সুশান্ত: রাজ্যত্যাগী রাজপুত্র

বিস্তৃত হাসির এক টগবগে তরুণ সুশান্ত সিং রাজপুত। মাত্র সাত বছরের ক্যারিয়ারে বলিউডে জনপ্রিয়তা আর আস্থার স্থান তৈরি করা, আর তারপর কোনো এক রবিবার ‘গলায় ফাঁস দিয়ে নিজের জীবন শেষ কর’- এই তার ৩৪ বছরের জীবনের গল্প।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2020, 05:19 PM
Updated : 16 June 2020, 07:54 AM

কোনো ট্র্যাজিক সিনেমার থেকে কম কষ্টের নয় এই পরিণতি। আর তাকে নিয়েই এবার  লিখেছেন আরাফাত শান্ত।

সুশান্ত সিং রাজপুত যে বলিউডের রাজপুত্তুর হারিয়ে গেলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময়ে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট লাগে যে সুশান্ত সিং আর নেই। এমন না যে তিনি প্রাণঘাতী মহামারীতে অথবা কোনো একটা জটিল রোগে চলে গেছেন। বলা যায় মৃত্যুকে তিনি নিমন্ত্রণ দিয়ে, স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেলেন। কাল থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সবার। এরকম হাস্যোজ্জ্বল মানুষের হঠাৎ এরকম বিদায়।

কত আর বয়স তার? ৩৪-৩৫! নিজেকে প্রমাণ করে কেবল থিতু হয়েছেন বলিউডে, এরমধ্যেই এ কাণ্ড! অথচ গোটা জীবন থেকেই তিনি একরোখা যোদ্ধা। খুব বেশী বিত্তশালী ঘরে তার জন্ম নয়। পরিবারের কেউ সিনেমার সাথে জড়িত ছিলেন না।

তবে বড় হয়েছেন খুব আদরে। বাসার ছোট ছেলে। যত্ন আর ভালোবাসার কমতি ছিল না। তিনি ছিলেন লাজুক ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। অনেক কথা জমলেও বলতেন অল্পই। বাবা মায়েরও সাধ্য ছিল কম। অনেক কিছু টাকার অভাবে করতে পারেননি।

সুশান্তের এক বোন রাজ্য দলে ক্রিকেট খেলতেন। তবে সুশান্তের মায়ের অকালে ঝরে যাওয়া সবকিছু এলোমেলো করে দেয় ২০০২ সালে। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এ কষ্ট তাকে পুড়িয়েছে। আত্মহত্যার আগেও শেষ টুইট ছিল মাকে নিয়ে।

পাটনা থেকে তাদের পরিবার দিল্লিতে থাকা শুরু করেন। মূলত অভিনয়ের প্রতি সুশান্তের আগ্রহ শুরু সেখানেই।পড়াশোনাতেও ছিলেন ভালো। ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্স এক্সামে সপ্তম হন। দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তেন আর থিয়েটার করতেন। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার ও মডেলিং।

এত কিছু করতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ হারান। শেষে চার বছরের কোর্স তিন বছর অব্দি পড়ে কলেজ ছেড়ে দেন। এরপর অভিনয় করার জন্য হন মুম্বাইমুখী।

স্টারপ্লাসের সিরিয়ালে এক অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তার যাত্রা শুরু। তবে এর মাধ্যমে জিটিভির ‘পবিত্র রিশতা’ সিরিজে নায়কের চরিত্র পান। সুশান্ত ও অঙ্কিতা লোখাণ্ডের জুটি সারা ভারতের ঘরে ঘরে বিখ্যাত হয়ে যায়। ভারতীয় সিনেবাজারের খবর অনুযায়ী, অঙ্কিতাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন সুশান্ত। পর্দার ভেতরে ও বাইরে তাদের রসায়ন ছিল দেখার মত। তবে তাদের সেই সম্পর্ক পরে ভেঙে যায়।

সুশান্ত সিরিয়ালেই থামতে চাননি। অভিনয়ের ওয়ার্কশপ করতেন, নাচ শিখতেন। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন চলচ্চিত্রের জন্য।

সুযোগ মিলে যায় চেতন ভগতের উপন্যাসের সিনেমা এডপ্টেশন, 'কাই পো চে' তে। সুশান্ত আর রাজকুমার রাওয়ের অভিনয় হয় সব জায়গায় প্রশংসিত। 'শুধ দেশি রোমান্স' সিনেমায় তার অভিনয় ঘোষণা দেয়- নতুন দিনের বড় তারকা এসে গেছে। এরপর শুরু হয় সুশান্তের উত্থান।

'পিকে' সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় দর্শক আজো ভুলতে পারে না। পরিচালক রাজকুমার হিরানী তাকে চিনতেন না। এক কাস্টিং ডিরেক্টর দেখিয়ে দিয়েছিলেন- ‘এ ছেলেটা খুব ভালো’। তাতেই সুশান্তকে সিনেমায় নিয়ে ফেলেন হিরানী। পরে ‘রাবতা’ সিনেমার ব্যর্থতা সুশান্তকে অভিনয়ের প্রতি আরো মনোযোগী করে তোলে।

‘ধোনি দ্যা আনটোল্ড স্টোরি’ তে তিনি দেখিয়ে দেন বায়োপিকে কীভাবে অভিনয় করতে হয়। ফিল্মফেয়ার মনোনয়নও পান। কিন্তু পুরস্কারটা পান রণবীর সিং।

তারপর ‘কেদারনাথ’ সিনেমাটা ভালো না চললেও ‘সনচিরিয়া’ করে সুশান্ত দেখিয়ে দেন, অভিনেতা হিসেবে তিনি কত ভালো। ‘দঙ্গল’ খ্যাত নিতেশ তিওয়ারি পরিচালিত ‘ছিচোড়ে’ সিনেমার দুর্দান্ত অভিনয় আবারও বাণিজ্যিকভাবে সফল অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে সুশান্তকে।

ওই সিনেমায় মূল বিষয় ছিল- ‘ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে চেষ্টা করতে হবে। সফল যদি নাও হও, তবুও তো তুমি চেষ্টা করেছিলে!’

সুশান্ত নিজেই হয়ত মনে রাখতে পারলেন না সে শিক্ষা। তার আরেকটি সিনেমা সামনেই মুক্তি পাবে- ‘দিল বেচারা’। জন গ্রিনের বিখ্যাত উপন্যাসের হিন্দি সংস্করণ। সে উপন্যাসেও নায়ক মারা যায়। সুশান্তও চলে গেলেন সাফল্যের চূড়ায় থেকে।

হয়ত বিষণ্নতা আর অবসাদে তিলে তিলে শেষ হয়েছেন। যদিও তিনি ছিলেন বেখেয়ালি এক মানুষ। নিজের কত টাকা সে হিসাব রাখতেন না। চ্যারিটি করতেন প্রচুর। তার একটি সংগঠন ছিল যারা হাজারো দরিদ্র ছাত্রকে সহায়তা করত। নারী উদোক্তা, মানসিক স্বাস্থ্য- কতকিছু নিয়ে কাজ করেছেন।

তার চলে যাওয়া মানেই ভুলে যাওয়া নয়। ফেইসবুকে তাকে নিয়ে সবার যে শোক- তা অভাবনীয়। ভক্তদের এ ভালোবাসাতেই তিনি বেঁচে থাকবেন।