করোনাভাইরাসের টিকার আর কতদূর?

বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের নাম এখন নভেল করোনাভাইরাস; আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে, মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে এখন ৩৭ হাজারের বেশি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 12:50 PM
Updated : 31 March 2020, 04:50 PM

নতুন ধরনের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট ওষুধ এখনও নেই; ফলে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের টিকা পাওয়ার আশায় আছে বিশ্ববাসী।

তিন মাস আগে চীনে সংক্রমণ ঘটার পর বিশ্বে যখন ছড়াতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই টিকা আবিষ্কারে নেমে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনের মতো দেশগুলো।

কোভিড-১৯ রোগের প্রতিষেধক কে আগে বার করবে, সেই দৌড়ে আছে তারা এখনও। মানুষের শরীরে কী প্রভাব হয়, তা দেখতে এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আবিষ্কৃত টিকার নিরীক্ষায় নেমেছে।

কিন্তু গবেষকরা কতটুকু সফল হতে পেরেছেন নতুন এই ভাইরাসটির প্রতিষেধক তৈরিতে? আর কত দিনই বা লাগবে টিকা প্রয়োগ করে মানুষের মৃত্যুর মিছিল থামাতে?

যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ৩৫টির প্রতিষ্ঠান কোভিড-১৯ টিকা তৈরির চেষ্টা জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে এক ধাপ পেরিয়ে চারটি প্রতিষ্ঠান প্রাণীদেহে এই প্রতিষেধক প্রয়োগের নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।

মানুষের উপর প্রথম এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালিয়েছে বোস্টনের বায়োটেকনোলোজি কোম্পানি মডার্না থেরাপিউটিকস।

গবেষণার এই ত্বরিত গতির জন্য চীনের একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য বলে জানাচ্ছে গার্ডিয়ান। কারণ তারাই শুরুতে সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটির জিনোমের নমুনা নিয়ে তা জানিয়েছিল সবাইকে।

চীনের উহানে রোগীর সিটিস্ক্যান করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের চেষ্টা। ছবি: রয়টার্স

গত জানুয়ারিতে চীনের কাছ থেকে এই ভাইরাসের জিনোম নমুনা মেলার পর থেকেই বিশ্বের গবেষণাগারে শুরু হয় নভেল করোনাভাইরাসের অনুলিপি তৈরির চেষ্টা। একই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করে কীভাবে এই ভাইরাস মানুষের শরীরের কোষগুলোকে আক্রান্ত করে; যার কারণে মানুষ অসুস্থ ও মৃত্যুঝুঁকিতেও পড়ে।      

কোভিড-১৯ প্রতিষেধক তৈরিতে অর্থ জোগান দিচ্ছে অসলোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সেপি)।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড গার্ডিয়ানকে বলেন, “আর সব করোনাভাইরাসে টিকা কীভাবে তৈরি করা যায়, এই চিন্তা করেই দ্রুতগতিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।”

২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চীনে সার্স ও ২০১২ সালে সৌদি আরবে মার্সের প্রাদুর্ভাবের কারণও এক ধরনের করোনাভাইরাসই।

সার্স ও মার্সের পর প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু হলেও রোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতেই এই গবেষণা থেমে যায় বলে জানাচ্ছে গার্ডিয়ান।

মেরিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নোভাভ্যাক্স বলছে, ওই সময়ে তৈরি টিকাগুলো এখন মানুষের শরীরে পরীক্ষার জন্য প্রয়োগ করা সম্ভব।

কোভিড-১৯ এর টিকা তৈরির দৌড়ে আছে অন্তত ৩৫টি প্রতিষ্ঠান

মার্স প্রাদুর্ভাবের সময় তৈরি হওয়া প্রতিষেধক থেকেই নতুন করোনাভাইরাসের টিকা বানানোর কাজটি এগিয়ে নিয়েছে মডার্না থেরাপিউটিকসও।  

বিজ্ঞানীরা সার্স ভাইরাসটির সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের জিনোমের গঠনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাই নতুন এই ভাইরাসটির আরেকটি নাম দেওয়া হয়েছে সার্স-সিওভি-২।

একটি প্রোটিনের তৈরি গোলাকার ক্যাপসুলের ভেতর থাকে ভাইরাসটির রাইবোনিউক্লিক এসিড বা আরএনএ। আর বাইরের আবরণ ঘিরে থাকে প্রোটিন যুক্ত কাঁটা।

মানুষের ফুসফুসে ঢুকে গেলে শরীরের কোষের সঙ্গে এই কাঁটা ব্যবহার করেই ভাইরাসটি নিজেকে সংযুক্ত করে। তারপর মানুষের শরীরের কোষের বিভাজনের কৌশল জেনে নিতে পারে ভাইরাসটি। তারপর ওই পদ্ধতিতে নিজের একাধিক অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। তবে তার আগে মানুষের শরীরের ওই কোষ ধ্বংস করে দেয় এই ভাইরাস।  

করোনাভাইরাস দেখতে এমনই

সব প্রতিষেধকই একটি বিশেষ কৌশলে কাজ করে থাকে; রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হতে শরীরে অ্যান্টিবডিকে কার্যকর করে তোলা। একবার ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পর অ্যান্টিবডি ওই ভাইরাসকে নিজস্ব স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে। ফলে পুনরায় ওই একই ভাইরাসের আক্রমণ হলে অ্যান্টিবডি সহজেই ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে।

প্রতিষেধক তৈরির গবেষণায় এরমধ্যে নোভাভ্যাক্স ও ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের সঙ্গে মিলে ৪৪ লাখ ডলারের অনুদান ঘোষণা করেছে সেপি।

কিন্তু এসবের পরও কবে নাগাদ কোভিড-১৯ টিকা সহজলভ্য হবে?

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, মেডিকেল পরীক্ষানিরীক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদনের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে তিনটি ধাপ পেরিয়ে হাতে আসতে পারে এই ভাইরাসের টিকা।

প্রথম ধাপে যুক্ত করতে হবে একাধিক স্বেচ্ছাসেবক। যাদের শরীরে এই টিকা প্রয়োগ করে তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

দ্বিতীয় ধাপে এই পরীক্ষা চালানো হবে কয়েকশ কোভিড-১৯ রোগীর উপর। এতে দেখার বিষয় হলো, এই টিকা প্রয়োগের পর তাদের আরোগ্য মিলছে কি না? 

সর্বশেষ ধাপেও আরও কয়েকশ লোকের উপর এই টিকার প্রয়োগ করে দেখতে হবে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, এই ভাইরাসটি যেমন মানুষের জন্য নতুন, তেমনি এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে অনেক নতুন প্রযুক্তি।

সাবিন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের ব্রুস জিলিন বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব এই টিকা চালু করার তোড়জোড় চলছে; তবে এখানে কোনো শর্টকাট নেওয়ার সুযোগ নেই।”

মডার্না থেরাপিউটিকস টিকা তৈরির কাজ চালাচ্ছে জোরেশোরে। ছবি: রয়টার্স

আর এসব কারণেই সাধারণ মানুষের জন্য টিকার অনুমোদন হতে হতে সাধারণত এক যুগও লেগে যায়।

“আর সব ভ্যাকসিনোলজিস্টদের মতো আমিও মনে করি না যে ১৮ মাসের আগে এই টিকা চালু করা সম্ভব”, বলেন লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বিভাগের অধ্যাপক অ্যানেলিস ওয়াইল্ডার-স্মিথ।  

তবে টিকা অনুমোদন হলেও সারা বিশ্বে এর যা চাহিদা, সেই অনুপাতে জোগান দেওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সম্ভব নয়, বলছে গার্ডিয়ান।

এইরকম মহামারীতে স্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্কটে থাকা দেশগুলোই বেশি ভুক্তভোগী হয়ে থাকে। টিকার কেনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ও আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে একটি সংঘাত দেখছে গার্ডিয়ান।

২০০৯ সালে এইচ১এন১ ফ্লুয়ের সময়ও তাই ঘটেছিল; সামর্থ্যবান দেশগুলোই আগে টিকা সংগ্রহ করেছিল। ভারতও দেশটির ১৩০ কোটি জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের আগে টিকা রপ্তানি করেছিল উন্নত দেশগুলোতে।

ওয়াইল্ডার-স্মিথ বলছেন, “টিকা চালু হওয়ার আগেই এই মহামারীর বিপর্যয়ের সূচক অনেক উপরে উঠে তারপর আবার নেমে আসবে।”

তবে টিকা অবশ্যই অসংখ্য প্রাণ বাঁচাতে পারে; বিশেষত যদি এই মহামারী পুনরায় দেখা দেয়।

আর তার আগে পর্যন্ত সংক্রমণ এড়াতে ভালো করে হাত ধোয়ার বিকল্প আর মিলছে না।