এবার ডেঙ্গুর উপসর্গ বদলে গেছে; চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে দেরিতে আসায় বাঁচানোর পথ থাকছে না।
Published : 19 Jul 2023, 01:11 AM
ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের পাশাপাশি এবছর মৃত্যুহার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন।
এইডিস মশাবাহিত এই রোগে শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এবারই এত দ্রুত মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৩ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ২২ হাজার ৪৬৭ জনকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে, যাদের মধ্যে মারা গেছেন ১২৭ জন। সে হিসেবে এবার ১৮৯ জন রোগীর বিপরীতে একজন মারা যাচ্ছেন, মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এর আগে ২০১৯ সালে রেকর্ড ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে দেখেছিল বাংলাদেশ। তার মধ্যে মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। অর্থাৎ গড়ে ৫৬৬ জন রোগীর মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়, মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ।
২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা যান ১০৫ জন, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। অর্থাৎ প্রতি ২৭০ জনে ১ জন মারা গেছেন; মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ।
অনেক রোগী এমন পর্যায়ে হাসপাতালে আসে, যখন আর কিছুই করার থাকে নামুগদা হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান
২০২২ সালে হাসপাতালে যাওয়া ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে মারা যান ২৮১ জন। সে হিসেবে ২২২ জনে মারা গেছেন ১ জন, মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এর আগে ২০১৫ সালে ১৬৬২ জন রোগীর মধ্যে ৩ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ রোগীর মধ্যে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ২৭৬৯ জন রোগীর মধ্যে ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এবছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি রোগীও ভর্তি হয়েছে সরকারি হাসপাতালটিতে।
এই হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বলছেন, যারা মারা গেছেন, তারা হাসপাতালে এসেছেন অনেক দেরি করে, তাদের আইসিইউতে পাঠাতে হয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক রোগী এমন পর্যায়ে হাসপাতালে আসে, যখন আর কিছুই করার থাকে না। আমাদের ৯৫ শতাংশ মৃত্যুই আইসিইউতে। তাদের প্রত্যেকের অবস্থা জটিল ছিল।
“আইসিইউ এমন জায়গা, যেখানে সাধারণত মাল্টিপল প্রবলেম নিয়েই রোগীরা ভর্তি হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকে না, ব্লাড প্রেসার রেকর্ড করা যায় না, অর্থাৎ মাল্টি অর্গ্যান ডিসফাংশন সিনড্রম।”
নিয়াতুজ্জামানের পর্যবেক্ষণ, উপসর্গ বদলে যাওয়ায় এবার রোগীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও বুঝতে পারছে না। সে কারণেই তারা হাসপাতালে আসছেন দেরিতে।
তিনি বলেন, “এবার কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রম দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত হলে দেখা যাবে উপসর্গগুলোও অস্বাভাবিক।
“আমরা অনেক রোগী পেয়েছি, যারা ডায়রিয়া নিয়ে এসেছে। অনেকে বমি নিয়ে এসেছে। পেটে-বুকে পানি জমেছে, হাত-পা ফুলে গেছে, এমন রোগীও এসেছে। মস্তিষ্কের প্রদাহ, খিঁচুনি নিয়ে এসেছে। অনেকের সেন্স আছে, কিন্তু ব্লাড প্রেসার রেকর্ড করা যাচ্ছে না। জ্বর অনেক সময় থাকে, অনেক সময় থাকে না। অনেক সময় রোগীরা ভাবে তারা ভালো হয়ে যাচ্ছে।”
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলছেন, “১০৩-১০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস জ্বর, ব্যথা, গায়ে র্যাশ হওয়া, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মতো ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো এবার বদলে গেছে।
“এবার ডেঙ্গুর তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না। যেহেতু ট্রিপিক্যাল লক্ষণ নাই, তাই মানুষ বুঝতেই পারে না, তাই টেস্ট করতেও দেরি করে। দেরি হওয়ায় সিরিয়াস অবস্থায় চলে যায়, তখন সেই রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়।”
যারা জটিল রোগে ভুগেছেন, কিডনি-হার্ট-লিভার-ক্যান্সারের রোগী, তারাই বেশি মারা যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
এবার যাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে প্রথমে কেউ আক্রান্ত হলে খুব বেশি জটিল অবস্থা হয় না। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হলে খুব সিরিয়াস হয়ে যায়।”
তিনি জানান, অতীতে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তিনি দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্তের ক্ষেত্রে অন্য একটি উপধরনে আক্রান্ত হন। আর সেক্ষেত্রে তিনি সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ যেমন- ১০৩-১০৪ ডিগ্রি জ্বর, শরীর-মাথা ব্যথা— এগুলোর পরিবর্তে অন্য উপসর্গ যেমন—সামান্য জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি বা অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেসারে ভোগেন। এক্ষেত্রে জটিল রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে।
জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে যদি এই ধারায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ চলতে থাকে, তাহলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবেডা. লেনিন চৌধুরী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করেন, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় এখন অনেকেই ‘সেকেন্ডারি ডেঙ্গু’তে আক্রান্ত হচ্ছে।
“ডেঙ্গুর মূলত চারটি উপধরন। আগে হয়ত একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে, এবার অন্য একটি ধরনে তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে। এই সেকেন্ডারি ডেঙ্গুর উপসর্গ ও লক্ষণ যেমন বদলে যায়, তেমনি জটিলতা ও মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।
“বাংলাদেশে এ বছর যে ডেঙ্গু হচ্ছে, তার বড় অংশ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত। এটাই এবারের ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও অসুখের তীব্রতার অন্যতম কারণ।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষা পূর্ববর্তী জরিপে দেখা গেছে, এ বছর ঢাকার ৫৫টি ওয়ার্ডেই এইডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ।
গত বছর জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৬৬০ জন, মারা যান ১০ জন। এ বছর জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ২২ জন, মারা গেছেন ৮০ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫৬ জন, মারা গেছেন ৩৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বর্ষা মৌসুম দেরিতে আসায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রলম্বিত হওয়ার ধারণা দিয়েছেন।
বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে ঢাকার হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক লেলিন চৌধুরী বলেন, “বর্ষার শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বাড়তে শুরু করেছে বেশি বেশি হারে। জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে যদি এই ধারায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ চলতে থাকে, তাহলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।”
জ্বর হলে দেরি নয়
এখন সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশি, শরীর বা মাথা ব্যথা হলেই দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, “এতে পজিটিভ হলে চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যাবে, জটিলতা এড়ানো যাবে।
“কারও ডেঙ্গু হলে তাকে ৫-৬ দিন মশারির ভেতরে রাখতে হবে, না হলে তার মাধ্যমে আরেকজন আক্রান্ত হবে। এজন্য আর্লি ডায়াগনসিস জরুরি।”
এই চিকিৎসকের পরামর্শ, ডেঙ্গু হলে তরল বার বার খেতে হবে। খেতে না পারলে, বমি-পাতলা পায়খানা হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারও জ্বর হলেই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। আর চিকিৎসক এবং রোগীর স্বজনদের ডেঙ্গুর ঝুঁকিগুলো জেনে রাখা দরকার।
ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর লক্ষণগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, “কালো পায়খানা, যে কোনো ধরনের রক্তপাত, তীব্র পেট ব্যথা, তিন চারবারের বেশি বমি, মুখে খেতে না পারা, তিন চারবারের বেশি পাতলা পায়খানা, ছয়ঘণ্টা ধরে প্রস্রাব না হওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ উপসর্গ। এছাড়া কোনো ধরনের কোমর্বিডিটি, ডায়াবেটিস আক্রান্ত, গর্ভবতী, স্থুলতা, নবজাতকরা ঝুঁকিপূর্ণ, তাদেরও হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হবে।”
এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, পরীক্ষায় এনএসওয়ান নেগেটিভ হলেই ডেঙ্গু নেই এটা ধরে নেওয়া যাবে না। কারণ কিটের সেনসিটিভিটির কারণে অনেক সময় রিপোর্ট নেগেটিভ চলে আসতে পারে। এজন্য আইজিজি, আইজিএম করাতে হবে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের চিকিৎসায় চিকিৎসক এবং অভিভাবক উভয়কেই সতর্ক হতে হবে।
এনএসওয়ান নেগেটিভ হলেই ডেঙ্গু নেই এটা ধরে নেওয়া যাবে নাডা. আহমেদুল কবীর
“একজন কোয়ালিফাইড ডক্টরের কাজ হচ্ছে কোনো পেশেন্টের যদি ডেঙ্গু ডায়াগনোসিস হয়, তাহলে রোগীকে ওয়ার্নিং সিম্পটমগুলো সম্পর্কে ধারণা দেবেন এবং এসব সিম্পটম হলে হাসপাতালে এসে ভর্তি হবেন- এই পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠানো। চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীর অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা কী কী সমস্যা হলে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, কী ধরনের সমস্যা হলে বাসায় থাকবেন তা বলে দেওয়া। আর অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে সেবা করা।”
ধরন বদলে যাওয়ায় এ বছর ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার তাগিদ দিলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “প্রয়োজনে ফিল্ড বা ক্যাম্প হাসপাতাল করতে হবে। সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। প্রয়োজনে স্যালাইন বা লজিস্টিক যে সমস্ত ওষুধের প্রয়োজন, সেগুলো সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে।”