মুখ ও মুখোশের জহরত আরা আর নেই

বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের অভিনেত্রী জহরত আরা আর নেই।

সৈয়দ নাহাস পাশা লন্ডন প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2021, 03:51 AM
Updated : 23 July 2021, 06:41 AM

গত ১৯ জুলাই  লন্ডনের একটি কেয়ার হোমে তার মৃত্যু হয় বলে তার পারিবারিক বন্ধু ফেরদৌস রহমান জানান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আশি বছরের বেশি বয়সী জহরত আরা দীর্ঘদিন ধরে নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন।

পরিবারের বরাত দিয়ে ফেরদৌস রহমান বলেন, কেয়ার হোমে যাওয়ার আগে জহরত আরা থাকতেন নরউইচে, সেখানেই তাকে দাফন করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানাবে তার পরিবার। 

আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ অগাস্ট। এর আগে এই ভূখণ্ডে বাংলা ভাষায় আর কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হয়নি।

পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে এ সিনেমার উদ্বোধন করেছিলেন।

এর ঠিক চার বছর আগে ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষার দাবিতে বাঙালির সংগ্রাম তুঙ্গে পৌঁছায়। ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তে রাঙানো পথ ধরে ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। 

পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ক্ষোভ তখন ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। তখনকার পাকিস্তানি চলচ্চিত্র শিল্পে বাঙালি টেকনিশিয়ান ও কর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, কারণ দেশভাগের কারণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা, সিনেমা নির্মাণে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল।

সেই প্রেক্ষাপটেই যাত্রা শুরু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের। বাংলা ভাষায় সিনেমা বানানোর জন্যই ১৯৫৩ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ডাকাতির খবরকে উপজীব্য করে ‘ডাকাত’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন আবদুল জব্বার খান। সেই কাহিনীকেই চলচ্চিত্রের রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল এরকম- গ্রামের এক জোতদারের দুই ছেলে। তাদের একজন ঘটনা-পরম্পায় ডাকাতদলের খপ্পরে পড়ে। তাদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠে। আরেক ছেলে পড়ালেখা করে, পুলিশ হয়।

কিন্তু ডাকাতদলের সঙ্গে অসৎ পুলিশের যোগাযোগ ছিল। পরিচয় না জানলেও ডাকাত-পুলিশ যোগাযোগের সূত্রে ভাই-ভাই যোগাযোগ তৈরি হয়। এক পর্যায়ে ডাকাত ভাই তার সর্দারকে খুন করে। অসৎ পুলিশ ভাই গ্রেপ্তার হয়। কাহিনী শেষ হয় জোতদার বাবার দুই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।

তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের মত স্টুডিও বা সুযোগ-সুবিধা ঢাকায় ছিল না। মুখ ও মুখোশের প্রযোজনায় এগিয়ে আসে ইকবাল ফিল্মস।

কিন্তু পঞ্চাশের দশকে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্যও নারী শিল্পী পাওয়া ছিল কঠিন। পরিচালক আব্দুল জব্বার শুরুতে ভেবেছিলেন, কোনো পুরুষকেই নারী সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তখন মঞ্চ নাটকে নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয়ের চল ছিল।

পরে মুখ ও মুখোশের অভিনেত্রী খুঁজতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন আবদুল জব্বার খান। চিত্রালী ম্যাগাজিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখেই নবাব কাটরায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইকবাল ফিল্মসের অফিসে যান ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী জহরত আরা আর তার বান্ধবী পিয়ারী বেগম।

পুরান ঢাকার মেয়ে জহরতের ভাই মোসলেহউদ্দীন ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক, ভাবি নাহিদ নিয়াজীও সংগীত শিল্পী। 

বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের পোস্টার

চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত জানান, বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল জহরতের। একজন অ্যাথলেট হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।

জহরত আর পিয়ারী দুজনেই সিনেমার জন্য নির্বাচিত হলেন। কিন্তু পরিবারের আপত্তির মুখে তারা অভিনয় করতে পারবেন কিনা, সেই শঙ্কা ছিল।

জহরত আরা ছিলেন নাছোড়; পরিচালক আব্দুল জব্বার খান তাদের অনুনয়-বিনয় করে তাদের পরিবারকে রাজি করিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।

মুখ ও মুখোশের নায়িকা কুলসুমের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এগিয়ে এলেন চট্টগ্রামের মেয়ে কলকাতার অভিনেত্রী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। নায়ক আফজালের চরিত্রে আব্দুল জব্বার খান নিজেই অভিনয় করেন। পিয়ারী অভিনয় করেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে।

অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। ডাকাতসর্দারের ভূমিকায় ছিলেন ইনাম আহমেদ।

১৯৫৪ সালে ৬ অগাস্ট শাহবাগ হোটেলে মুখ ও মুখোশ সিনেমার মহরত হয়। মহরতে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জহরত আরা।

কালীগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর (বাসাবো) বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, রাজারবাগ ও লালমাটিয়ার ধান ক্ষেত এবং টঙ্গীতে সিনেমার শুটিং হয়। ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর শেষ হয় দৃশ্যধারণ।

১৯৫৬ সালের অগাস্টে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পাওয়ার পর দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। জহরত আরার অভিনয় দর্শকমহলে প্রশংসা পায়। তবে পরে আর কোনো চলচ্চিত্রে তাকে দেখা যায়নি।

জহরত বিয়ে করেন সরকারি কর্মকর্তা ডেভিড খালেদ পাওয়ারকে। চার দশকেরও বেশি আগে তারা লন্ডনে থিতু হন।

জহরত আরার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মী। বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জহরত প্রতিষ্ঠা করেন ইমামউদ্দিন ও বেগম আসমাতুন্নেসা ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেওয়া হত।

[ প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সাইমুম সাদ]