মেহেদীর ‘শিশুদের বিশ্ববিদ্যালয়’

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের টেংগরজানি গ্রামের এক তরুণ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বই ঘর পাঠাগার’। নিজের বাড়িতেই একটি আধপাকা টিনের ঘরে এ পাঠাগারটি ইতোমধ্যে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অনুমোদন পেয়েছে।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2023, 00:34 AM
Updated : 6 Jan 2023, 00:34 AM

জ্ঞান খুঁজতে পাঠাগারটি কোথায় জানার পরামর্শ দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। নিজ গ্রামের শিশুদের কাছে জ্ঞানের সেই আলো পৌঁছাতেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন গাইবান্ধার এক তরুণ। তার মতে এ পাঠাগার হচ্ছে ‘শিশুদের বিশ্ববিদ্যালয়’।

পুরো নাম মো. মেহেদী হাসান (২১)। গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের টেংগরজানি গ্রামের এ তরুণের পাঠাগারের নাম ‘বই ঘর’। নিজের বাড়িতেই একটি আধপাকা টিনের ঘরে এ পাঠাগারটি ইতোমধ্যে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অনুমোদন পেয়েছে।

মেহেদী পড়াশোনা করছেন গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। ‘কিডজ’ এর সঙ্গে ফোনালাপে উঠে এসেছে তার পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও স্বপ্নের কথা। 

পাঠাগারই কেন প্রতিষ্ঠা করতে হবে?

শহরে বই পড়ার সুযোগ কমবেশি সবাই পায়। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোর বই পড়ার ইচ্ছে থাকলেও পায় না সুযোগ। দেশের বেশির ভাগ পাঠাগার শহরকেন্দ্রিক। তাই ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল আমার গ্রাম টেংগরজানিতে একটি পাঠাগার তৈরি করবো, সেখানে নারী-শিশু-কিশোরসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বই পড়ার সুযোগ পাবে। গ্রামের শিশু-কিশোরদের বইমুখী করতেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করি।

পরিকল্পনা কীভাবে এগোলো?

কাজ শুরুর দিকে অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিলো। অনেক রকম বাধা, তারপরও কখনও থেমে যাইনি। নিজের ইচ্ছেশক্তি ও আগ্রহে অটল থাকতে পেরেছি। গ্রামে পাঠাগার করার পরিকল্পনা করি শৈশবেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে যখন মাধ্যমিকে উঠি, তখন থেকে টিফিনের টাকা ও যাতায়াতের অতিরিক্ত ভাড়া জমা করে রাখতাম। তারপর জমানো টাকা ও মা-বাবার সহযোগিতায় আমার নিজ গ্রামে টেংগরজানিতে ২০২০ সালে এ পাঠাগারের কাজ শুরু করি।

বই সংগ্রহ করলেন কীভাবে?

ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম। প্রতিমাসে নতুন বই কিনতাম। আমার বুকশেলফে ১৭৭টি বই ছিলো। সেগুলো দিয়ে ‘বই ঘর পাঠাগার’-এর যাত্রা শুরু করি। তারপর ফেইসবুকে আমার পাঠাগারের জন্য বই চেয়ে নিয়মিত পোস্ট করতে থাকি। এসব পোস্ট অনেকে এড়িয়ে গেলেও বেশ কয়েকজন অগ্রজ ভাই-বোন, বন্ধু, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বই দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তাদের অবদান কখনও ভুলার মতো নয়।

পাঠাগারে এখন বইসংখ্যা কত, কী ধরনের বই রয়েছে?

শিশু-কিশোরদের বই থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনাসমগ্র, জীবনী, ছোটগল্প, কবিতা ও ভাষাতত্ত্বের বই রয়েছে এ পাঠাগারে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনাও আছে। বর্তমানে পাঠাগারে বই রয়েছে প্রায় এক হাজার।

পাঠাগারে কারা আসেন?

প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন পাঠক বই ও পত্রিকা পড়তে আসেন পাঠাগারে। শিশুকিশোর ছাড়াও আসেন গ্রামের নারী ও বয়স্করা। পাঠাগারের সদস্যদের জন্য বই বাড়িতে নিয়েও পড়ার সুবিধা রয়েছে। অধিকাংশ পাঠক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।

পাঠাগার ঘিরে আর কী কী কার্যক্রম চলে?

শুধু বইপড়া নয়, পাশাপাশি গ্রামের শিশু-কিশোরদের নিয়ে নানা ধরনের শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ‘বই ঘর’। পাঠাগার থেকে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন, জাতীয় দিবস পালন, চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান, গল্পলেখা ও কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় আমরা ‘বই ঘর ক্লাব’ তৈরি করছি। শিশু-কিশোরদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পাঠ-কার্যক্রমের আয়োজন করা হচ্ছে। এর ফলে বইমুখী হচ্ছে গ্রামের মানুষ, বই পড়ার পর আয়োজিত হচ্ছে কুইজ।

পাঠাগার গড়তে পরিবারের সহযোগিতা কি পেয়েছেন?

পাঠাগারের কাজে আমার মা-বাবা সবসময় সহযোগিতা করছেন। আমার বাবা মো. হান্নান মিয়া পেশায় ব্যবসায়ী, মা মোছা. জান্নাতুল ফেরদৌস গৃহিনী। আমরা তিন ভাই এক বোন। বড় ভাই জাহিদ হাসান ব্যবসা করেন, ছোট ভাই নবীউল হাসান দ্বাদশ শ্রেণিতে আর ছোট বোন হিয়া মনি দশম শ্রেণিতে পড়ে। পাঠাগার নিয়ে আমার কর্ম-তৎপরতা তারা সবাই ইতিবাচকভাবে দেখেন।

আনন্দের কোন স্মৃতি?

আমাকে ও আমার কার্যক্রম ভালোবেসে শুভাকাঙ্ক্ষীরা পাঠাগারের জন্য বই, ম্যাগাজিন, চেয়ার-টেবিল ও ফ্যান উপহার দিয়েছেন। আমি এগুলো যথাযথ ব্যবহার করছি ও গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এর চেয়ে আনন্দের স্মৃতি আর কী হতে পারে!

কষ্টের কোন স্মৃতি?

গত বছর স্থানীয় একটি বইমেলায় ‘বই ঘর পাঠাগার’ থেকে একটি স্টল নিই। মেলায় বই বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে পাঠাগারের জন্য কিছু আসবাবপত্র কেনার পরিকল্পনা ছিল। এই ভেবে ঢাকা থেকে ২০-২৫ হাজার টাকার বই ধার করে আনি। কিন্তু মেলায় যে অভিজ্ঞতা হলো- বই কেনা ও পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই বর্তমান প্রজন্মের। তখন কী করি ভেবে না পেয়ে অর্ধেক বই ফেরত পাঠাই। বাকি অর্ধেক বই পাঠাগারের জন্য রেখে দিই। এখনও বইয়ের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি, এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে!

পাঠাগার নিয়ে আপনার কোন স্বপ্ন?

আমি স্বপ্ন দেখি আমার গ্রাম টেংগরজানি নিয়ে, যেখানে থাকবে না কোনো নিরক্ষর শিশু, থাকবে না কোনো অন্ধকার। আমার পাঠাগার হবে ‘শিশুদের বিশ্ববিদ্যালয়’। ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে চাই। নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুকিশোর ও বই নিয়ে কাজ করতে চাই।