স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও শ্রোতাদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল আবদুল আলীমের; করাচি রেডিও ও পিটিভিতে নিয়মিত গাইতেন তিনি।
রোববার এ শিল্পীর ৪৭তম প্রয়াণ দিবসে তার মেয়ে নূরজাহান আলীম জানালেন, স্বাধীনতার আগে করাচি রেডিও ও পিটিভিতে আবদুল আলীমের শতাধিক গান রেকর্ড করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর রেকর্ডগুলো বাংলাদেশে আর আনা যায়নি; সেগুলো করাচি রেডিও ও পিটিভির আর্কাইভে রয়ে গেছে।
লোকসংগীত শিল্পী নূরজাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বছর তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনের সহযোগিতায় পাকিস্তান থেকে আবদুল আলীমের একটি সাক্ষাৎকার ও কয়েকটি গানের রেকর্ড দেশে আনা হয়।
সাক্ষাৎকারের রেকর্ডটি আলীম পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে গানের রেকর্ডগুলো ‘বাংলাদেশ বেতারে সংরক্ষণ করা হয়’ বলে জানান নূরজাহান।
বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, এই তথ্য তার জানা নেই।
নূরজাহানের ভাষ্যে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও আবদুল আলীমের কয়েকটি গান উদ্ধার করা গেলেও অন্তত সত্তরটির মতো গান এখনও পাকিস্তানে রয়ে গেছে।
নূরজাহান আলীম বলেন, “আবদুল আলীমের গান বাংলাদেশের সম্পদ, তার গান ওই দেশে থাকবে কেন? এর মধ্যে কিছু গান হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে আমরা কিছু গান পেয়েছি। বাকিগুলো আনতে সরকারিভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও আনার চেষ্টা করছি।”
ইতোমধ্যে বাকি গান উদ্ধারে আলীম পরিবারের তরফ থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গান উদ্ধারের অগ্রগতি জানতে চাইলে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখানে এক বছর হল এসেছি। এ বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। আবদুল আলীম সাহেবের কোনো গান এখান থেকে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল-সেটাও আমার জানা নেই।”
পাকিস্তানের বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেই সময় সব গান একসঙ্গে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়নি বলে জানান নূরজাহান।
“রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কেউ যেতে চায় না। তখন সোহরাব সাহেব ছিলেন; তিনি তখন করেছিলেন। আবদুল আলীমের মূল্যায়ন নিজে থেকে না করলে কাউকে দিয়ে করানো যাবে না।”
ঢাকায় এফডিসি প্রতিষ্ঠা ও গ্রামোফোন আসার আগে করাচি রেডিও ও সেখানকার স্টুডিওতে বাংলা গান রেকর্ড করা হত বলে জানান গবেষক শামসুল আলম বাবু।
“আমাদের এখানে রেকর্ডিং সিস্টেমটা ছিল না। এফডিসি কিংবা গ্রামোফোন হওয়ার আগে এখানকার গানগুলো করাচিতে রেকর্ড হত। পরে সেখান থেকে ঢাকায় কপি কিংবা ডিস্ট্রিবিউট করা হত। কিন্তু মাস্টার কপিটা ওখানেই (করাচি) রয়ে যেত। তখন করাচি রেডিওতে বাংলা গান বাজত। গানগুলো সেখানেই রেকর্ড করা হত।”
“এখনও সারা পৃথিবীতে অনেক জায়গায় অনেক গান অনেকভাবে আছে, যেটা এখনও সংরক্ষণ করা হয়নি। পাকিস্তানের পাশাপাশি ইউরোপেও আবদুল আলীম গান করতে গিয়েছিলেন। সেগুলো ওই অঞ্চলগুলোতে রেকর্ড হয়েছে। সেগুলোও কেউ খোঁজে না। সব গান সংরক্ষণ হওয়া দরকার।”
ষাটের দশকে পাকিস্তানে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন আবদুল আলীম। তার গাওয়া ‘পরের জায়গা পরের জমিন’ কয়েক বছর আগে একটি পাকিস্তানি সিরিয়ালে ব্যবহার করা হয়। গীতিকার আব্দুল লতিফের কথায় আবদুল আলীমের কণ্ঠে গানটি দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের শ্রোতাদের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়েছে।
আবদুল আলীম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই ভারতের মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন পালা পার্বনে কীর্তন গাইতেন এই শিল্পী। এরপর লেটো দল, যাত্রা দলের হয়েও গান গেয়েছেন। পরে কলকাতায় এসে কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিনের সাহচর্য পান।
দেশ বিভাগের পর আলীম ঢাকাতে থিতু হন। ক্যারিয়ার শুরু করেন বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ প্লেব্যাক করেছেন তিনি। এরপর আরও অনেক সিনেমাতে গান গেয়েছেন। তার গাওয়া লোকসংগীতের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানগুলো শ্রোতাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে।
তার গাওয়া প্রায় ৫০০ গান রেকর্ড করা হয়েছে। তার বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘কেন বা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ’, ‘যার আপন খবর, আপনার হয় না’, ‘মুখে আল্লাহ আল্লাহ বল’, ‘নবী মোর পরশমণি’, ‘পরের জায়গা পরের জমি’ ইত্যাদি।
১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান আবদুল আলীম। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।