ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। অনেকে পরীক্ষা করছে না, কিন্তু লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে ডেঙ্গু, বলেন এক চিকিৎসক।
Published : 16 Sep 2024, 11:00 PM
ছুটির দিন সকালেও রাজধানীতে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে তিনজন চিকিৎসক রোগী দেখছিলেন। তারা বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত ৭০ জন শিশুকে দেখে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। এদের মধ্যে ৪৩ জন শিশু এসেছে জ্বর, ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে।
তাদেরই একজন রাজধানীর তালতলা এলাকা থেকে আসা মেহজাবিন আফরোজ। তিন মাস বয়সি এ শিশুকে নিয়ে এসেছেন তার মা তামান্না আখতার। বলেন, “গত সাত দিন ধরে মেয়ের জ্বর, ঠাণ্ডা। তিন চার দিন ধরে সেটা আরও বেড়ে গেছে। সঙ্গে পাতলা পায়খানা হচ্ছে। কিছুই খেতে চায় না।”
সোমবার দিনের প্রথমভাগে তার মতো আরও মা ও অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটিতে রাজধানীর মিরপুর রোডে শিশু হাসপাতালে ভিড় করেছেন। সরকারি ছুটির দিনে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তারা।
আগের দুদিনের বৃষ্টিতে এদিন তাপমাত্রা কিছুটা কম, তবে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। চিকিৎসককে দেখানোর অপেক্ষায় থাকা শিশুরাও গরমে ঘামছে। তাদের কেউ কান্না করছে, কেউ অস্থির হয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা হাতে থাকা কাগজ দিয়ে তাদের গায়ে বাতাস দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
চিকিৎসক ও অভিভাবকরা বলছেন, গত কয়েকদিনের তীব্র গরম প্রভাব ফেলেছে শিশু স্বাস্থ্যের ওপর। জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা শিশুদের ভিড় বেড়েছে। গত কয়েকদিন আগের চেয়ে বেশি রোগী আসছে হাসপাতালে।
সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে থেকে ২৫৮ জনকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১১৮ জনই সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছে।
এদিন সকালে শিশু হাসপাতালে তিন মাস বয়সি ছেলে রুমানকে নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এসেছেন তার বাবা-মা।
শিশুটির বাবা রায়হান উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গরম বাড়ার পর তার ছেলে সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় শিশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।
“গত কয়েকদিন বেশ গরম ছিল, এরপর আবার বৃষ্টি। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে তার শরীরটা খারাপ করেছে, সে খুব ঘেমে যায়। অনেক ঠান্ডা-জ্বর, সঙ্গে কাশি। কাশতে কাশতে বমি করে দেয়। রাতে ঠিকমত ঘুমাতেও পারে না কাশির জন্য।”
মুশরাফা মনজুর মাইরিন নামে এক বছর বয়সি এক শিশুর মা নাজনীন আরাফাত বলেন, তার মেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়।
“তার ইমিউনিটি খুবই কম, প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরমধ্যে গত কয়েকদিন ধরে আবার গরম বেড়েছে। তিন দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এজন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।”
শাহরিয়ার হাসান নামে ২ বছর ৭ মাস বয়সি আরেক শিশুর মা দিলরুবা ইয়াসমিন বলেন, “গত এক মাস ধরে তার ঠান্ডা লেগে আছে। আর জ্বর আসছে এক সপ্তাহ আগে, জ্বরটা কমছেই না। মিরপুরের আরেকটা বেসরকারি হাসপাতালে দেখাইছিলাম। কিন্তু ভালো হচ্ছে না তাই এখানে নিয়ে এসেছি।”
পাবনা থেকে সামিউল হাসান নামে তিন মাস ছয় দিন বয়সি এক শিশুকে নিয়ে আসা হয়েছে শিশু হাসপাতালে। তার হৃদযন্ত্রে কিছুটা সমস্যা আছে। পাশাপাশি গত কয়েকদিন ধরে জ্বর-সর্দি থাকায় পাবনার চিকিৎসক তাকে শিশু হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
সামিউলের বাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার কাশি আর ঠান্ডা কমতেছে না। পাবনার ডাক্তার কইলো তারে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগবে। আজ ভোরে রওনা দিছি, একটু আগে আইসা সিরিয়াল দিসি।”
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মুনীবুর রহমান জুয়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার হাসপাতালে অনেক রোগী এসেছে। তাদের বেশিরভাগ রোগী সর্দি-কাশি, জ্বরে আক্রান্ত।
“কয়েকদিন ধরেই টানা বৃষ্টি হচ্ছে, এর আগে আবার বেশ গরম ছিল আবহাওয়া। এ কারণে শিশুরা এ ধরনের রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বাচ্চাদের ঠান্ডা, জ্বর আমরা সব সময়ই পাই। কিন্তু আজ যেটা দেখছি- ঠান্ডা, কাশি নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা একটু বেশি। ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পেশেন্টও অনেক পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে পরীক্ষা করছে না, কিন্তু লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে ডেঙ্গু।”
এদিন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েও দেখা গেছে প্রায় একই চিত্র। এখানেও শিশু বিভাগে অনেক শিশুকে নিয়ে এসেছেন তাদের অভিভাবকরা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আসা সাফওয়ান নামে এক শিশুর মা সামিনা ইয়াসমিন বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে তীব্র জ্বর, কমেই না। এরমধ্যে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়। হঠাৎ করে গরম বেড়ে যাওয়ায় ছেলের জ্বর হয়েছে।”
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকাসহ ১৪ জেলায় তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এসময় ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। টানা দুদিনের বৃষ্টিতে তাপমাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। তবে সোমবার বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকায় অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হয়েছে।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনকার আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরম হচ্ছে। কখনও বৃষ্টি হচ্ছে, আবার রোদ উঠছে।
“এসময় বাচ্চারা খুব ঘামে, আর বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছোটাছুটি করে বলে তাদের ঘাম আরও বেশি হয়। কিন্তু সমস্যাটা হয় আমরা বাচ্চাদের ঘাম মুছে দেওয়ার বিষয়ে অনেকটা উদাসীন। ঘাম গায়ে শুকিয়ে সর্দি-কাশি, নাক বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সংক্রমিত হলে জ্বর আসে, সাথে শ্বাসকষ্ট হয়।”
এই চিকিৎসক বলেন, শুধু সর্দি-কাশি এবং নাক বন্ধ হলে বাসায়ই চিকিৎসা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে ড্রপ নিয়ে নাক পরিষ্কার, অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, কাশির জন্য কফের সিরাপ দেওয়া যায়। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে মধু দিয়ে গরম পানি, লেবু চা, তুলসি পাতার রস দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব।
“কিন্তু যদি ইনফেকশনের লক্ষণ থাকে, ১০০ ডিগ্রির ওপরে জ্বর হয়, শ্বাসকষ্ট হলে তখনই বাচ্চাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। কিন্তু অভিভাবকদের উচিত হবে বাচ্চাদের শরীর মাঝেমধ্যে মুছে দেওয়া, ঘাম মুছে দেওয়া। ঠান্ডা জিনিস বাচ্চাদের না দেওয়া। এগুলো করতে পারলে শিশুদের সুস্থ্য রাখা সম্ভব হবে।”