আলিফ লায়লা যেভাবে এসেছিল বিটিভিতে

নব্বইয়ের দশকে আরব্য রজনীর গল্প অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ‘আলিফ লায়লা’; পরে তা বাংলায় ডাব করে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হলে দর্শকদের মাঝে তোলে আলোড়ন।

সাইমুম সাদ গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2022, 05:53 AM
Updated : 21 April 2022, 11:19 AM

সেই দশকে বিটিভিতে প্রচারিত সব বিদেশি টিভি সিরিয়ালকে ছাপিয়ে ‘আলিফ লায়লা’ উঠে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার চূড়ায়; প্রতি শুক্রবার রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর টিভি সেটের সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন দর্শকরা।

ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা সাগর এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ব্যানারে সুভাষ সাগরের প্রযোজনায় সিরিয়ালটি নির্মাণ করেন আনন্দ সাগর, প্রেম সাগর ও মতি সাগর।

১৯৯৩ সালে তিন শতাধিক পর্বের সিরিয়ালটি হিন্দি ভাষায় ভারতীয় চ্যানেল দূরদর্শন ন্যাশনালে প্রচারে এসেছিল; এর মধ্যে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে বিটিভিতে সেটি প্রচারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

সেই সময়ে বিটিভির অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা নওয়াজীশ আলী খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভারতীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি বাংলায় ডাব করে সিরিয়ালটি বিটিভিতে পাঠিয়েছিল; সেটি দেখে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

নওয়াজীশ আলী খান। ফাইল ছবি

“কয়েকটি পর্ব আমরা দেখে আমরা বুঝেছিলাম, খুব নিখুঁতভাবে বাংলায় ডাবিং করেছিল তারা। সেটা দেখেই আমরা প্রচারে আগ্রহী হয়েছিলাম।”

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে প্রচার শুরু হয়েছিল; ভারত থেকে পাঠানো ডাবিংকৃত সিরিয়ালটি অবিকৃত অবস্থায় প্রদর্শন করেছিল। সেটি প্রচারের জন্য চুক্তি অনুযায়ী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছিল বিটিভিকে।

তার আগে আশির বেশ কয়েকটি ইংরেজি সিরিয়াল বিটিভিতে ‘অরিজিনাল ভাষায়’ প্রচার করা হত; আলিফ লায়লার মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষায় বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের পথ খুলেছিল বলে জানান নওয়াজীশ আলী খান।

১৯৯৫ সালে বিটিভির মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নওয়াজীশ আলী খান; ২০০০ সালে তিনি অবসরে যান। দায়িত্ব পালনকালে বেশ কয়েকটি আলোচিত বিদেশি সিরিয়ালের প্রচারকাজে যুক্ত ছিলেন তিনি।

কতটা জনপ্রিয় ছিল?

এই সময়ে কোনো টিভি অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কেমন-তা টিআরপির (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) মাধ্যমে সহজেই তুলে আনা গেলেও নব্বইয়ের দশকে দেশে টিআরপির কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

ফলে সেই সময়ে সিরিয়ালটি কতটা জনপ্রিয় ছিল- তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বিটিভির কাছে; তবে সেই সময়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, পত্রপত্রিকার রিভিউকে মানদণ্ড ধরে হিসাব কষার চেষ্টা করেছেন নওয়াজীশ আলী খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, সেই সময়ে প্রচারিত বিদেশি সিরিয়ালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল সিরিয়াল ছিল ‘আলিফ লায়লা’। সিরিয়ালটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে তুমুল আলোচনা চলত; তার আঁচ বিটিভির কর্মকর্তারাও অনুভব করতেন।

“সেটি নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছিল সেই সময়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শকরা চিঠি লিখে সিরিয়ালটি নিয়ে নিজেদের মুগ্ধতার কথা জানাতেন। সিরিয়ালটি নিয়ে পত্রিকায় খুব লেখালেখি হয়েছিল।”

তখন ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব সিন্দবাদ’, ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চারস অব রবিনহুড’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত সিরিয়াল প্রচার হয়েছিল বিটিভিতে; দর্শকপ্রিয়তায় ‘আলিফ লায়লা’ সব সিরিয়ালকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। শহর কিংবা গ্রাম, শিশু কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ-সবাই সিরিয়ালটি দেখতে মুখিয়ে থাকতেন।

ঢাকার ব্যাংক কর্মকর্তা ইফতেখার মাহমুদ জানালেন, আলিফ লায়লা প্রচারের সময় তার বয়স ছিল ১০ কিংবা ১২ বছর; পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পাশের বাড়িতে গিয়ে সিরিয়ালটি দেখতেন।

“সূচনা সংগীত ‘আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা’ প্রচার শুরু হলেই যাবতীয় ব্যস্ততা ফেলে টিভি সেটের সামনে ভিড় করতাম আমরা। সেই দিনগুলো এখন খুব মিস করি। এখন অনেক অনুষ্ঠান টিভিতে হলেও আগের মতো আর টানে না।”

সিরিয়ালটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে সেই সময়ের কিশোরদের জীবনেও বেশ প্রভাব ফেলেছিল; বিশেষ করে সিন্দবাদ, দস্যু কেহেরমান, আলাদিন ও মালিকা হামিরার চরিত্রগুলো দাগ কেটেছিল দর্শকদের মনে।

আরেক দর্শক মুস্তাকিম আহমেদ জানালেন, কৈশোরে দস্যু কেহেরমানের মতো এক চোখা চশমা বানানোর চল ছিল তাদের মধ্যে। সিন্দবাদের সোলেমানি তরবারি কিশোরদের আকর্ষণের কেন্দ্রে উঠে এসেছিল। তখন লেখার খাতার মলাটে আলিফ লায়লার চরিত্রের ছবি ছাপানো হতো; সেগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে কিনতেন তারা।

“খেলনা হিসেবে মালিকা হামিরার বিচ্ছু আকরামের খুব প্রচলন ছিল; আকরামের আদলে প্লাস্টিকের তৈরি বিচ্ছু স্কুল পড়ুয়াদের খেলার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।”

দর্শক মুস্তাকিম বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন ‘আলিফ লায়লা’র তুলনায় আরও ঝকঝকে ও চোখ ধাঁধানো ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসে সিরিয়াল নির্মাণ করা হলেও শৈশবের স্মৃতি জড়ানো সিরিয়ালটিকে তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না।

সিরিয়ালটি সংরক্ষণ করার জন্য বিটিভির প্রতি দাবি জানিয়েছেন দর্শকদের কেউ কেউ।

সংরক্ষণের ‘এখতিয়ার বিটিভির নেই’

বাংলাদেশ টেলিভিশন বলছে, সিরিয়ালটি মূলত একবার প্রচারের জন্য প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন; সেই চুক্তি ভেঙে তা সংরক্ষণ কিংবা পরবর্তীতে প্রচারের কোনো এখতিয়ার বিটিভির নেই।

বিটিভির মহাব্যবস্থাপক নাসির মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আলিফ লায়লাসহ বিদেশি সিরিয়ালগুলো মূলত একবার প্রচারের জন্য বিটিভির সঙ্গে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়; একবার প্রচারের জন্যই তাদের অর্থ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি প্রচার কিংবা সংরক্ষণের কোনো চুক্তি হয়নি; সেই আইনি অধিকার নেই আমাদের।”

চুক্তির বাইরে সংরক্ষণ করা কিংবা ইউটিউবে প্রচার করা বাংলাদেশের প্রচলিত কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানিয়েছে কপিরাইট অফিস।

তবে কয়েক বছর ধরেই বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘আলিফ লায়লা’র বাংলায় ডাবিংকৃত রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছে।

নাসির মাহমুদ জানান, এটি তাদেরও নজরে এসেছে; ইতোমধ্যে বিটিআরসিকে অবহিত করা হয়েছে। সেগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ইউটিউব চ্যানেলের কাছে সিরিয়ালটি কীভাবে গেল?-এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিভির মহাব্যবস্থাপক বলেন, “এখন অনেক প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির সহায়তায় টিভির সব অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে পারে। সেটা থেকেও কোনো না কোনোভাবে সেগুলো ইউটিউবে যেতে পারে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সংশপ্তক’ বেশ কয়েকটি দেশীয় সিরিয়াল প্রচার করেছিল বিটিভি; তবে ‘আলিফ লায়লা’ আবারও প্রচারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে বিটিভি।

নব্বইয়ের দশকজুড়ে সিরিয়ালটি বিটিভিতে প্রচারের পর ২০০০ সালের দিকে একুশে টিভিতেও সেটি প্রচারে এসেছিল। কয়েক বছর আগে গাজী টিভিতেও প্রচার হয়েছে।

নির্মাণে, অভিনয়ে ছিলেন কারা; তারা এখন যেমন আছেন

সিরিয়ালের প্রযোজক সুভাষ সাগর ভারতের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের প্রযোজনা করেছেন; আলিফ লায়লার তিন পরিচালক আনন্দ সাগর, প্রেম সাগর ও মতি সাগর তার ছোট ভাই। ২০০৯ সালে ৭২ বছর বয়সে মারা যান সুভাষ সাগর।

সুরকার রবীন্দ্র জৈন। ছবি নিউ ইয়র্ক টাইমস

সিরিয়ালের আবগসংগীত ‘আলিফ লায়লা, আলিফ লায়লা’র সুরারোপ করেছিলেন বলিউডের সুরকার, গীতিকার ও প্লেব্যাক গায়ক রবীন্দ্র জৈন; যিনি ২০১৫ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। তার সুরে আশা ভোঁশলেসহ বলিউডের অনেকেই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি মারা গেছেন; তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শোক জানিয়েছিলেন।

সিন্দবাদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাহনেওয়ার প্রধান; যার বছর এখন ৬০ বছর।

সিরিয়ালের প্রধান চরিত্রগুলোর একটি নাবিক সিন্দবাদের ভূমিকায় অভিনয় করেন ওড়িশার অভিনয়শিল্পী শাহনেওয়াজ প্রধান।

সেই সিরিয়াল নিয়ে আলোচনার মধ্যেই বাঙালি লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বোমকেশ বক্সী’ অবলম্বনে হিন্দি সিরিয়ালসহ বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়ালে দেখা গেছে শাহনেওয়াজকে।

পরবর্তীতে শাহরুখ খান ও নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর সঙ্গে ‘রইস’, অ্যামাজন প্রাইমের আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘মির্জাপুর’-এ অভিনয় করেছেন ৬০ বছর বয়সী এ অভিনেতা। অভিনয়ের পাশাপাশি ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও পরিচিতি তিনি।

আলাদিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবদ্বীপ সিং; পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে বলিউডে নাম করেছেন তিনি।

আশ্চর্য প্রদীপের সন্ধান পাওয়া আলাদিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিল্লিতে জন্ম নেওয়া অভিনেতা নবদীপ সিং; পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে বলিউডে নাম করেছেন।

তার পরিচালনায় ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এনএইচ-১০’ দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়েছে; এতে অভিনয় করেছেন আনুশকা শর্মা।

২০১৯ সালে সাইফ আলী খানকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘লাল কাপ্তান’; আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘পাতাল লোক’র চিত্রনাট্য বিভাগের পরামর্শক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন নবদীপ। পাশাপাশি প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও পরিচিত তিনি।

বাদশাহ শাহরিয়ারের ভূমিকায় দেখা গেছে পাঞ্জাবের অভিনেতা গিরিজা শঙ্করকে; যিনি এ সিরিয়ালে অভিনয়ের আগে ‘মহাভারত’ সিরিয়ালে অভিনয় করে ভারতজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

৭০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ৬২ বছর বয়সী এ অভিনেতা। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা ও প্রযোজনাও যুক্ত আছেন তিনি।

খল চরিত্র কেহের মানের ভূমিকায় বিলাস রাজ।

বাদশাহর স্ত্রী শাহরাজাদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী দামিনি কানওয়াল শেঠি; মঞ্চনাটকে অভিনয় জীবন শুরুর পর টিভি নাটকে পদার্পন করেন তিনি। শতাধিক টিভি সিরিয়ালের এ অভিনেত্রী চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজনায়ও যুক্ত আছেন।

ডাকু কেহেরমেনের চরিত্র ভারতীয় অভিনেতা বিলাস রাজ, ইসমত জাহানের চরিত্র রিতমভারা সাহনিসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছন।