নতুন করোনাভাইরাসের ঠিকুজি তালাশ

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কীভাবে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে তা খুঁজতে রীতিমতো দৌড় শুরু হয়েছে। এই প্রাদুর্ভাবের উৎসের সন্ধানে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন বিবিসির হেলেন ব্রিগস।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2020, 08:53 AM
Updated : 25 April 2020, 02:45 PM

চীনের আকাশে উড়ন্ত একটি বাদুড়ের লালা বা মল পড়েছিল কোনো এক বনভূমিতে। পোকা-মাকড়ের খোঁজে লতা-পাতার মধ্যে ছোঁক ছোঁক করতে গিয়ে কোনো প্রাণী, সম্ভবত বনরুই, সেই মল থেকে সংক্রমিত হয়। 

নতুন ভাইরাসটি বন্যপ্রাণীতে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমিত কোনো বন্যপ্রাণী ঘটনাচক্রে একদিন ধরা পড়লে তা থেকে কেউ রোগটিতে আক্রান্ত হয়। তার কাছ থেকেই ভাইরাসটি বন্যপ্রাণীর বাজারের কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

এভাবেই সূত্রপাত একটি বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাবের? বন্যপ্রাণী কীভাবে এই ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে তার অনুসন্ধানের মাধ্যমে উপরের চিত্রকল্পের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

ঘটনার এমন ধারাবাহিকতা সাজানোকে ‘গোয়েন্দা গল্পের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন জুলজিকাল সোসাইটি লন্ডনের (জেডএসএল) অধ্যাপক অ্যান্ড্রু কানিংহাম।

তিনি বলেন, একগুচ্ছ বন্যপ্রাণী এই ভাইরাসের বাহক হতে পারে। তার মধ্যে বিশেষভাবে বাদুড়ের কথা বলা যায়। এই প্রাণী বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস ব্যাপক সংখ্যায় বহন করতে সক্ষম।

এই প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে কতটুকু জানা গেছে? এক রোগীর শরীর থেকে নমুনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। এর উৎস হিসেবে চীনে বাদুড়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

স্তন্যপায়ী এই প্রাণীরা বড় এলাকা নিয়ে একসঙ্গে থাকে; উড়ে উড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি। প্রতিটি মহাদেশেই এখন তাদের দেখা মেলে। এরা নিজেরা সহজে অসুস্থ না হলেও দূর-দূরান্তে সংক্রামক জীবাণু ছড়াতে সক্ষম।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক কেট জোনসের মতে, উড়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার সঙ্গে অভিযোজন ও দ্রুত ডিএনএ মেরামতের সক্ষমতা বাদুড়ের রয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে।

“এ কারণেই হয়তো তারা অসুস্থ হওয়ার আগে অনেক ভাইরাস শরীরে বহন করতে পারে। তবে এটা এখনও একটি ধারণা মাত্র।”

বাদুড়ের চাল-চলনের কারণেই যে ভাইরাস দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেন ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের অধ্যাপক জোনাথন বল।

তিনি বলেন, স্তন্যপায়ী প্রাণী বলে বাদুড় মানুষকে সরাসরি বা অন্য কোনো বাহক প্রজাতির মাধ্যমে সহজেই সংক্রমিত করতেই পারে।

ধাঁধাঁর দ্বিতীয় অংশ হলো- সেই রহস্যময় প্রাণীর পরিচয়, যেটা নিজের শরীরে ভাইরাস পুষে নিয়ে উহানের বাজারে ছড়িয়েছে। এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে অন্যতম সন্দেহভাজন বনরুই (প্যাঙ্গোলিন)।

পিঁপড়াখেকো আঁশওয়ালা প্রাণীটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেটার অস্তিত্ব বিপন্ন। চীনা কবিরাজি চিকিৎসায় প্রাণীটি আঁশের ব্যাপক চাহিদা আছে। এছাড়া বনরুইয়ের মাংসও অনেকের কাছে সুস্বাদু।

চীনা কবিরাজি চিকিৎসায় বইরুইয়ের আঁশের ব্যাপক চাহিদা আছে। সম্প্রতি চীনা শুল্ক কর্মকর্তারা একটি জাহাজ থেকে এসব আঁশ জব্দ করে।

বনরুইয়ে অনেক করোনাভাইরাস মিলেছে। যেগুলোর মধ্যে কিছু মানুষের শরীরে পাওয়া নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে গবেষকরা কোনো সিদ্ধান্ত টানার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। কারণ বনরুইয়ের বিষয়ে গবেষণার পূর্ণ তথ্য এখনও প্রকাশিত না হওয়ায় যাচাই করা যাচ্ছে না।

অধ্যাপক কানিংহামের মতে, গবেষণার ক্ষেত্রে বনরুইয়ের উৎস ও সংখ্যা বিবেচনায় নিতে হবে।

তিনি বলেন, সরাসরি বন থেকে আনা একাধিক বনরুই থেকে নমুনা নেওয়া হলে সেটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বন্দি থাকা অথবা কাঁচাবাজার থেকে একটি নমুনা নিলে ভাইরাসের সত্যিকারের বাহক হিসেবে জোরালো সিদ্ধান্ত টানার সুযোগ থাকে না।

“বনরুই ও বিভিন্ন প্রজাতির বানরসহ অনেক বন্যপ্রাণী প্রায়ই কাঁচাবাজারে বিক্রি হয়। তাই এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীতে এবং মানুষের মধ্যে সংক্রামক জীবাণু ছড়াতে কাঁচাবাজারের ভূমিকা আছে।”

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া চীনের উহানের কাঁচা বাজারের একটি অংশে জীবিত ও জবাই করা বন্যপ্রাণী পাওয়া যেত। যেখানে উট, কোয়ালা ও পাখির মাংস বিক্রি হত।

একটি দোকানে বিক্রিত প্রাণীর তালিকায় নেকড়ে শাবক, সোনালী ঘুঘরি পোকা, কাঁকড়াবিছে, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, শিয়াল, ভোঁদর, সজারু, স্যালামান্দার, কচ্ছপ ও কুমির নাম রয়েছে বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদেন বলা হয়েছে।

অধ্যাপক বল বলেন, “আমাদের জানামতে, তালিকায় বাদুর ও বনরুইয়ের নাম ছিল না। তবে কোন কোন বন্যপ্রাণী সেখানে বিক্রি হতো বে বিষয়ে নিশ্চয় চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে।”

গত কয়েক বছরে দেখা দেওয়া অনেক প্রাদুর্ভাবে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছিল বন্যপ্রাণী থেকে। ইবোলা, এইডিস, সার্স এবং নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।  

স্তন্যপায়ী প্রাণী বইরুইয়ের মাধ্যমে বাদুড় থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পিঁপড়াখেকো আঁশওয়ালা প্রাণীটির অস্তিত্ব বিপন্ন।

সহজে শনাক্ত করা, পাস্পরিক সংস্পর্শ বৃদ্ধি বা বন্যপ্রাণীকে ধ্বংস করার হার বৃদ্ধিকে বন্যপ্রাণী থেকে জীবাণু সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তুলে ধরেন অধ্যাপক জোনস।

অধ্যাপক কানিংহাম বলেন, ঝুঁকির জায়গাগুলো শনাক্ত করা গেলে বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি না করেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

শরীরে অনেক ভাইরাস বহন করলেও বাদুড় প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বলে তাদের রক্ষায় সোচ্চার পরিবেশবাদীরা।

কানিংহাম বলেন, “মশাসহ ফসলের ক্ষতিকারক অনেক ধরনের পোকা খায় বাদুড়। এরা ফল খেয়ে বীজ ফেলে বনায়নেও ভুমিকা রাখে।”

২০০২-২০০৩ সালের সার্স ছিল করোনাভাইরাস ঘরানারই। সার্স ও নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বন্যপ্রাণীর কেনাবেচা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু পরে চীন, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আবার চালু হয় বন্যপ্রাণী কেনাবেচা। 

নতুন করোনাভাইরাসের এই সময়ে চীন আবারো নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বন্যপ্রাণীর বাজারে। এবারের নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে এসেছে।

আরেকটি সম্ভাব্য মহামারির ঝড় সামাল দিতে ভিন্ন দেশ থেকে, ভিন্ন পরিবেশ থেকে বন্যপ্রাণী ধরে একসঙ্গে মিশিয়ে রাখা বন্ধ করার উপর জোর দেন ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট অ্যাঞ্জেলিয়ার অধ্যাপক ডায়না বেল।