Published : 03 May 2025, 12:42 PM
বাংলা কিশোর কবিতার জন্ম হয় স্বপ্ন আর সহজতার মিলনে। এর শিকড় ছড়িয়ে আছে লোকগাথা, ছড়া ও চারু বাক্যে—যেখানে শিশুরা শব্দে খেলে, ছন্দে দৌড়ায়। শিশুসাহিত্যের শুরুর দিনগুলোতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিশুর উপযোগী পাঠ্য তৈরি করলেও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সেই প্রথম শিল্পী যিনি কিশোরের কল্পনাকে কবিতায় রূপ দিলেন। তার ‘বীরপুরুষ’, ‘তালগাছ’, ‘জুতা আবিষ্কার’, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ কিংবা ‘ছোটো নদী’—এসব কেবল কবিতা নয়, ছেলেবেলার প্রথম সাহিত্য-ভ্রমণ।
তারপর এলেন সুকুমার রায়—বাংলা কিশোর কবিতায় যেন এক বিস্ফোরণ। তার ‘আবোল তাবোল’ কিশোরের মনোজগতে যুক্তিহীন এক যুক্তিবোধ জন্ম দিল। এক দুর্দান্ত সাহস ও শব্দের খেলা দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন—কিশোর কবিতা মানে শিশুসুলভ নয়, বরং এক পরিণত আনন্দের স্বাধীন খেলা। পরবর্তীকালে লীলাবতী মজুমদার, প্রফুল্ল রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আজাদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কিশোরদের জন্যও কবিতা লিখেছেন, যদিও তা কখনো কখনো প্রাপ্তবয়স্ক কাব্যের ছায়াতেই তৈরি।
বর্তমানে, কিশোর কবিতা নতুন আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর খোঁজে। প্রযুক্তি, মহাকাশ, পরিবেশ, সমাজ ও কিশোরদের মনস্তত্ত্ব—সব মিলিয়ে এক বহুরৈখিক জগৎ। এখনকার কবিরা, যেমন মৃদুল আহমেদ বা নতুন প্রজন্মের অনলাইনভিত্তিক লেখকরা, কিশোর কবিতায় যোগ করছেন বাস্তব ও কল্পনার মিশেল, লঘুতা আর লাবণ্য। এমন লক্ষণই দেখা যায় ‘আকাশছেঁড়া ঘুড়ি’ শিরোনামে মৃদুল আহমেদের কিশোর কবিতা সংকলনটিতে।
চলতি বছর অমর একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে ‘শৈশবপ্রকাশ’, অলঙ্করণ করেছেন মং সোনাই। ৩৬ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা। এ বইয়ের আছে ১৪টি কবিতা- ‘গাছের পাতায় শৈশবের খাতায়’, ‘যখন আমি যা চাই’, ‘পাশের বাসার ছেলে’, ‘সুরমা নদীর মাঝি’, ‘তারার দেশের মেয়ে’, ‘রহিম শেখের দাদি’, ‘শরৎ মানেই’, ‘একা’, ‘বৃষ্টি মধুর’, ‘চন্দ্রলতা কানের ফুল’, ‘খুকি’, ‘গল্পের দিন’, ‘আমার সাথে যাবি?’ ও ‘সম্ভাবনা’।
‘গাছের পাতায় শৈশবের খাতায়’ কবিতার একটি পঙক্তি- “শহরের দিন কাটে কোনোমতে বেঁচে-/ মনে পড়ে যায় গ্রাম, কাদা প্যাঁচপেঁচে,/ বাঁশঝাড়, ডোবা খাল, ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যাঙ,/ কানামাছি, ডাংগুলি, ধুলোমাখা ঠ্যাঙ।” পরের পঙক্তি- “চমকিয়ে দিয়ে যায় অতিকায় চাঁদ,/ ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে ডেকে করে প্রতিবাদ।/ শিউলি ও বকুলের ঘুম ঘুম ঘ্রাণ,/ মনে করে কেঁদে ওঠে শহরের প্রাণ।”
এ অনাড়ম্বর কাব্যভঙ্গি কিশোর-কিশোরীদের কল্পনা, কৌতূহল, আর কষ্টগুলোকেও পরিণত করে সৌন্দর্যময় কবিতায়। মৃদুলের কবিতা কেবল শিশুমনোরঞ্জনের সহজ পথ ধরে হাঁটে না, বরং এক পরিপক্ব কিশোর অভিজ্ঞতার নানা বাঁকে আলো ফেলতে জানে। কখনও তা উদ্দীপক, কখনও স্বপ্নময়, কখনও বা মৃদু দুঃখের নরম ঘ্রাণে ভেজা।
মৃদুল আহমেদের কিশোর কবিতায় পাওয়া যায় স্বদেশপ্রেম, প্রকৃতির মমতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা, প্রযুক্তির বিস্ময় আর কল্পনার দুরন্ত ডানা। তার কবিতার ভাষা সরল হলেও তা কখনোই সাদামাটা নয়—ভাষা যেন শিশুর চোখ দিয়ে দেখা বড়দের জগৎ, যেখানে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মধ্যে থাকে এক সূক্ষ্ম দোলাচল। যেমন- ‘তারার দেশের মেয়ে’ কবিতায়, “চায়ের কাপে দিচ্ছি চুমুক/ সন্ধ্যাবেলায় বসে,/ আকাশ থেকে একটা তারা/ পড়ল হঠাৎ খসে!...পড়ল সোজা নাক বরাবর/ বাড়ির ভীষণ কাছে,/ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা/ ঝাঁকড়া ডালিমগাছে”।
এই কবির কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার স্বপ্নগামীতা। তিনি শিশু-কিশোরদের পৃথিবীর বাইরের গল্প শোনান, যেন তাদের কল্পনার পাখা ভেঙে না পড়ে। তবুও, এসব কল্পনার নিচে থাকে বাস্তবের ঘ্রাণ—মানবিক বোধ, মূল্যবোধের পাঠ, আর অন্যের প্রতি সহমর্মিতা। যেমন, ‘বৃষ্টি মধুর’ কবিতায়, “বৃষ্টি আমার ভীষণ ভালো লাগা,/ মেঘের ডাকে সকালবেলায় জাগা,/ শ্যাওলা ধরা বেড়ায় বেয়ে ওঠা/ কাঁপছে সবুজ পুঁই ডাঁটাটার আগা।”
মৃদুল আহমেদের কাব্যভাষা কখনো গীতল, কখনো কথ্যভঙ্গির মতো সাবলীল। তিনি ছন্দ নিয়ে খেলা করতে পারেন, আবার প্রয়োজনে ছন্দকে ভেঙেও নতুন একটি কাঠামো দাঁড় করান। তার কবিতায় সূক্ষ্ম হাস্যরস থাকে, থাকে নাটকীয়তা, কখনো বা এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। আজকের কিশোররা যখন অনেকটাই গ্যাজেটের পর্দায় বন্দি, প্রযুক্তির ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে অবিরাম, তখন মৃদুল আহমেদের কবিতা হতে পারে এক বিকল্প জানালা—যেখান দিয়ে তারা বাতাসের গন্ধ নিতে পারে, ছুঁয়ে দেখতে পারে পৃথিবীর ধুলোমাটির পাঠ, আবার উড়তে পারে স্বপ্নের আকাশে। যেমন ‘সুরমা নদীর মাঝি’ কবিতায়, “সুরমা নদীর মাঝি/ বলল ডেকে,/ আমার নায়ে উইঠবা নাকি বাজি?” পরের পঙক্তি “আমিও গেলাম উঠে,/ বৈঠা ধরে মুঠে মাঝির সাথে তালমিলিয়ে/ গেলাম অনেক দূর,/ ধরল মাঝি গান/ বিষণ্ন এক টান/ মেঘলা আকাশ মাতিয়ে তোলে/ দরাজ গলায় সুর।”
তার আরও কিছু কবিতার পঙক্তি- ‘চন্দ্রলতা কানের ফুল’ কবিতায়, “চন্দ্রলতা কানের ফুল,/ দেখেই তোকে মনের ভুল!/ গেলাম চলে বিজন গাঁয়.../ দাঁড়িয়ে থেকে শহরটায়।” কিংবা ‘খুকি’ কবিতায়, “জানলা দিয়ে হঠাৎ উঁকিঝুঁকি.../এই বাসাতে একটিমাত্র খুকি/ যখন তখন চমকে দিয়ে যায়,/ চঞ্চলতার নূপুর বাজে পায়!”
মৃদুল আহমেদের ‘আকাশছেঁড়া ঘুড়ি’ কিশোর কবিতা সংকলনটি কেবল পাঠ্যসাহিত্যের অংশ নয়—তা এক মনোজগতের পরিসর, একাধারে শিক্ষণীয়, বিনোদনমূলক এবং সাহিত্যিকভাবে সমৃদ্ধ। এ বই পড়ে আজকের ও আগামীর শিশুরা স্বপ্ন দেখতে শিখবে, কিশোরেরা ভাবতে শিখবে, আর বড়রাও হঠাৎ থেমে গিয়ে মনে করতে পারবে ফেলে আসা শৈশবকে, এমনই প্রত্যাশা আমাদের।