ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার পেলেন যারা

থিয়েটার অঙ্গনে 'বিদ্রোহী কণ্ঠ' হিসেবে পরিচিত প্রয়াত অভিনেত্রী, নির্দেশক ইশরাত নিশাতের নামে এ পুরস্কার চালু করা হয়েছে।

পাভেল রহমাননিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2023, 05:32 AM
Updated : 20 Jan 2023, 05:32 AM

মঞ্চনাটকের আট ক্যাটাগরিতে কাজের স্বীকৃতিতে সেরারা প্রথমবারের মত পেলেন ‘ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার’।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার জাতীয় নাট্যশালায় এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হয়েছেন বদরুজ্জামান আলমগীর, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পুরুষ): সুকর্ণ হাসান, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (নারী): মনামী ইসলাম কনক, শ্রেষ্ঠ আলোক পরিকল্পক: অম্লান বিশ্বাস, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিকল্পক: ইউসুফ হাসান অর্ক, শ্রেষ্ঠ নির্দেশক: মুক্তনীল, শ্রেষ্ঠ মঞ্চ পরিকল্পনাকারী: ইউসুফ হাসান অর্ক, শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা:  মাংকি ট্রায়াল।

প্রতিটি পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ২৫ হাজার টাকা; শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার পুরস্কার ছিল ১ লাখ টাকা।

এর আগে গত ১০ জানুয়ারি প্রতি ক্যাটাগরিতে তিনটি করে মনোনয়নের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করে পুরস্কার বাস্তবায়ন কমিটি।

বাংলাদেশের থিয়েটার অঙ্গনের 'বিদ্রোহী কণ্ঠ' হিসেবে পরিচিত ইশরাত নিশাত ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি।

তিনি প্রয়াত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ারের মেয়ে।

ইশরাত 'দেশ নাটক' নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চে একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। তার মৃত্যুর তারিখে প্রতিবছর ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর অভিনেতা নির্দেশক আফজাল হোসেন ও হৃদি হকের সঞ্চালনায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয়।

স্বাগত বক্তব্যে পুরস্কার কমিটির কো-চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, "ইশরাত নিশাত আমার কন্যা। ছোটবেলা থেকেই ওর বেড়ে ওঠা আমাদের হাত ধরেই। নিশাতের মা নাজমা আনোয়ার নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিল। যার জন্য নিশাতও ছোট থেকেই থিয়েটারের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে।"

দেশের নানা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ইশরাত নিশাতের ‘সাহসী’ ভূমিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে নিশাত। নিশাতের নামাঙ্কিত এ পুরস্কারের মধ্য দিয়ে নিশাত বেঁচে থাকবে এই প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের মাঝে।”

এ বছর পুরস্কারের জন্য গঠিত জুরিবোর্ড সদস্য ছিলেন- অধ্যাপক আব্দুস সেলিম (প্রধান), দেবপ্রসাদ দেবনাথ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, ইউসুফ হাসান অর্ক, কামালউদ্দিন কবির, মোহাম্মদ আলী হায়দার ও আইরিন পারভীন লোপা।

জুরি বোর্ডের প্রধান আব্দুস সেলিম বলেন, “২০২১ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে খুব বেশি নাট্য প্রযোজনা মঞ্চে আসেনি। এজন্য আমরা ২০২২ সালে মঞ্চে আসা নাটকগুলো পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করেছি।”
অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন নির্ঝর চৌধুরী। থিয়েট্রিক্যাল কোরিওগ্রাফি পরিবেশন করেন মাশরুর ও তার দল।

এছাড়া মণিপুরি মৃদঙ্গ পরিবেশন করেন বাবুলাল সিংহ ও তার দল। নাচ পরিবেশন করে দীক্ষা নৃত্যদল।

কিছু সমালোচনা
ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজকেরা যে আমন্ত্রণপত্রটি তৈরি করেছেন, তাতে এক জায়গায় লেখা রয়েছে- ‘বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের জন্য প্রবর্তিত পুরস্কার হিসেবে এটিই প্রথম।’ এ তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করছেন নাট্যকর্মীদের কেউ কেউ। 

এ তথ্য কতটা সঠিক? জানতে চাইলে অগ্রজ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে মঞ্চ নাটকের জন্য প্রবর্তিত প্রতিযোগিতামূলক পুরস্কার হিসেবে ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কারই প্রথম নয়। এই তথ্যটি বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং এ রকম ভুল তথ্য থেকেই ইতিহাস বিকৃতির শুরু হয়।”

তিনি বলেন, “১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় জাতীয় নাট্যোৎসব হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে। সেখানে শ্রেষ্ঠ নাট্য প্রযোজনা হিসেবে তিনটা দলকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। পুরস্কার পেয়েছিল থিয়েটার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ও ময়মনসিংহের বহরূপী নাট্য সম্প্রদায়।”

রামেন্দু মজুমদার জানান, ওই নাট্যোৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে চারজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল; পেয়েছিলেন আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার, আবুল হায়াত এবং চট্টগ্রামের রাহনুমা।

এছাড়া দিনাজপুর নাট্য সমিতিও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই মঞ্চনাটকের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতামূলক পুরস্কার দিচ্ছে। সারা দেশেই বিভিন্ন নাট্যদল সম্মাননা, পদক, পুরস্কার দিচ্ছে। যেগুলো মঞ্চনাটকেরই পুরস্কার বলে জানান রামেন্দু মজুমদার।

পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্যদের মনোনয়ন পাওয়া নিয়েও সমালোচনা এসেছে। জুরি বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক আব্দুস সেলিম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন, পরে এই ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন বদরুজ্জামান আলমগীর।

এছাড়া ইউসুফ হাসান অর্ক জুরি সদস্য থেকেও দুটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন।

বটতলা প্রযোজিত ‘রাইজ অ্যান্ড শাইন’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পান অধ্যাপক আব্দুস সেলিম। ইতালির নাট্যকার যুগল দারিও ফো এবং ফ্র্যাঙ্কা রামের রচনা থেকে ‘রাইজ অ্যান্ড শাইন’ রূপান্তর করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম।

একজন অনুবাদক কী করে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পান? মনোনয়ন ঘোষণার পর পরই তা নিয়ে ফেইসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী।

পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে কমিটির কো-চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “আগামি বছর থেকে জুরি বোর্ডের সদস্যদের নাটক পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে না। এবারই প্রথম ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার দেয়ার কারণে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। সেগুলো আগামীবার থেকে সংশোধন হবে।”

২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রাচ্যনাট মঞ্চে এনেছে আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় ‘আগুনযাত্রা’। কিন্তু এই নাটকটি বিচারকেরা না দেখেই বাতিল করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রাচ্যনাটের বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী। তারা ফেইসবুকে এ নিয়ে পোস্টও লিখেছেন।

প্রাচ্যনাটের মুখ্য সম্পাদক কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা দলের নতুন নাটক জুরি সদস্যরা দেখার সময় করতে পারলেন না। তারপর তারা ওই দলটাকে উপেক্ষা করে পুরস্কারের জন্য নমিনেশন ঘোষণা করে দিলেন। সম্মানীয় কমিটি সেটা অনুমোদনও করে দিলেন। প্রথম বছরেই নিশাত আপার নামাঙ্কিত পুরস্কারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়, খারাপ লাগাটা তৈরি হল।”

বিভিন্ন সমালোচনার বিষয়ে পুরস্কার বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “সমালোচনার সংস্কৃতি ইতিবাচক। এবারই প্রথম ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কিছু ত্রুটি বা অসঙ্গতি ছিল। সামনে নিশ্চয় সেগুলো সংশোধন হবে। সবারই সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা রাখতে হবে। সমালোচনার মধ্য দিয়েই ভালো কিছু হবে।”

আট ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন যারা
শ্রেষ্ঠ নাট্যকার
বদরুজ্জামান আলমগীর, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
মাসুম রেজা, নাটক- পারাপার, নাট্যদল- দেশ নাটক।
আবদুস সেলিম, নাটক- রাইজ এন্ড সাইন, নাট্যদল- বটতলা।
শ্রেষ্ঠ আলোক পরিকল্পক
অম্লান বিশ্বাস, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
মোহাম্মদ আলী হায়দার, নাটক- রাইজ এন্ড সাইন, নাট্যদল- বটতলা।
অম্লান বিশ্বাস,  নাটক- রায়মঙ্গল, নাট্যদল- অনুস্বর।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (পুরুষ)
প্রশান্ত হালদার, নাটক- রায়মঙ্গল, নাট্যদল- অনুস্বর।
খালিদ হাসান রুমি, নাটক- মাংকি ট্রায়াল, নাট্যদল- বাতিঘর।
সুকর্ণ হাসান, নাটক- রাজদ্রোহী, নাট্যদল- এথিক।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (নারী)
সঙ্গীতা চৌধুরী, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
মনামী ইসলাম কনক, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
কাজী রোকসানা রুমা, নাটক- রাইজ এন্ড সাইন, নাট্যদল- বটতলা।
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিকল্পক
শিশির রহমান ও অন্যান্য, নাটক- মলুয়া, নাট্যদল- মেঠোপথ থিয়েটার।
সেলিম মাহবুব, নাটক- মাধব মালঞ্চি, নাট্যদল- থিয়েটার আর্টস ইউনিট।
ইউসুফ হাসান অর্ক, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
শ্রেষ্ঠ নির্দেশক
মুক্তনীল, নাটক- মাংকি ট্রায়াল, নাট্যদল- বাতিঘর।
ইউসুফ হাসান অর্ক, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
ফাহিম মালেক ইভান, নাটক- পারাপার, নাট্যদল- দেশ নাটক।
শ্রেষ্ঠ মঞ্চ পরিকল্পনাকারী
ফজলে রাব্বি সুকর্ন, নাটক- সে এক স্বপ্নের রাত, নাট্যদল- দৃষ্টিপাত নাট্যদল।
ইউসুফ হাসান অর্ক, নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
মুজিবুল হক, নাটক- মলুয়া, নাট্যদল- মেঠোপথ থিয়েটার।
শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা
নাটক- মাংকি ট্রায়াল, নাট্যদল- বাতিঘর।
নাটক- পুণ্যাহ, নাট্যদল- নাট্যকেন্দ্র।
নাটক: পারাপার, নাট্যদল- দেশ নাটক।

পুরনো খবর:

Also Read: ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার: মনোনয়নের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ

Also Read: চলে গেলেন অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী ইশরাত নিশাত