ধানমণ্ডি মডেল থানার ওসিকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন বিচারক।
Published : 26 Jun 2023, 07:07 PM
ঢাকার ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ এক কিশোরের মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।
তাহসিন হোসেইন নামের ১৭ বছর বয়সী ওই কিশোরের বাবা মনির হোসেন সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি করেন।
তার আইনজীবী তানভীর আহমেদ সজীব জানান, বিচারক বেগম ফারাহ দিবা ছন্দা বাদীর আর্জি শুনে ধানমণ্ডি মডেল থানার ওসিকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন।
“এটি চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ হিসাবে নয়, বরং সরাসরি হত্যা মামলা হিসাবে নিতে বলেছেন বিচারক।”
মামলার আসামিরা হলেন: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের এমডি ডা. এ এম শামীম, ওই হাসপাতালের সার্জন ডা. মো. সাইফুল্লাহ, সহকারী সার্জন ডা. মাকসুদ, ডা. সাব্বির আহমেদ, ডা. মোশাররফ, ডা. তাজরিন ভূইয়া ও হাসপাতালের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো. শাহজাহান।
আসামিদের ‘অসৎ, আইন অমান্যকারী, ধূর্ত, প্রতারক’ প্রকৃতির লোক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে মামলার আরজিতে।
অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে ল্যাবএইড হাসপাতালের এমডি এ এম শামীম বলেছেন, তারা আইনি লড়াই চালাবেন।
ধানমণ্ডি থানার ওসি পারভেজ ইসলাম রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালতের নির্দশনা অনুযায়ী থানায় সাতজনকে আসামি করে মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৩০২, ৫০৬ এবং ৩৪ ধারায় মামলাটি হয়েছে। খুন নয়, তবে হত্যার জন্য দায়ী- ৩০৪ ধারায় এমন অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড।
মামলার আরজিতে বলা হয়, তাহসিন কিছুদিন থেকে অসুস্থ বোধ করায় গত ২৭ মার্চ তাকে ল্যাবএইডে ডা. সাইফুল্লাহর কাছে দেখানো হয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন।
ওই চিকিৎসক বলেন, তার অবস্ট্রাক্টিভ স্মল গাট বা নাড়ির প্যাঁচ রয়েছে। যার কারণে তার পেটে ব্যথা, সে মল ত্যাগ করতে পারছে না। দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে ‘বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি’ রয়েছে।
পরে গত ২৮ মার্চ অস্ত্রোপচার করে ‘মলদ্বারের অংশ অপসারণ’ করা হয়। কিন্তু তারপর তাহসিনের অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
মামলায় বলা হয়, বাদী তখন ডা. সাইফুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি সাক্ষাৎ দিতে ‘অস্বীকৃতি’ জানান। তখন ডা. মাকসুদ বলেন, অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। রোগীকে সুস্থ করতে হলে আবার অপারেশন করতে হবে।
এরপর ডা. মাকসুদের কথায় ‘অসহায় অবস্থায়’ দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের জন্য টাকা জমা দিয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার শাহজাহানকে সেই স্লিপ দেন মনির হোসেন। ডা. সাইফুল্লাহ ৬ এপ্রিল ডা. সাব্বির, ডা. মোশাররফ এবং ডা. তাজরিনকে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করেন।
দ্বিতীয়বার অপারেশনের পর মনির হোসেন ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে ডা. মাকসুদ তাকে ‘আশ্বস্ত করে’ বলেন, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে, তবে তাহসিনের অবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে এবং জরুরি ভিত্তিতে তাকে রক্ত দিতে হবে। পরের সাত দিনে ডাক্তারের কথায় ১০ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করেন মনির।
এরপর এক মাস পার হলেও ছেলের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তিনি ডা. সাইফুল্লাহ এবং ডা. মাকসুদের কাছে পরিস্থিতি জানতে চান। কিন্তু তারা কোনো ‘সদুত্তর দিতে পারেননি’ বলে বাদীর ভাষ্য।
এরপর রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে এবং দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা চলার পর গত ২৩ জুন ওই কিশোরের মৃত্যু হয়।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, তিন মাসে তাহসিনকে ১৪৪ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায় ২৭ লাখ টাকা বিল করে। এর মধ্যে দশ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে হাসপাতাল থেকে সন্তানের লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন মনির হোসেন।
তার অভিযোগ, তিন মাস ধরে তার ছেলের ‘অপচিকিৎসা’ হয়েছে। ল্যাবএইড হাসপাতালে তাহসিনের ‘সঠিক চিকিৎসা সম্ভব না জানার পরও অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার জন্য’ আসামিরা রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে ‘আটকে রেখে হত্যা করেছেন।’
ছেলের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ায় আসামিরা বাদীকে ‘অপমান অপদস্ত’ করেন এবং এক পর্যায়ে ‘আপস করলে বিলের টাকা মওকুফ’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলার আর্জিতে।
মনির হোসেন আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ডা. সাইফুল্লাহকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার ছেলের সমস্যা কী? কিন্তু উনি সঠিক করে কিছুই বলতে পারেননি। অথচ তার দুইবার অপারেশন করা হয়েছে।
“তিনি যে আমার ছেলের ভুল চিকিৎসা করেছেন, তা একশ ভাগ নিশ্চিত। এ সময়ে আমার ছেলেকে ১৪৪ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আমি প্রথম অপারেশনের পর এখান থেকে রিলিজ নিয়ে ভারতে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ রোগীকে ছাড়পত্রও দেয়নি।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই বাবা বলেন, “চিকিৎসার নামে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ এবং এই চিকিৎসকরা আমার ছেলেকে তিলে তিলে হত্যা করেছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।”
অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ল্যাবএইড হাসপাতালের এমডি ডা. এ এম শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই রোগী আমাদের এখানে তিন মাসের বেশি সময় ধরে ভর্তি ছিল। তার অবস্থাও ক্রিটিক্যাল ছিল। আমরা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে রোগীর স্বজনদের বলেছিলাম তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ ওই চিকিৎসা আমাদের এখানে হবে না।
“সপ্তাহখানেক আগে রোগীটা মারা যায়। তারা মামলা করেছেন, আমরা সেটা ফেইস করব।”