ইতিহাস
১৭৭৩ সালে সেই জামরকে ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীরা তার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়।
Published : 22 Dec 2024, 02:05 PM
ইতিহাসে তার নাম জামর। হয়ত প্রকৃত নামটা ছিল ‘জমির’। ১৭৭৩ সালে সেই জামরকে ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীরা তার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়। লুই তাকে তার উপপত্নী মাদাম দ্যু বারির (১৭৪৪-১৭৯৩) কাছে উপহার হিসেবে দেন। দুই দশক পর সেই জামর ফরাসি বিপ্লবে অংশ নেয়। এটাই সেই অবিশ্বাস্য গল্প!
এ গল্পে রয়েছে যুদ্ধনাটকের সব উপাদান- একজন রাজা, তার সুন্দরী উপপত্নী, একজন দাস, বিপ্লব, আনুগত্য এবং শেষমেশ বিশ্বাসঘাতকতা। তবে এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন বর্তমান বাংলাদেশের এক তরুণ ছেলে, যাকে মাত্র ১১ বছর বয়সে তার জন্মস্থান থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং যিনি কখনো ভাবেননি যে তার ভবিষ্যৎ ইউরোপীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, ফরাসি বিপ্লব।
তো, উপপত্নী মাদাম দ্যু বারিকে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই এক তরুণ দাস উপহার দেন। ছেলেটি তার পরিচারক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মাদাম তার প্রতি বিশেষ স্নেহ গড়ে তোলেন এবং তাকে শিক্ষিত করে তোলেন। এই শিক্ষা সেই তরুণের মধ্যে এমন আদর্শ তৈরি করে যা শেষ পর্যন্ত মাদামের সর্বনাশ ডেকে আনে। কিন্তু তার আগে জেনে নিই, কে ছিলেন এই তরুণ?
ফ্রান্সে পৌঁছানোর পর জামরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয় এবং তার নাম রাখা হয় ‘লুই-বেনোয়া’। তবে তার জন্মস্থান ছিল পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে, চট্টগ্রাম, বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ)। ধারণা করা হয়, তিনি সম্ভবত সিদ্দি বংশোদ্ভূত ছিলেন। জামর নিজেই পরে বলেছিলেন, তিনি মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা সুবাহতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যখন তার বয়স প্রায় ১১, তখন ব্রিটিশ দাস ব্যবসায়ীরা তাকে অপহরণ করে ইউরোপে নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে জামর মাদাগাস্কার হয়ে ফ্রান্সে পৌঁছান এবং দাস হিসেবে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে বিক্রি হন। রাজা তাকে ১৭৬৯ সালের দিকে মাদাম দ্যু বারি নামে পরিচিত রাজকীয় উপপত্নীর কাছে উপহার হিসেবে দেন। মাদাম দ্যু বারির নিজের গল্পও ছিল রোমাঞ্চকর। এক ফরাসি দর্জি ও এক পাদ্রির সন্তান মাদাম দ্যু বারি, সৌন্দর্যের কারণে রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের নজর কাড়েন। তার সোনালি চুল, উজ্জ্বল নীল চোখ এবং তুষারসাদা ত্বক ছিল।
মাদাম দ্যু বারি জামরকে পরিচারক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে খুব তাড়াতাড়ি তিনি তার প্রতি স্নেহশীল হয়ে ওঠেন এবং শিক্ষিত করে তোলেন। জামরকে সুশোভিত পোশাক পরিয়ে সব সময় নিজের পাশে রাখতেন এবং প্রায় পোষা প্রাণীর মতো তাকে প্রদর্শন করতেন। তবে ইতিহাসের অন্য ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে যে, জামর নিজেই দর্শনচর্চা শুরু করেন এবং রুশোর বই পড়তেন।
মাদাম দ্যু বারি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তার প্রথম ভালোবাসা ছিল তার কুকুর দরিন, যে সোনার বাটিতে কফি পান করত। জামর দরিনকে পছন্দ করতো না, তাকে দরিনের কফি পরিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জামর ছিল মাদামের ‘দ্বিতীয় প্রিয় বস্তু’। মাদাম মনে করতেন জামর একজন তরুণ আফ্রিকান। আসলে সেটা ছিল ভুল ধারণা।
তবে তাদের সম্পর্ক ইতিবাচক ছিল না। জামরকে প্রায়ই ‘তরুণ ভবঘুরে’ এবং ‘বানরের মতো ক্রীড়াপ্রিয়’ বলে উল্লেখ করা হতো, যা কেবল মাদামের বিনোদনের উৎস হিসেবে দেখা হতো। এ ধরনের তাচ্ছিল্যকে অগ্রাহ্য করে জামর নিজের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে মন দেন। বিশেষত জ্যঁ-জ্যাক রুশোর মতো দার্শনিকদের রচনাগুলো তাকে প্রভাবিত করে। একসময় মাদামের প্রতি তার বিদ্বেষ জন্মায় এবং তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রাকে তিনি অপছন্দ করতে শুরু করেন।
১৭৮৯ সালের দিকে জামর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে মাদাম দ্যু বারির ভাগ্যও অনেক পরিবর্তিত হয়। ততদিনে রাজা পঞ্চদশ লুই মারা যান। কিছুদিন পর জামর মাদামের কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে ‘জ্যাকোবিনদের সমাজ’ নামে পরিচিত ফরাসি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে তিনি ‘কমিটি অফ পাবলিক সেফটি’ এবং ‘রেভল্যুশনারি সার্ভেইল্যান্স কমিটি’-তেও যোগ দেন।
বিপ্লবের সময় অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দেশত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। মাদাম দ্যু বারিও তার হারানো গয়না উদ্ধারের অজুহাতে ইংল্যান্ডে যাতায়াত শুরু করেন। জামর তাকে এই কাজ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু তার কথা উপেক্ষা করা হয়। পালটা প্রতিক্রিয়ায় জামর মাদামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। তিনি তার জন্মস্থানকে চট্টগ্রাম, বাংলা হিসেবে উল্লেখ করে বিপ্লবী আদালতে সাক্ষ্য দেন। এই সাক্ষ্যের কারণে মাদামের মৃত্যুদণ্ড হয়।
১৭৯৩ সালের ৮ ডিসেম্বর, মাদাম দ্যু বারি ৫০ বছর বয়সে গিলোটিনে শিরশ্ছেদে মারা যান। মাদামের মৃত্যুর পর জামরও গ্রেপ্তার হন। তবে তার বাড়িতে বিপ্লবীদের বই ও চিত্রকর্ম ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। ছয় সপ্তাহ পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনি ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে যান।
জামর তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান প্যারিসে স্কুলশিক্ষক হিসেবে। ১৮২০-এর দশকের দিকে তিনি প্রায় দারিদ্র্যের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন এবং একটি নামহীন কবরে সমাহিত হন।
জামরকে নিয়ে ‘রেভ দো জামর’ বা ‘জামরের স্বপ্ন’ (২০০৩) শিরোনামে উপন্যাস লিখেছেন ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের। ফ্রান্সের বেশ কয়েকজন শিল্পী এঁকেছিলেন জামরের প্রতিকৃতি। প্যারিসে ল্যুভর জাদুঘরে আছে একটি প্রতিকৃতি, এটি এঁকেছিলেন ফরাসি নারী-শিল্পী মারি-ভিক্তোয়ার লোমোয়ান। এছাড়া জামরের জীবনী নিয়ে ১৯৭৮ সালে ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘লা রু পার্দু’ নামে একটি কমিক উপাখ্যান।