টেকো ও জাদুর বাটি

তুরস্কের লোককথায় ‘কেলোগান’ খুব জনপ্রিয় চরিত্র। কেলোগানকে নিয়ে প্রচলিত আছে অসংখ্য গল্প। সেই গল্পগুলো নিয়ে ইউরোপে নির্মিত হয়েছে অনেক কার্টুন ও অ্যানিমেটেড সিনেমা। ‘কেলোগান’ অর্থ টেকোছেলে। সেই কেলোগানের একটি গল্প এটি, গল্পে তাকে আমরা টেকোছেলে বলেই ডাকবো।

নোমান প্রধাননোমান প্রধান
Published : 21 Nov 2023, 04:39 AM
Updated : 21 Nov 2023, 04:39 AM

টেকোকে তো মা খুবই ভালোবাসতো। ভালোবেসে টেকোকে ডাকতো ‘আমার সোনা ছেলে’ ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বলে।

একদিন দুপুরে বিছানায় গড়াতে গড়াতে আরামপ্রিয় টেকো ভাবলো মায়ের জন্য কিছু করা উচিত। ভাবতেই তার মাথায় আসলো মাছ ধরার চিন্তা। যেই ভাবা সেই কাজ। টেকো ছিপ-বড়শি নিয়ে ছুটে গেলো জলাশয়ের ধারে মাছ ধরতে। বড়শি পেতে বসে রইলো।

বিকেলের দিকে বড়শিতে টান পড়তেই টেকো চমকে উঠলো! টানের কি জোর! নিশ্চয়ই বড় সাইজের কোন মাছ হবে। টেকো ডাঙায় থেকে প্রাণপণে বড়শি টানতে লাগলো, মাছও জলে থেকে ছুটে যাবার জন্য লড়তে লাগলো। দুইদিকের টানাটানিতে শেষে জয় হলো টেকোর। হড়কা টানে একসময় উঠে এলো বিশাল একটা মাছ।

মাছটা দেখতে যেমন বড় তেমনি সুন্দর! কাচের মতো স্বচ্ছ চোখ, রুপালি চাঁদের মতো চকচকে আঁশ। দেখলে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। তবে দেখতে যত সুন্দরই হোক না কেন, না কেটে তো আর খাওয়া যাবে না! টেকো কোমরে গুঁজে রাখা ছুরিটা বের করে মাছের আঁশ ছাড়িয়ে কাটতে শুরু করলো। মাছ কাটতে কাটতে সে ভাবে, এত বড় মাছ ধরলাম। মা নিশ্চয় খুব খুশি হবে।

মাছ কাটতে গিয়ে টেকোকে আবার অবাক হতে হয়। বড় মাছটা দেখে যতটা না অবাক হয়েছিলো তারচেয়ে বেশি অবাক হতে হয় মাছের পেটে একটা বাটি দেখতে পেয়ে। এও কি সম্ভব! এমন কথা কি আগে কেউ শুনেছে। এত বড় একটা বাটি মাছের পেটের ভেতর কোথা থেকে এলো তা ভেবে কুল কিনারা পায় না টেকো। বাটিটাও খুব সুন্দর। টেকো ভাবে মাছের সঙ্গে বাটি দেখে মা নিশ্চয় একটু বেশি খুশি হবে।

বাটিটা ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে জলে নামে টেকো। বাটি জলে ডুবাতেই ফের চমকে ওঠে টেকো। আজ যেনো টেকোর চমকেরই দিন। একের পর এক অবাক করা ঘটনা ঘটে চলছে। প্রথমে এত বড় আর দেখতে সুন্দর একটা মাছ, তারপর সেই মাছের পেটেই বাটি আর এখন কিনা বাটিটা জল দিয়ে ধুতে গেলেই স্বর্ণ বের হচ্ছে! তাজ্জব ব্যাপার। টেকো নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরপর তিনবার বাটিটা জলে ধুয়ে নিলো আর প্রতিবারই যেনো গলিত সোনা বেরিয়ে গেলো।

টেকো বুঝতে পারে সে একটা জাদুর বাটি পেয়েছে। সে জলাশয়ের কাছে মাছ ফেলে রেখেই বাটিটা নিয়ে দৌড়ে গেলো তার মায়ের কাছে। মায়ের কাছে পৌঁছে টেকো সব খুলে বলে। মাছ ধরা থেকে বাটি পাওয়া, বাটি ধুতে গেলেই স্বর্ণ বের হওয়ার কথা। টেকোর মা প্রথমে বিশ্বাস করে না। মা ভাবে ছোট ছেলে মজা করছে। শেষে, টেকো গামলা ভরে জল এনে মায়ের কাছে রেখে বলে, আমি বাটিটা পানিতে রাখছি, তুমি নিজের চোখেই দেখো।

একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে পৌঁছে গেলো। তার সঙ্গে ছিলো অনেক স্বর্ণ আর সেই জাদুর বাটি।

মা দেখে সত্যিই তো, ছেলে তো মিথ্যে মজা করছে না। তাজ্জব ব্যাপার! বাটি পানিতে রাখতেই তা থেকে স্বর্ণ বেরুচ্ছে। তারা ঠিক করলো আপাতত এই ঘটনা কাউকে বলার দরকার নেই। যখন দরকার পড়বে তখন জাদুর বাটি ব্যবহার করে স্বর্ণ বের করে নিলেই হবে।

কিন্তু পরে কিছুই ভাবনার মতো সরল থাকলো না। টেকো নিয়মিত জাদুর বাটি থেকে স্বর্ণ বের করতে লাগলো আর তা বিক্রি করে তার হাতে আসতো প্রচুর নগদ টাকা। কারণে-অকারণে স্বর্ণ ও টাকা ব্যবহার করতে লাগলো সে। ধনীদের মতো প্রচুর বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করলো। এমনকি নিজের জন্য মস্ত বড় এক প্রাসাদও বানালো সে। সেই প্রাসাদ রাজার প্রাসাদের চেয়েও বড় আর সেখানে রাজার চেয়েও বেশি দাস-দাসী, আমোদ-প্রমোদ।

টেকোর মা তাকে মাঝে মাঝে বোঝানোর চেষ্টা করতো এসবই বাজে খরচ। একটা মানুষের ভালো থাকার জন্য যখন একটা খোলামেলা বাড়িই যথেষ্ট, তখন প্রাসাদ তো অপচয়! টেকো মায়ের কথা শুনতো না। সে বলতো, আমার তো জাদুর বাটি আছে, আমি যা চাই তাই হাজির করতে পারি। সে নানাভাবে অপচয় করতে থাকতো আর নিজের অর্থবিত্তের দাম্ভিকতা দেখাতে লাগলো। মানুষের সঙ্গে বিনয় ও মার্জিত আচরণ দেখাতেও ভুলে যাচ্ছিলো।

তখন অনেকে বলতো, আমাদের আগের টেকো দরিদ্র হলেও ভালো মানুষ ছিলো। এখন সে ধনী, কিন্তু মানুষ হিসেবে ছোটলোক, নিচু তার ব্যবহার। লোকজন তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। অবশ্য লোকের কথাকে পাত্তা না দিয়ে টেকো নিজের মতোই চলছিলো। অবাধ ও অহংকারী জীবন ছিলো তার। একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে পৌঁছে গেলো। তার সঙ্গে ছিলো অনেক স্বর্ণ আর সেই জাদুর বাটি।

হঠাৎ তার মনে খেয়াল এলো, আমার কাছে এতো স্বর্ণ আছে, চাইলেই নদীর পারে একটা স্বর্ণের প্রাসাদ বানাতে পারি, যার সব কিছুই তৈরি হবে স্বর্ণ দিয়ে। এমন ভাবনার খেয়ালে ডুবে টেকো নিজের অজান্তেই নদীর একদম কিনারে চলে গেলো আর আচমকা পা পিছলে পড়ে গেলো নদীর জলে। হাত ফসকে জাদুর বাটিও জলে পড়ে গেলো।

টেকো খুব ভালো সাঁতার জানতো না, কোনরকম প্রাণান্ত চেষ্টায় সে তীরে উঠার চেষ্টা করছিলো। তখন কিছু চোর নদীর পার দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা টেকোকে দেখলো, কিন্তু তাকে না বাঁচিয়ে সব স্বর্ণ নিয়ে চলে গেলো। শেষে সে কোনরকম জল থেকে উঠতে পারলেও তার জাদুর বাটি জলের অতলে হারিয়ে গেলো।

স্বর্ণ ও জাদুর বাটি হারিয়ে বিমর্ষ মনে টেকো ফিরে গেলো তার মায়ের কাছে। সব শুনে টেকোর মা বললো, এত মন খারাপ করছো কেন? তুমি যা কিছু হারিয়েছো তার কোন কিছুই তুমি অর্জন করোনি। তবে ভাগ্যগুণে পাওয়া সম্পদের কারণে লোকের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করেছো যার জন্য তুমি দুঃখিত হতে পারো। একদিকে ভালোই হলো, দরিদ্র ও দুর্বল মানুষকে এখন আর তুমি নিচু চোখে দেখবে না। এভাবেই আদর্শ মায়ের মতো ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি।