আরে – এই কেতাদুরস্ত লোকটি, যার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বা হয়তো আরও বেশি, সে কিনা মিউজিক বোঝে? সারাদিন তো ছুটোছুটি পয়সার পেছনে! বড় চাকরি, দামী গাড়ি, সুন্দর জীবনযাপন।
এভাবেই গলির মোড়ে পানির গ্যালন বাজানো ছেলেটা বা শখ করে গিটার শেখা মেয়েটা একদিন হারিয়ে যায় জীবন চক্রের মোহে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের গ্লিটজ’য়ের নতুন সিরিজ ‘কর্পোরেটের আড়ালে’ দিয়ে খুঁজতে চাইছে এমনই সব গল্প – যে গল্পগুলো এখন হয়ত কেউ জানে না। বা শোনার সময় নেই। বা কেউ হয়ত জানতেও চায়নি। কিন্তু এই গল্পে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যান্ড ঘরানার সেই স্বর্ণালী ইতিহাস। যে ইতিহাসের কারণেই আজ অনেকেই সঙ্গীত নিয়ে জীবনযাপন করার কথা ভাবতে পারে।
আজকের গল্প- তৌফিক আলম তমালের। বর্তমানে তাকে সবাই চেনেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার উঁচু পদের কর্মকর্তা হিসেবে। আবার কিছুটা শখের মডেল রূপেও মাঝে মাঝে তাকে দেখা যায় বিজ্ঞাপনে।
তবে এই শখের মডেলের স্বপ্ন ছিল বড় মিউজিশিয়ান হওয়ার।
তমালের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার অফিসটাই সেরা জায়গা। সেখানে তার একটা গিটার আছে। নিজের জন্য কেনা প্রথম প্রসেসরটাও আছে। এখন কাজের ফাঁকে বা পরে সেখানে গিটারে ছন্দ তোলেন। মাঝে মাঝে অনলাইনে সেই জ্যামিংটা ছেড়েও দেন।
অথচ কজন জানে- তার স্বপ্নই ছিল বেইজিস্ট হওয়ার।
সেই স্বপ্ন শুরু হয় স্কুল জীবন থেকেই।
এক জন্মদিনে বাবা তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য একটা গিটার কিনে রাখেন। সেটা লুকিয়েও রাখেন। কিন্তু সেই আমলের ছোট্ট বাসায় সারপ্রাইজ লুকানো দায়।
তমাল পেয়ে গেলেন তার প্রথম চাবি- যে চাবি দিয়ে স্বপ্নের তালাটা খোলা যায়।
এরপরের গল্প শুরু করার আগে লম্বা চুলের গল্পটা না বললে কেমন যেন হয়ে যায়।
সেই আমলে লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে গিটার বাজানো, যেটাকে বলে ‘খ্যাপ’ আয়োজনে।
আরেক পরিচিত চেনামুখ সামিউল মাশুক এন্টনি খোঁজ-টোজ দিলে এক দৌড়ে গিয়ে বাজিয়ে আসা। কিসের টাকা – কিসের কী? গিটার বাজানোর হবে- এটাই আনন্দের। হেসে জানান তমাল।
কিন্তু কথায় আছে না? জীবন একটা সিনেমাও বটে। সিনেমার গল্প পরে হয়। জীবনে সেই চিত্রনাট্য রচিত হয় আগেই।
তাও একজন মিউজিশিয়ানের কল্যাণে। তিনি রোকসানা খ্যাত শেখ সাহেদ। একটা সময় শাহেদের ব্যান্ডের নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। এখনও সাহেদ তাকে সদস্যই বলেন। গেল বছরও চারুকলায় একটি শোতে বাজিয়েছেন একসঙ্গে।
কিন্তু তখন সঙ্গীতের পাশাপাশি চাকরিটাকে বরণ করতে হয়। শুরু হয় তমালের চুলের ঝুঁটি এবং গলার টাইয়ের সহাবস্থান।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইউনিট্রেন্ডে তিনি যোগ দেন। ‘এন্টার্ন’ হিসেবে। তার আগে তিনমাসের বেকারত্বে বেহাল ছিলেন তিনি। যদিও বাবা কিছু বলেন না। তবুও সমবয়সি প্রেমিকা হওয়ার কারণে বিয়ে করার তাগিদেই এই সিদ্ধান্ত নেন তমাল।
সাহেদের ফোনে বলা, হাতে বায়োডাটা নিয়ে তমাল সেদিন কর্পোরেট জীবনে প্রবেশ করেন। তখন ওই অফিসে সুমাইয়া শিমু, নাতাশা হায়াতও পেশাগত দ্বায়িত্ব পালন করতেন।
অতএব শুরুটা তার স্বপ্নের ছিল। এক স্বপ্ন বনাম আরেকটি স্বপ্ন। শুরু হলো তমালের অন্য রকম গল্প।
এবার যাওয়া যাক তমালের আগের গল্পে।
সেই বাবার কেনা পুরানো গিটারে হাতেখড়ি নিয়ে।
সব মিলিয়ে হল না।
১৯৯৩ সালে ৮শ’ টাকা দিয়ে পরে কেনা হল সেই গিটার। শুরু হল ড্রামজের বদলে গিটারের তারে স্বপ্ন বোনা।
বড় ভাইয়ের বন্ধু বাবু ভাই এসে প্রথমে তালিমের সূচনা করলেন। নয়াটোলার বাসায় বড় ভাই নিয়ে গেলেন। তালিমের জন্যই। সেই নোটবুক এখনও আছে।
সেই তালিমে গিটারের অ-আ-ক-খ ভালোই শিখে নিলেন। লিটন অধিকারী রিন্টুর কাছে চার্চে গিয়ে গিটার শেখাও শুরু হল। কিন্তু পরীক্ষার কারণে সেই যাত্রাটার সেখানেই সমাপ্তি।
কিন্তু গিটার শেখা শেষ হয়নি।
এরপরে সেই উত্তরাতে গিয়ে গিটার শিখবেন বলে ঠিক করেন তিনি ও তার আরেক বন্ধু। কিন্তু সেই আমলে এ তল্লাট থেকে সেই তল্লাটে যাওয়া খুব সহজ ছিল না।
উত্তরা রীতিমতো গ্রাম একটা। বাসে চেপে যেতেই মনে হত কোন দূর দেশে চলে যাচ্ছেন যেন।
এরপরে বিভিন্ন শোতে বাজানো, সাহেদের ব্যান্ডে সংযুক্তি – তার সঙ্গে স্টুডিওতে যাওয়া- সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি সময় ছিল যেন তমালের। কারণ- এতদিন যাদের ক্যাসেটের মোড়কে দেখেছেন- সেই আশিকুজ্জামান টুলু, মাকসুদ- তাকে নাম ধরে ডাকেন! এই বা কম কী।
এর মাঝেই একটি ঘটনা তাকে জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি এনে দেয়।
তৎকালীণ রমনা রেস্তোরাঁতে একটি অনুষ্ঠানে বাজাচ্ছিলেন তমাল। সঙ্গে সাহেদ এবং পরে বাংলা ব্যান্ডের নিয়মিত সদস্য বুনোও আছেন। বাজাতে বাজাতে দেখলেন কেউ একজন হেঁটে আসছেন। তিনি আর কেউ নন, লাকী আখন্দ!
লাকী আখন্দ সামনে বসে তার দিয়ে তাকিয়ে আছেন। আর ওদিকে তমালের হাটুদ্বয় বেশ ঠোকাঠুকি করে গিটারের সঙ্গে ছন্দ দিচ্ছেন।
বাজানো শেষে লাকী এসে হাত মেলান। আর বলেন, ‘ম্যাক্সিকান ফ্লামেঙ্কো’ ভাব আছে তোমার বাজানোতে। আমি জানি না তুমি বুঝে বাজালে কিনা! কিন্তু তোমার বাজানোতে একটা অন্য ফ্লেভার আছে।”
আর বললেন, “তুমি একটা গান আমার সঙ্গে বাজাও।”
নিজের সেটআপ নিয়ে আসার পরেও এই নিমন্ত্রণে আনন্দে আটখানা হয়ে যান তমাল। কিন্তু মনে ভয়, পারবেন তো?
সেদিন পেরেছিলেন।
কিন্তু পরে সেই সঙ্গীতকে নিয়ে চলতে পারেননি।
তমালের মনে আছে, বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজের চাপে তিনি প্র্যাকটিসে সময় দিতে পারতেন না। মনে অপরাধবোধ জাগতে থাকে। যেখানে চার ঘণ্টা সময় দেওয়ার কথা- সেখানে হয়ত দিতেন দেড় বা দুই ঘণ্টা।
অফিস থেকে বের হয়ে টাই খুলতে খুলতে দৌড় দিতেন প্যাডে। একটা সময়ে মনে হল আর নয়।
সাহেদকে ডেকে একদিন বললেন, তিনি পারছেন না। কারণ পরিবারের প্রতি দ্বায়িত্ব, প্রেমিকাকে স্ত্রী করার তাড়া আর বাবা মাকে একটু আনন্দের জীবন দেওয়াটাই তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ছুটে গেল মিউজিক। কেটে ফেললেন ঝুঁটি। প্যাডে দৌড়ানো বাদ দিয়ে টাইটাকেই মেনে নিলেন।
তবে তমাল এটাও স্বীকার করেন, তিনি বেছেছিলেন, কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু বা জেমস সেটা করেনি। তারা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন বলেই বাংলাদেশের ব্যান্ড আজকে স্বর্ণালী দিনের চর্চা করতে পারে।
তাদের সেই ‘রুটি ভাগ করে খাওয়ার গল্প’ বা বাবার ব্যবসার হাল না ধরে রুপালি গিটারের মোহে সুরের চর্চা করার যে দিন গেছে- সেই দিনের বিনিময়েই বাংলাদেশ পেয়েছে একজন জেমস, কুমার বিশ্বজিৎ বা আইয়ুব বাচ্চু।
তমাল বারবারই বলেন, পেটের দায়েই তিনি পারেননি এই ত্যাগ স্বীকার করতে। কারণ এদেশে সেই প্রফেশনালিজম গড়েই ওঠেনি- যার মাধ্যমে কোনো সঙ্গীতপ্রেমী নিজেকে সুরের সাগরে হারানোর স্বপ্ন দেখতে পারেন।
কপিরাইট, সম্মানির পাশাপাশি এটাও বলেন, “এমনকী ডিজেরাও যে সম্মান পায়, একটা অনুষ্ঠানে তরুণ ব্যান্ড শিল্পীরা সেই সম্মান পেতেন না।”
বিশেষ করে তমালে মতে, ক্রিকেটের জন্য যেমন একাডেমি আছে- একারণে সাকিব আল হাসানের মতো ট্যালেন্ট উঠে আসে- তেমনটা হলেই কেবল ব্যান্ড মিউজিক প্রেমীদের এই ছন্দে টিকিয়ে রাখা যাবে।
অথচ সেই আমলেও শেখার ইচ্ছার কমতি ছিল না। শুধু মাত্র গিটারের ক্যাসেট কিনে শুনে শুনে তালিম নেওয়া, হেঁটে হেঁটে ম্যাগাজিন কিনতে যাওয়া, সঙ্গীতের ওপর পড়ে পড়ে শেখা- তারপরে হলুদে বাজানো থেকে লাকী আখন্দের সঙ্গে বাজানো- সবকিছুর পরেও তমাল তার প্রিয় সঙ্গীত ছেড়ে দিলেন।
অনেকের বাসার মতো আপত্তি নয়- বরং বাবা বা বড় ভাইয়েরও সম্মতি এবং আশকারা ছিলও বটে। ছিল প্রথম অফিসের সহকর্মীদের মৌন ভালোবাসা। শুধু ছিল না উপার্জনের নিশ্চয়তা।
তাই তমাল আজকে তৌফিক নামে পরিচিত। টাই নিয়ে আছেন। যদিও তিনি মনেপ্রাণে চান, তার সন্তান যেন চুলে ঝুঁটি বেঁধে মঞ্চ কাঁপাবে।
শুধু পাওয়ার পয়েন্ট সাজাবেন না।
কর্পোরেটের আড়ালে লুকিয়ে যাওয়া এই মুখের সংখ্যা কম নয়।
গ্লিটজ তুলে আনবে সেই মুখগুলোকে সকলের সামনে। যেন তাদের কষ্টের গল্প শুনে রচিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের সাফল্যের ইতিহাস।