ভ্রমণগদ্য
শহরাঞ্চল তো বটেই, ইতালির প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্যাফে ও পাব। সকাল শুরু হয় ক্যাফে ও পাব ভ্রমণের মধ্য দিয়ে।
Published : 01 Oct 2024, 06:37 AM
স্লোভেনিয়াতে আমার বসবাস পশ্চিমের সীমান্তবর্তী শহর নোভা গোরিছাতে। নোভা গোরিছা থেকে একটি ঢিল ছুড়লে সেটি ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গোরিজিয়াতে পড়ে। ইতালির সীমান্তের ধার ঘেঁষে বসবাস করার সুবাদে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশটিকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।
ইতালির বিভিন্ন স্থানে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিভিন্ন ধরনের পুরাকীর্তি। ইতালি পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ, এ তিন দিক থেকে ভূমধ্যসাগর, অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, তিররেনিয়ান সাগর ও আইওনিয়ান সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। গাঢ় নীলাভ জলরাশি এসব সাগরের প্রাণ। নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত, উত্তরের আল্পস পর্বতমালা ও কোমো লেইকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইতালিতে পর্যটকের অভাব হয় না।
শহরাঞ্চল তো বটেই, ইতালির প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্যাফে ও পাব। ইতালিয়ানদের কাছে এসব ক্যাফে ও পাব হচ্ছে আবেগের একটি প্রতিশব্দ। অনেকের আবার সকাল শুরু হয় ক্যাফে ও পাব ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। এক কাপ কফি ও একটি ক্রোসেন্ট (অনেকে আবার বলেন ‘ব্রিওস’) দিয়ে ইতালিয়ানদের অনেকে সকালের নাশতা সেরে নেন।
প্রবীণরা সংবাদপত্র হাতে কোন পাব বা ক্যাফেতে কফি ও ব্রিওসের সঙ্গে সারাদিন পার করে দেন। ছুটির দিন ও কর্মব্যস্ত দিনের অলস সময়ে রেস্তোরাঁ, পাব ও ক্যাফেগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে খোশগল্পে তারা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
ইতালির ক্যাফে ও পাবগুলোতে অনেক বেশি পরিমাণে বিক্রি হয় কফি ও বিভিন্ন ধরনের বেকারি আইটেম। গরমের দিন পাওয়া যায় ‘জেলাতো’ নামে এক বিশেষ ধরনের ফ্রোজেন ডেজার্ট ও ক্রিমা দি কাফে। আর বড়দিনের সময় বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে থাকে ভিন ব্রুলি ও কালদা চকোলাদা।
ইতালির কফিতে এমন কী আছে যা লাখ লাখ মানুষকে মাদকতার আবরণে ঢেকে রাখে? ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি জমির হোসেন বলেন, “ইতালিয়ান কফি বিশ্বের অন্যতম সেরা। এর স্বাদ ও গন্ধ যে কোনো কফিপিয়াসী মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। আমি নিজে প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে কফি পান করছি, তাই এর স্বাদ সম্পর্কে ভালোভাবে জানি।”
তিনি আরও জানান, “ইতালিয়ান কফির মধ্যে কাপুচিনো, এসপ্রেসো ও মাইক্কাতো অন্যতম। এর মধ্যে কাপুচিনোর স্বাদ আলাদা, এটি ঠান্ডায় শরীরকে কিছুটা সময়ের জন্য গরম রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কফির স্বাদ নিয়েছি। সম্প্রতি জার্মানির একটি পাবে কাপুচিনো পান করেছি। তবে ইতালিয়ান কফির তুলনা হয় না।”
ইতালিয়ান কফির সেরা কয়েকটি ব্র্যান্ডের মধ্যে লাভাজ্জা, ইলি, ভেরগানো, সেগাফ্রেডো জানেত্তি, মোরেনো ও কিমবো উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি ব্র্যান্ডের কফির স্বাদ ভিন্ন। এ কফি ব্র্যান্ডগুলো মূলত কফিবিন সংগ্রহ করে ব্রাজিল, কলাম্বিয়া, গুয়েতেমালা, কোস্টারিকা ও ইথিওপিয়া থেকে। ভিয়েতনাম ও ভারত থেকেও সামান্য পরিমাণে কফিবিন সংগ্রহ করা হয়। ব্রাজিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নভূমিতে কফিবিন চাষ করা হয়। এ কারণে এ কফিবিনে অ্যাসিডিটির পরিমাণ কম থাকে।
অন্যদিকে কলাম্বিয়া, গুয়েতেমালা, কোস্টারিকা ও ইথিওপিয়াতে উচ্চভূমিতে কফিবিনের আবাদ করা হয়। এ কারণে এসব দেশে উৎপাদিত কফিবিনে অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে উৎপাদিত কফিবিনে চকোলেট কিংবা অনেক সময় বাদামের ফ্লেভার পাওয়া যায়। অন্যদিকে কলাম্বিয়া, গুয়েতেমালা, কোস্টারিকা ও ইথিওপিয়াতে উৎপাদিত কফিবিন অনেকাংশে ফল কিংবা ফুলের গন্ধযুক্ত।
অনেকের মতে পৃথিবীর সেরা কফিবিন উৎপাদিত হয় ইথিওপিয়াতে। ইতালিয়ানরা খাবার প্রস্তুতের সময় তাজা উপাদান ব্যবহারের চেষ্টা করেন, একইভাবে কফি তৈরির সময়ও যাতে সব সময় তাজা ও সতেজ কফিবিন ব্যবহার করা হয় সে বিষয়ে তারা গুরুত্ব দেয়। তারপর কফিবিনগুলো ভালোমতো ভাজা হয়। এ কারণে কফির স্বাদ অনেক বেড়ে যায়।
এসপ্রেসো হচ্ছে ইতালিয়ান কফির ভিত্তি। এসপ্রেসো তৈরি করার প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে বিভক্ত। প্রথমে, কফির বীজগুলোকে মাঝারি থেকে সূক্ষ্ম আকারে চূর্ণ করতে হয়। সাধারণত, ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম কফি তৈরির জন্য ৭ গ্রাম চূর্ণ করা কফিবিন ব্যবহার করা হয়। তারপর, গুঁড়ো করা কফি পাউডারকে পোর্টাফিল্টারে রেখে টেম্পার দিয়ে সুষম চাপ দিতে হয়। এ প্রক্রিয়া গুঁড়ো করা কফিবিনকে ঘন করে এবং কফিবিনের সঙ্গে জল প্রবাহের জন্য প্রস্তুত করে।
পরবর্তী পদক্ষেপে, পোর্টাফিল্টারটি এসপ্রেসো মেশিনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় এবং এসপ্রেসো মেশিন চালু করে ৯০-৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি গরম করা হয়। গরম পানি পোর্টাফিল্টারের মাধ্যমে কফি পাউডারের সঙ্গে মিশ্রিত হয়। এভাবে নির্যাস প্রস্তুত হয়। এসপ্রেসো তৈরি করার সময় সঠিক তাপমাত্রা, চাপ এবং সময় বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো একটি সুস্বাদু এসপ্রেসোর গুণগত মান নির্ধারণ করে। এক শট এসপ্রেসো বলতে ২৫ থেকে ৩০ মিলিলিটার এসপ্রেসোকে বুঝায়। দুই শট এসপ্রেসোকে একত্রে ‘দোপিয়ো’ বলা হয়।
অন্যদিকে তিন শট এসপ্রেসোকে একত্রিত করলে সেটি হয় ‘লুঙ্গো’। এসপ্রেসোর স্বাদ অনেকটা কড়া ও তেতো প্রকৃতির। এ কারণে আমাদের অনেকের কাছে এসপ্রেসো স্বাদ তেমনভাবে ভালো লাগতে না-ও পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে অবস্থানরত এক মার্কিন সৈনিক এসপ্রেসোর কড়াভাব কমাতে এর সঙ্গে গরম পানি যোগ করেন এবং পরে তা পান করতে শুরু করেন। এভাবে পরিচিতি পায় বিখ্যাত আমেরিকানো কফির। দুই শট এসপ্রেসোর সঙ্গে ৯০ মিলিগ্রাম গরম পানি যোগ করে ‘আমেরিকানো’ তৈরি করা হয়।
এসপ্রেসোর সঙ্গে সামান্য পরিমাণ দুধ মেশালে সেটি হয় ‘মাকিয়াতো’। এক কাপ মাকিয়াতো প্রস্তুতির জন্য দুই শট এসপ্রেসোর সঙ্গে ১৫ মিলিলিটারের মতো ফোমড অথবা স্টিমড মিল্কের প্রয়োজন হয়। দুই শট এসপ্রেসোর সঙ্গে ৬০ মিলিলিটার ফোমড মিল্ক এবং ৬০ মিলিলিটার স্টিমড মিল্ক যোগ করলে সেটি হয় ‘কাপুচিনো’।
অন্যদিকে দুই শট এসপ্রেসোর সঙ্গে ১২০ থেকে ১৮০ মিলিলিটার স্টিমড মিল্ক এবং ৬০ মিলিলিটার ফোমড মিল্ক যোগ করলে সেটি হয় ‘কাফে লাতে’। অন্যদিকে ১২০ মিলিলিটার স্টিমড মিল্কের সঙ্গে ৬০ মিলিলিটার এসপ্রেসোর সংমিশ্রণে তৈরি হয় ‘ফ্ল্যাট হোয়াইট’ বা ‘লাতে মাকিয়াতো’। ৬০ মিলিলিটার এসপ্রেসোর সঙ্গে সমপরিমাণ স্টিমড মিল্ক যোগ করলে তৈরি হয় ‘করতাদো’। ৬০ মিলিলিটার এসপ্রেসো, ৬০ মিলিলিটার কোকো পাউডার ও ৩০ মিলিলিটার স্টিমড মিল্ক সহযোগে তৈরি হয় ‘কাফে মোকা’।
আমরা যারা নিয়মিত দুধ চা খেয়ে অভ্যস্ত, আমাদের জিহ্বার জন্য কাপুচিনো, কাফে লাতে, লাতে মাকিয়াতো, করতাদো ও মোকা সবচেয়ে বেশি উপযোগী। আর আফোগাতো তৈরি করতে ৬০ মিলিগ্রাম এসপ্রেসোর সঙ্গে এক স্কুপ জেলাতোর প্রয়োজন হয়। কফি তৈরির সময় কোনও ধরনের চিনি ব্যবহার করা হয় না। তবে কফি পান করার সময় ক্রেতারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিনি যোগ করতে পারেন।
জেলাতোকে অনেকে ইতালিয়ান আইসক্রিম হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে গতানুগতিক আইসক্রিমের তুলনায় জেলাতো অনেকাংশে ভিন্ন। বিভিন্ন ভোজনরসিকের মতে, জেলাতো হচ্ছে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু ফ্রোজেন ডেজার্ট। আমেরিকানদের মতো ইতালিয়ানরা আইসক্রিমে অতিরিক্ত ক্রিম ব্যবহার করেন না, তবুও জেলাতোতে ক্রিমের মতো টেক্সচার পাওয়া যায়। ইতালিয়ানরা আইসক্রিম তৈরিতে ক্রিমের পরিবর্তে তরল দুধকে বেশি গুরুত্ব দেন, যার ফলে তাদের তৈরি আইসক্রিমে চর্বির পরিমাণ কম থাকে এবং স্বাদ আরও প্রকট হয়।
এছাড়া, আইসক্রিমে ডিমের কুসুম ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রিমের মতো গঠন সৃষ্টি হয়। তুলনামূলক ধীরগতিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মিশ্রণের ফলে এতে অতিরিক্ত বাতাস থাকে না, যা জেলাতোকে আরও মোলায়েম ও মাখনের মতো মসৃণ করে তোলে। বিভিন্ন ফ্লেভারের জেলাতোর মধ্যে স্ট্রাচিয়াটেলা, পিস্তাচিও, নোচ্চিওলা, লিমোনে, ফিওর দি লাতে, তিরামিসু ও সিওক্কোলাটো উল্লেখযোগ্য।
গরমের দিন জেলাতোর মতো ইতালিতে ক্রিমা দি কাফে আরেকটি জনপ্রিয় ফ্রোজেন ডেজার্ট আইটেম। ক্রিমা দি কাফে তৈরি করতে দুই থেকে তিন শট এসপ্রেসো, ২৫০-৩০০ মিলিলিটার ডবল ক্রিম, এক টেবিল চামচ ভেনিলা এক্সট্রাকট, স্বাদ অনুযায়ী চিনি ও বরফের টুকরার প্রয়োজন হয়।
শীতের দিনে ইতালির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড়দিনকে সামনে রেখে ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান বসে। এসব দোকানে থাকে বিভিন্ন ধরনের উপহারসামগ্রী, হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য ও খাবার। তবে এসময় ভিন ব্রুলি ও কালদা চকোলাডা পান করার জন্য এসব অস্থায়ী স্টলের সামনে মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
দুই কাপ দুধের সঙ্গে ১০০ গ্রাম ডার্ক চকোলেট, দুই টেবিল চামচ কোকো পাউডার, এক টেবিল চামচ ভেনিলা নির্যাস, এক টেবিল চামচ কর্নস্টার্চ, স্বাদ অনুযায়ী চিনি, সামান্য পরিমাণ লবণ ও হুইপড ক্রিমের প্রয়োজন হয়। অনেকে কালদা চকোলাদাকে হট চকলেট হিসেবেও অভিহিত করেন। ফ্রান্সে সকালের নাশতায় হট চকলেট একটি জনপ্রিয় পানীয়।
ফ্রান্সের হট চকোলেটের তুলনায় ইতালির কালদা চকোলাদা টেক্সচারের দিক থেকে অনেক বেশি ঘন। অন্যদিকে ফ্রুটি ফ্লেভারের রেড বা হোয়াইট ওয়াইনের সঙ্গে লেমন ও অরেঞ্জ জুস এবং একইসঙ্গে লেমন ও অরেঞ্জ জেস্ট, স্বাদ অনুযায়ী চিনি, লবঙ্গ, স্টার এনিস, দারুচিনির টুকরা, এলাচ ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্র্যান্ডি মিশিয়ে ভালোমতো জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ভিন ব্রুলি।
শীতের সন্ধ্যা, বড়দিন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। চারদিকে রাস্তাঘাট ও দালানকোঠা আলপনা ও আলোকসজ্জায় ছেয়ে উঠেছে। কিছু দূর ইলেকট্রিক পোস্টের সঙ্গে লাগানো মাইক থেকে ভেসে আসছে ক্যারল বা ক্রিসমাস সং। রাস্তার দুই ধারে ছোট পরিসরে কয়েক গজ দূরে দূরে পসরা সাজিয়ে বসেছে ছোট ছোট দোকান। ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে বরফের ওপর স্কেটিং করছে। কেউ আবার ক্রিসমাস ট্রি সাজাচ্ছে। এমন এক মুহূর্তে এক কাপ কালদা চকোলাদা কিংবা এক কাপ ধোঁয়াউঠা গরম ভিন ব্রুলি শরীরের মাঝে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে।
আমি প্রায়ই বিকেলে বা সন্ধ্যায় পায়ে হেঁটে ছুটে যাই গোরিজিয়া শহরে ইতালিয়ান কফির স্বাদ নেওয়ার জন্য। এমনকি মাসের শেষে যখন পকেট সংকুচিত হয়ে পড়ে, তখন আমি বন্ধু-বান্ধব থেকে টাকা ধার করে হলেও গোরিজিয়া শহরে যেতে ভুল করি না।
রাকিব হাসান রাফি: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।