বিটিআই একটি জৈব কীটনাশক যা মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়। পোষা এবং অন্যান্য প্রাণী, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদেরও ক্ষতি করে না।
Published : 07 Aug 2023, 10:55 AM
ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এইডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিটিআই নামে নতুন একটি কীটনাশক প্রয়োগ শুরু করছে।
কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে চলার মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এই ওষুধ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি। সোমবার থেকেই এ জৈব কীটনাশক মাঠ পর্যায়ে ছিটানো হবে।
সিঙ্গাপুর থেকে এরইমধ্যে পাঁচ টন বিটিআই আনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার সড়কের পাশের নালায় ছিটানো হবে এই কীটনাশক।
বিটিআই এর একটি প্যাকেটে ২৫ গ্রাম কীটনাশক থাকে। ১০ লিটার পানিতে এরকম তিন প্যাকেটের ৭৫ গ্রাম কীটনাশক মিশিয়ে ২৫ থেকে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় ছিটিয়ে দিতে হয়। কোনো স্থানে প্রথমবার দেওয়ার ১৫ দিন পর আবার বিটিআই প্রয়োগ করতে হয়।
সিঙ্গাপুর বেস্ট কেমিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে কেনা এই কীটনাশকের প্রতি কেজির দাম ৩ হাজার ৩৮৫ টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি জানিয়েছে, বিটিআই কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে রোববার সিঙ্গাপুর থেকে সরবরাহকারী কোম্পানির একজন কর্মকর্তা ঢাকায় এসেছেন। আগামী পাঁচদিন তিনি মশক নিয়ন্ত্রণকর্মী এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শনিবার ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছেন সরবরাহকারী কোম্পানির ওই কর্মকর্তা। রোববার তিনি ঢাকায় এসেছেন। সোমবার কীটনাশক প্রয়োগের সময় তিনি সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সঙ্গে থাকবেন।
“আমাদের দেশে এটা একদমই নতুন। এজন্যই আমরা সিঙ্গাপুর থেকে ওই লোককে এনেছি। তিনি আমাদের দেখাবেন কীভাবে, কতটুকু ওষুধ, কোথায়, কতটুকু জায়গা নিয়ে প্রয়োগ করলে ভালো কাজে আসবে।”
জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব জায়গায় এখন বিটিআই ব্যবহার হচ্ছে সেখানে এটা বেশ কাজে দিচ্ছে। ঢাকাতেও এটা কাজে দেবে আশা করা যায়। তবে সঠিকভাবে, সঠিকমাত্রায়, সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করা গেলে বিটিআই ভালো ফলাফল দেয়।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে বিটিআই প্রয়োগ কাজে দেবে বলে আশাবাদী তিনি।
“যতদূর জেনেছি, এটা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। মানুষের এমনকি যারা ওষুধটা প্রয়োগ করবে তাদেরও ক্ষতি করবে না। আমি যেসব জায়গায় গেছি, তারা আমাকে বিটিআই প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে। আমেরিকার ফ্লোরিডার কয়েকটি শহরে বিটিআই প্রয়োগ হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণে। আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছি। এর অংশ হিসেবে বিটিআই ভালো কাজে দেবে বলে আশা করি।”
কাজ করে যেভাবে
এই কীটনাশকের পুরো নাম ব্যাসিলাস থুরিংয়েইনসিস ইসরায়েলেনসিস। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি ব্যাকটেরিয়া, যা মাটিতে পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে ইসরায়েলের একটি পরিত্যক্ত পুকুরে প্রথম এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়।
এই ব্যাকটেরিয়ায় এক ধরনের স্পোর রয়েছে, যা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে। কোনো স্থানে যখন বিটিআই দেওয়া হয়, তখন মশার লার্ভা সেটিকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। বিটিআই থেকে থেকে নির্গত বিষাক্ত টক্সিনের বিষক্রিয়ায় মশার মিড-গাটের এপিথেলিয়াল কোষগুলো ফুলে ফেটে যায়। তাতে লার্ভার অন্ত্রের প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লার্ভা মারা যায়।
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এই কীটনাশক ব্যবহার করছে। মশা নিয়ন্ত্রণে বিটিআইয়ের ব্যবহার আছে সিঙ্গাপুরেরও। ভারতের কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৯৬ সাল থেকে বিটিআই ব্যবহার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, বিটিআই মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়। এটি ব্যবহারের কারণে মানুষের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা দেখা যায়নি। পোষা এবং অন্যান্য প্রাণী, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, মৌমাছিসহ অন্য কোনো ধরনের পোকামাড়কের ক্ষতি করে না বিটিআই। এসব কারণে বিটিআইকে আমেরিকান এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) অনুমোদন দিয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, কোনো কীটনাশক একটি এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার হলে সেই পতঙ্গটির মধ্যে সেই কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠলে সেই পতঙ্গকে আর মারতে পারে না ওই কীটনাশক।
“বিটিআই ব্যবহারের পর এর বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, বিটিআইয়ের বিরুদ্ধে মশার লার্ভার কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলার পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে দেখা প্রয়োজন।”