Published : 01 May 2025, 01:36 PM
অন্যদিকে শরণখোলা থানার ওসি সাহেবের নির্দেশ অনুযায়ী নৌপুলিশের দলটি সেলা নদী দিয়ে উজানের দিকে বা উত্তর দিকে আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। রাত বেড়ে তখন মধ্যভাগ শুরু হয়েছে। আকাশের ঘন মেঘে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকায়, অন্ধকারের বুকে সোনালি আলোর রেখাপাত তৈরি করে। বনের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা নদীর জল সে আলোতে তখন কালো কালির মতো দেখায়। নৌপুলিশের স্পিডবোট বিশেষ হেডলাইট জ্বালিয়ে সে কালো পানির বুক চিড়ে, সফেদ ফেনিল ঢেউ তুলে সশব্দে দ্রুত গতিতে ছুটে চলে।
হরিণটানা ক্যাম্প পেরিয়ে তারা এখন তাম্বুলবুনিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নৌপুলিশের দলনেতা খান মোহাম্মদ ফিরোজ, কিশোরদলের অবস্থান জানার জন্য ওসি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেন। না, এখনো তাদের কোনো অবস্থান জানা যায়নি। এ খবরে দলনেতার চোখেমুখে বিষণ্নতা দেখা দেয়। নিজের সন্তানের মুখটা মনে ভাসে। তার বড়ো ছেলে এবার ক্লাস সেভেনে পড়ছে। যতটুকু জানতে পেরেছে, হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলোর বয়সও এমনই।
খারাপ কিছুর আশঙ্কায় ফিরোজ সাহেবের বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা খেলা করে। কিশোরদের মা-বাবার মনের অবস্থাটা অনুভব করেন বা অনুমান করেন তিনি। পরক্ষণেই ছেলেগুলোর উদ্ধার-সংকল্পে চোয়াল শক্ত হয় তার। বনের এই অংশের চাঁদপাই রেঞ্জ ও শরণখোলা রেঞ্জের প্রতিটি নদী-নালা-খাল তার হাতের তালুরেখার মতোই চেনা। তাছাড়া ভেতরের পথগুলোও অনেক পরিচিত। যেভাবেই হোক পথভোলা কিশোরদের উদ্ধার করতেই হবে।
এসময় হঠাৎ গুলির শব্দে বন্যপ্রাণীদের কলতান চৌচির হওয়ার সাথে সাথে নৌ-পুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেবের ভাবনার সুতোটিও ছিঁড়ে যায়। বোট তখন সেলা নদীর চরই খাল ও বেতমোর গাঙের তাম্বুলবুনিয়া পয়েন্টের চৌমোহনায়। একদম অপ্রত্যাশিত গুলিতে বা গুলির শব্দে চালক খেই হারায় এবং স্পিডবোট নদীর মোহনায় পাক খায়। আচমকা এমন ঘটনায় বোটে থাকা সবাই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, নড়েচড়ে ওঠে। কিন্তু প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা খুব তাড়াতাড়ি সেসব সামলে নিয়ে সচকিত হয়।
এসময় কারা গুলি করতে পারে তা বুঝতে তাদের খুব বেশি সময় লাগে না। ডাকাতের উৎপাত এখানে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে পালিয়ে না গিয়ে বা চুপচাপ না থেকে হঠাৎ গুলি করার কারণটা তারা বুঝে উঠতে পারে না। সেসব বুঝতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে, গুলির উৎস বা আগমনের দিক লক্ষ্য করে তাদের সাথে থাকা অস্ত্রগুলোও মুহূর্তেই সচল হয়ে ওঠে। গুলি করতে করতে ফিরোজ সাহেব স্পিডবোট ঘুরিয়ে গুলির উৎসের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন।
দলনেতার নির্দেশে চালক গুলির উৎস চরই খালের দিকে বোট ঘুরিয়ে এগিয়ে যায়। নৌ-পুলিশ বাহিনীর গুলির প্রতিউত্তরে ওদিক থেকে তখন আরও গুলি আসতে শুরু করে। দুদিকের গোলাগুলিতে রাতের স্বাভাবিক জীবনের শান্ত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আশপাশের গাছ থেকে ঘুম ভাঙা পাখিরা ডানা ঝাপটে বিভিন্ন দিকে উড়ে যায়। অন্যান্য প্রাণীদের ছোটাছুটি দেখা না গেলেও অনুমান করা যায় সহজেই।
চরই খালের দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই স্পিডবোটের হেড লাইটের শেষ প্রান্তে ডাকাতদলের ছোট ট্রলারটা দৃশ্যমান হয়। চোখে পড়ে। সাহসী ও চৌকস নৌ-পুলিশদের গুলির তোপের মুখে ডাকাতদলের নৌকা তখন দ্রুত পিছু হটতে শুরু করেছে। তবে পালাতে শুরু করলেও, ডাকাতেরা গুলি করা বন্ধ করেনি। তখনও তারা গুলি ছুড়তে থাকে। ডাকাতদের গুলি থেকে বাঁচতে নৌ-পুলিশদের বোটের চালক এঁকেবেঁকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। আর নৌ-পুলিশরা বিশেষ কায়দায় নুয়ে পড়ে নিজেদের বাঁচিয়ে ডাকাতদের গুলির উত্তরে বিরামহীনভাবে গুলি ছুড়তে থাকে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই স্পিডবোটের গতির সাথে ট্রলার গতিতে পেরে উঠে না। দ্রুত ট্রলার ও স্পিডবোটের মাঝের দূরত্ব কমে আসে। দূরত্ব কমে আসলে নৌ-পুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেব ট্রলারের মাঝিকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। বোটের হেড লাইটের আলোয় ট্রলারের মাঝিকে দাঁড় ছেড়ে, একহাত দিয়ে আরেক হাতের বাহু চেপে ধরে হেলে পড়তে দেখা যায়। গোলাগুলি ও স্পিডবোটের শব্দে মাঝির চিৎকার এদিক থেকে নৌ-পুলিশরা কেউ শুনতে পায় না। তবে তারা দেখতে পায়, মাঝি পড়ে যাওয়ার পরপরই ট্রলারটা খালের বাঁকে এসে সোজা চলতে গিয়ে গোত্তা খেয়ে পাড়ে ধাক্কা খায় এবং ডাঙায় অনেকখানি উঠে গিয়ে থেমে যায়।
এটা দেখে বোট চালক দ্রুত ইঞ্জিন বন্ধ করে গতি কমায়। ট্রলারের গাঁ ঘেঁষে ডাঙায় বোট ভিড়ায়। কিন্তু ততক্ষণে পড়ি-মরি করে ডাকাতেরা লাফিয়ে নেমে অন্ধকার বনের ভেতর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নৌ-পুলিশরা ট্রলারে ওঠে। ছাদ বা ছইয়ের ভেতর একজনকে পাওয়া যায়। তার দুই হাত পিছমোড়া করে একটা খুঁটির সাথে বাধা। চোখ-মুখ গামছা দিয়ে প্যাঁচানো। দেখেই বোঝা যায়, জেলে। আরেকজনকে পাওয়া যায় ছইয়ের ওপর, আহত ট্রলার চালক। সে ট্রলারের ছইয়ের কাঠের সাথে কাপড় আটকে এক প্রকার ঝুলে আছে।
তারা জেলেকে উদ্ধার করে ট্রলারে আরও খোঁজাখুঁজি করে। না, আর কাউকে কোথাও পাওয়া যায় না। তবে পাটাতনের নিচে কিছু দেশীয় অস্ত্র যেমন, ছুরি, চাপাতি ও রামদা পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায়, জেলেদের কাছে থেকে ডাকাতি করে নেওয়া মাছ। নৌ-পুলিশরা এক কাজে এসে আরেক কাজে আটকে পড়েছে। তবে এটাও একটা বড় কাজ হয়েছে। নৌ-পুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটা সংক্ষেপে রিপোর্ট করেন। তারপর সবাইকে তাড়া দেন। ট্রলার নিয়ে তাদের পিছু পিছু আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে আসার জন্য দুজন নৌ-পুলিশকে দায়িত্ব দেন। আর আহত ট্রলার চালক-ডাকাতকে ও উদ্ধার করা জেলেকে স্পিডবোটে নিয়ে বাকি নৌ-পুলিশরা আগে আগে চলতে শুরু করে।
এখান থেকে আন্দারমানিক আরও অনেকটা পথ। এখন পর্যন্ত ওসি সাহেবের কাছ থেকে কিশোর দলের ব্যাপারে কোনো খবর আসেনি। যেতে যেতে এই ফাঁকে জেলের কাছ থেকে ঘটনা শুনেন ফিরোজ সাহেব। আর কয়েকজন নৌ-পুলিশ মিলে ডাকাতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে শুরু করে। গুলি তার কনুইয়ের ওপরের দিকে, বাহুর একদিক দিয়ে প্রবেশ করে মাংস ছিদ্র করে অন্যদিক দিয়ে চলে গেছে। অল্পের জন্য হাড়ে লাগেনি। রক্ত থামানোর চেষ্টা চলছে। রক্তটা থামলেই ব্যান্ডেজ করা হবে। সুঠাম দেহের ডাকাত এই আঘাতের প্রাথমিক ধাক্কা দ্রুতই সামলে ওঠে। পানি চাইলে তাকে এক বোতল পানি দেওয়া হয়। ঢকঢক করে পুরো আধা লিটার পানি সে এক নিমিষেই শেষ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর রক্ত পড়া বন্ধ হতেই ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর ফিরোজ সাহেব এসে ডাকাতের কাছ থেকেও বৃত্তান্ত শুনেন।
স্পিডবোট দ্রুত গন্তব্যে ছুটে চলে। নৌ-পুলিশদের দলনেতা ফিরোজ সাহেব ফিরে এসে বোটের সামনে বসে চারদিকে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখেন। মনের ভেতর কিশোরদলের জন্য উদ্বেগের পাশাপাশি ঘটনাক্রমে একজন জেলেকে ডাকাতদের হাত থেকে উদ্ধার করার আনন্দ দোল খায়। ডাকাত ও জেলে দুজনের সাথে কথা বলে যতটুকু যা জানতে পেরেছেন, মনে মনে সেগুলো আরেকবার জোড়াতালি দেন। সংক্ষেপে ঘটনা যা দাঁড়ায় তা এই বনাঞ্চলের নিত্যকার ডাকাতির ঘটনার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ডাকাতরা প্রায়ই জেলেদের নৌকা ডাকাতি করে মাছ কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি এক বা একাধিক জেলেকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। এই জেলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
গতরাতে টিয়ার চরের কাছ থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে জেলেদের নৌকা ডাকাতি করেছিল ছয়-সাতজনের ছোট ডাকাতদলটি। আর এই জেলেকে আটকে রেখেছিল মুক্তিপণের জন্য। আজ রাতেই তার পরিবারের লোকজনের মুক্তিপণের টাকা নিয়ে আসার কথা। কিন্তু এরমধ্যে নৌপুলিশের স্পিডবোট দেখে ডাকাতরা ভড়কে যায় এবং তাদের সর্দার রেগে যায়। সে ভেবেছিল, জেলেটার পরিবার টাকা না এনে, নৌ-পুলিশ নিয়ে এসেছে। সেজন্য রেগে ডাকাত সর্দার নৌ-পুলিশদের লক্ষ্য করে গুলি করে এবং বাকি কাণ্ড ঘটে। নৌ-পুলিশদের দলনেতার এসব ভাবনার মাঝেই বড় বড় পাতলা ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। সামনেই আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের বাতিগুলো দেখা যায়। আর দু’এক মিনিটের পথ বাকি।
চলবে...