। ছোটদের পছন্দের বই রাখতে হবে পাঠাগারে। প্রয়োজনে তাদের পরামর্শে বই লিখতে হবে। পাঠাগারে আবোল-তাবোল বই না রেখে ভালো বই এবং আমাদের ক্লাসিকের পাশাপাশি বিশ্ব ক্লাসিকগুলো রাখতে হবে। সেইসঙ্গে একাডেমিক বইয়ের চাপ কমাতে হবে; তবেই শিশুরা সৃজনশীল বইপাঠে মনোযোগী হবে।

বাংলাদেশে 'শিশুসাহিত্য' বলতে যা বোঝায় তা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে কি! কিংবা দুর্বল সাহিত্যিকরাই কি শিশুসাহিত্য চর্চা করছেন এখন? যারা লেখালেখি করেন তারা শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে বা ভাবতে চান না কেন?

সময়ের সাহিত্যের বিচার সময়ে কখনই সেভাবে হয়নি। বর্তমানের শিশুসাহিত্য দুর্বল না সবল তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যুগে যুগে মেধাবীদের সঙ্গে দুর্বলরা সাহিত্যচর্চা করেছে। কার কোন লেখা কখন টিকে যাবে তা সময় ছাড়া কেউ বলতে পারে না। তবে আমাদের এখানে দুর্বল সাহিত্যিকদের হাঁকডাক বেশি। আর সোশ্যাল মিডিয়া যেন সেই হাঁকডাককে বৈধতা দিতে উদার হস্তে বসে আছে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, আমাদের সেরা শিশুসাহিত্য কিন্তু বড়দের জন্য যারা লিখেন বা লিখতেন তারাই লিখে গিয়েছেন। তাই তারা যে ছোটদের নিয়ে ভাবেন না বা লিখেন না তা কিন্তু বলা যাবে না।

সমসাময়িক শিশুসাহিত্য জ্ঞাননির্ভর না হয়ে নিছক বিনোদনমূলক হয়ে পড়েছে কি? কল্পনাশক্তি বাড়ায় না এমন গৌণ বিষয়বস্তুই কি চর্চা করতে শেখানো হচ্ছে তাদের?

শিশুসাহিত্য জ্ঞাননির্ভর হতে হবেই বা কেন? ছোটরা যখন বুঝতে পারে তাকে কেউ শেখাতে চাচ্ছে সে তার আশপাশ মাড়ায় না। আমরা কেবল আমাদের ছোটবেলার কথা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো বিষয়টা। জ্ঞানের জন্য পাঠ্যবই আছে, সাধারণ জ্ঞানের বই এবং গুগল আছে। ছোটদের বইগুলো কেবলই তাদের মনের খোরাক ও ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার উপকরণ দিয়ে সাজানো উচিত। তবে বর্তমানে যে কেউ বই প্রকাশ করে ফেলছে। বইমেলা এলে মৌসুমী লেখক দেখা যায় অনেক, তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে যাচ্ছেতাই বই প্রকাশ করেন আর এ বইগুলো প্রচার করেন মিডিয়ায়। পাঠক এগুলোকে বই ভেবে যদি গড়পড়তা বইয়ের বিচার করেন তা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার হাতেগোনা দু-একটা প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া তেমন কারোরই নেই সম্পাদনা বিভাগ। অনেক প্রকাশক তো কম্পিউটার কম্পোজার থেকে প্রকাশক হয়েছেন, তারা সম্পাদনার কী বুঝবেন! এমন তুঘলকি কাণ্ড ছোটদের বই প্রকাশনায় হলে সৃজনশীলতা বাড়বে কেমন করে! অথচ ছোটদের বইয়ে প্রতিটি শব্দের কথা চিন্তা করা উচিত।

দৈনিক পত্রিকাগুলোতে শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন বা বিভাগের এমন শীর্ণদশার কারণ কী?

পত্রিকায় একসময় ছোটদের কথা ভাবা হতো নৈতিক দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে। এখন ভাবা হয় ব্যবসায়িক দিক মাথায় রেখে। ফলে এমন শীর্ণদশা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। বিজ্ঞাপনের কথা মাথায় রেখে এবং খরচ কমাতে বেশকিছু পত্রিকা ছোটদের পাতা তো বন্ধই করে দিয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলোতেও পড়ে বিজ্ঞাপনের থাবা! তবু দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছোটদের পাতা যে খুব খারাপ হচ্ছে তা বলা যাবে না।

এখনকার শিশু-কিশোররা গেজেট ব্যবহার করতে শিখছে। শুধু আঙুলের টোকায় খুলে যাচ্ছে পৃথিবী। বিষয়টা কীভাবে দেখেন?

এটা মেনে নিতেই হবে। একসময় পুতুল বিয়ে দিতো শিশুরা। সেই দিন বদলেছে। এটাকে নেতিবাচভাবে দেখার কিছু নেই। বরং শিশুসাহিত্যিকদের এবং শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এ পরিবর্তনটাকে ধারণ করে ছোটদের নিয়ে কাজ করতে হবে। আর যদি এ পরিবর্তন মেনে না নিতে পারে বড়রা এতে শিশুরা বখেই যাবে।

জ্ঞানচর্চার জন্য শুধু মাতৃভাষা জানা ও চর্চা কি শিশু-কিশোরদের জন্য যথেষ্ট?

না। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা কখনই যথেষ্ট ছিলো না। জ্ঞানীদের অসংখ্য ভাষা জানতে হয় এটা স্বাভাবিক। প্রযুক্তির কল্যাণে ছোটরা এখন কথা বলা শুরুই করে দু-তিনটি ভাষা মিলিয়ে, যতো ভাষা শিখবে তত তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকবে। তবে কখনই মাতৃভাষা ভোলা যাবো না। অবজ্ঞা বা অবহেলার চোখে দেখা যাবে না। এ শিক্ষাটা পরিবার থেকে দিতে হবে।

আমাদের দেশে শিশুসাহিত্যকে বা শিশুদের নিয়ে যে কোন উদ্যোগকে ‘বড়দের ছোট সংস্করণ' ভাবার একটা প্রবণতা আছে, শিশুদের যে আলাদা একটা পরিপূর্ণ জগৎ আছে সেটা অবহেলা করা হয়, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

এর প্রধান কারণ তথাকথিত মাথা মোটাওয়ালাদের ওপর নির্ভরশীলতা। ছোটদের জন্য যা-ই করা হয় তাতে ছোটদের যেমন অংশগ্রহণ প্রয়োজন তেমনি যারা ছোটদের নিয়ে কাজ করেন তাদের যুক্ত করা উচিত।

শিশু-কিশোরদের জন্য আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?

আসলে পরিকল্পনা করে লেখা হয় না। তবে সামনে ছোটদের ভ্রমণ নিয়ে একটা বইয়ের কাজ করছি। বর্ণমালার একটা সিরিজেরও কাজ চলছে। সেইসঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনী লিখছি ছোটদের জন্য।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!