যুক্তরাজ্যে জনি ডেপের হার কেন জয় হয়ে ফিরল যুক্তরাষ্ট্রে?

হলিউড তারকা জনি ডেপ যুক্তরাজ্যের আদালতে ‘সান’ পত্রিকায় বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে হেরে গিয়েছিলেন ২০২০ সালে। দুই বছর পর প্রাক্তন স্ত্রী অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ডের বিরুদ্ধে একই ধরনের একটি মামলায় তিনি জয় পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2022, 08:07 AM
Updated : 4 June 2022, 12:50 PM

জনি ডেপ ও অ্যাম্বার হার্ডের এই মামলা হালের আলোচিত বিষয়; গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার আদালত রায় দিয়েছে, যাতে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে যে সংবাদপত্রে নিবন্ধে সাবেক স্বামী জনি ডেপের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে তার মানহানি ঘটিয়েছেন অ্যাম্বার হার্ড।

সাত সপ্তাহ ধরে চলা এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ২৭ মে। ওই শুনানিতে ১০০ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয় আদালতের।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বরাবরই জনি ডেপের চালান শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে গেছেন ৩৬ বছর বয়সী হার্ড। আর ৫৮ বছর বয়সী জনি ডেপ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন শুরু থেকেই।

শুনানি শেষে ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স কাউন্টি আদালত রায়ে বলেছে, মানহানির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ডেপকে ১ কোটি তিন লাখ ডলার দিতে হবে হার্ডকে।

আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে হলিউড এমনকি জনমানসে ছাপ ফেলা এই দুই তারকার মামলার জয়-পরাজয় এবং দুই দেশে জনি ডেপের একই ধরনের মামলার দুই ধরনের ফল আসার বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।

এই উত্তর খোঁজারও চেষ্টা হয়েছে যে, তবে কি ভবিষ্যতে অভিযোগকারীদের সুবিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই মামলা প্রতিকূলতা তৈরি করে দেবে?

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বিচার শুরু হওয়ার আগে অনেক আইন বিশেষজ্ঞই জনি ডেপকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, মার্কিন আদালতে জনির পক্ষে রায় আসার সম্ভাবনা যুক্তরাজ্যের তুলনায় ক্ষীণ। কারণ ‘বাক স্বাধীনতা’র পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান অনেক জোরাল।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বিচ্ছেদের পরের বছর ওয়াশিংটন পোস্টে যে নিবন্ধ লিখে জনির বিরুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন হার্ড, জুরি বোর্ড তা বিশ্বাস করেনি। তা সাজানো ধরে নিয়ে হার্ডকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মিডিয়া জগত সংক্রান্ত খ্যাতিমান আইনজীবী মার্ক স্টিফেন বিবিসিকে বলেন, একই ধরনের মামলায় বিশাল জলরাশির (আটলান্টিকের দুই পাড়) দুই পাশে বিচার হল, ফল এল ভিন্ন, এটা বিরল এক ঘটনা।

এই আইনজীবী বিশ্বাস করেন, মামলায় যুক্তরাষ্ট্রে জনির জয়ের পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো এখানে একাধিক বিচারকের (৭ জন জুরি) উপস্থিতি। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের আদালতে বিচারক ছিলেন মাত্র একজন।

তার মতে, অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ড জনমতের আদালতে হেরে গিয়েছিলেন, যার পুনরাবৃত্তি জুরির সামনেও ঘটেছে।

‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান’ তারকা জনি ডেপ এবং ‘অ্যাকুয়াম্যান’ তারকা অ্যাম্বার হার্ডের এই মামলা ঘিয়ে হলিউডের দর্শকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি, তবে খ্যাতির বিচারে এগিয়ে থাকা জনির পাল্লাই ভারী।

মামলায় দুই পক্ষের শুনানির প্রতিটি মোড় কোটি কোটি মানুষ দেখেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় জনি ডেপের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে মাঠে নেমে পড়েন। শুধু টিকটকেই ‘জাস্টিসফরজনিডেপ’ (#justiceforjohnnydepp) হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পোস্ট করা ভিডিওটি ১ হাজার ৯০০ কোটি বার দেখেছে মানুষ।

অনলাইনে মামলার বিচারকাজ না দেখাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল জুরিদের। কিন্তু মুঠোফোন সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা তাদের জন্য ছিল না।

অ্যাম্বার হার্ড বলে আসছিলেন, ক্ষমতার বিপক্ষে লড়তে হচ্ছে তাকে। “সে (জনি ডেপ) একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, আর মানুষ ক্ষমতাবানদের পাশেই থাকতে চায়।”

এই মামলা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে হয়রানি, নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথাও বলেছিলেন এই অভিনেত্রী। যাকে ‘নাটুকেপনা’ বলছিলেন জনি ডেপের সমর্থকরা।

যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের আদালতেই জনির আইনজীবীরা দাবি করেন, তাকে নির্যাতন করার বিষয়ে হার্ড মিথ্যা বলেছেন। নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে হার্ডের চরিত্র নিয়ে আক্রমণ এবং তাকেই নিপীড়নকারী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন জনি ডেপের আইনজীবীরা।

মার্ক স্টিফেন বলেন, যৌন ও পারিবারিক নির্যাতন মামলায় সাধারণত আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এক ধরনের কৌশল নিয়ে থাকেন। এই কৌশলকে বলা হয়-‘অস্বীকার কর, তারপর আক্রমণ কর, আর ভু্‌ক্তভোগীকে অপরাধী এবং অপরাধীকে ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন কর’।

এই কৌশলকে সংক্ষেপে ‘ডারভো’ (Darvo) বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী মার্ক স্টিফেন।

ওই ‘ডারভো’ কৌশলই জনি-হার্ডের মামলায় ‘ভুক্তভোগী’ আসলে কোন ব্যক্তি, সেই প্রশ্নে আলোচনা উল্টে দিয়েছে।

এই মামলায় উল্টোটি সামনে চলে এসেছে দাবি করে স্টিফেন বলেন, অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্যাতন বা নিপীড়ন করেছিলেন কি না, সেই প্রশ্নের বদলে সামনে চলে আসে অভিযোগকারী বিশ্বাসযোগ্য কি না?

এই মামলায় যিনি নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর আক্রমণ করে ভুক্তভোগী এবং অপরাধীর ভূমিকা বিপরীত করে ফেলো হয় বলে মনে করেন আইনজীবী স্টিফেন।  

তার মতে, যুক্তরাজ্যের আদালতে বিচারক আইনজীবীদের এ ধরনের কৌশল ধরতে পেরেছিলেন। এ কারণেই জনি নির্যাতন করেছিলেন কি না, সে বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত নয়, এমন অনেক প্রমাণ খারিজ করে দিয়েছিলেন।

বিশেষ করে পুরুষ বিচারকদের ক্ষেত্রে ডারভো কৌশলটি খুবই কাজে দেয় মন্তব্য করে মার্ক স্টিফেন বলেন, নারী বিচারকরাও অনেক সময় এই কৌশলের ফাঁদে পড়ে যান।

এ বিষয়ে মনস্তাত্বিক একটি ব্যাখ্যা দেন এই আইনজীবী। বলেন, সাধারণত মানুষের মতে অপরাধী ব্যক্তির চেহারা এবং তার আচরণ নিয়ে একটি ধারণা আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। আর সেই ধারণা যে বাস্তবের সঙ্গে মিল খায় না, সেটি ভুল হয়, এও বিষয়টিও সবারই জানা।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের সাংবাদিক হ্যাডলি ফ্রিম্যানও দুই দেশে বিচারের মধ্যে পার্থক্যটি ধরতে পেরেছেন, যিনি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাজ্য দুই দেশেই জনির মামলার খবরাখবর সংগ্রহ করেছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, মার্কিন আদালতের বিচার কাজ দেশটির টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। আদালতের বিচারাধীন বিষয়টিও অনেকটা ‘স্পোর্টস গেম’ এ রূপ দেওয়া হয়েছিল।

‘হ্যাশট্যাগ মিটু (#MeToo)’ আন্দোলনের নেতিবাচক একটি প্রতিক্রিয়াও হার্ডের উপরে পড়েছে বলে মনে করেন ফ্রিম্যান।

ভক্তদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে ২০১৫ সালে ঘর বেঁধেছিলেন জনি ডেপ ও অ্যাম্বার হার্ড, কিন্তু দুই বছরের মধ্যে ঘটে তাদের বিচ্ছেদ। এরপর ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে এক নিবন্ধে নিজেকে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হিসেবে তুলে ধরেন হার্ড।

তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাবেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৫ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানহানির মামলা করেন ডেপ। তার পাল্টায় ১০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে পাল্টা মামলা করেন হার্ড।

সেই মামলায় রায় পক্ষে আসার পর জনি ডেপের প্রতিক্রিয়া ছিল- তার ‘প্রাণ ফিরে এসেছে’। অন্যদিকে ‘হৃদয় ভেঙে যাওয়া’ অ্যাম্বার হার্ড এখন করছেন আপিলের পরিকল্পনা।