‘সব ক’টা জানালার’ সুর কাঁদিয়েছিল সাবিনাকে

যে দেশপ্রেমের টানে একাত্তরে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, সেই একই আকুলতা দেশের গানে ছড়িয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দেশের গানে বুলবুল যতটা দরদ দিয়ে সুর বসিয়েছেন, ঠিক ততটাই দরদ দিয়ে তার অনেক গানই কণ্ঠে তুলেছেন আরেক কিংবদন্তী শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2019, 08:51 AM
Updated : 22 Jan 2019, 09:38 AM

বিশেষ করে গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন- এই ত্রয়ীর কালজয়ী সৃষ্টি ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’ গানটি তো এখন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে।

সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে আরও কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন; বুলবুলের সুরে কণ্ঠে গান তুলেই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

যে কণ্ঠে বুলবুলের করা সুর ছড়িয়ে দিয়েছেন সারাদেশে, জনপ্রিয় সব গানের স্রষ্টার প্রয়াণের পর সাবিনার সেই কণ্ঠেই স্মৃতিচারণে যেন বেশি কাতরতা।

বাংলা সংগীতের অন্যতম প্রভাবশালী এ সুরকার-কণ্ঠশিল্পী জুটির আবির্ভাব গত শতকের আশির দশকে। সাবিনা ইয়াসমিন তখন দারুণ জনপ্রিয় আর ব্যস্ত শিল্পী। বিপরীতে বুলবুল সংগীতে নতুন; পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজছেন। মাঝে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ নামে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করে নিজের হাত পাকিয়েছেন।

বুলবুল তার একটি গান করার জন্য সাবিনা ইয়াসমিনকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমিন ভেবেছিলেন, ‘ছোটমানুষ কী করবে!’

কি মনে করে হঠাৎ সাবিনা একদিন সেই ছোট ছেলেটিকেই ডেকে বললেন, ‘তোমার কিছু গান শোনাও তো।’ দুয়েকটি গান শুনেই ‘থ’ বনে গেলেন। গানের সুরগুলো মনে কোনে দাগ কেটে গেল তার।

সেইদিনের স্মৃতি ঘেঁটে সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, “এখনও মনে আছে। অদ্ভুত ছিল সেই সুর! একদম আলাদা সুর। আমাদের দেশে এমন গান তো শুনিনি। আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।”

একটা নয়, বুলবুলের পাঁচটির মতো গানের সুরে কণ্ঠ তুললেন তিনি। সেই গানগুলোর মধ্যে ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি’, ‘একদিন ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

সব ক’টা জানালা খুলে দাও না

নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো বাঙালির স্বাধীনতা নিয়ে গানের প্রতি বেশি দুর্বলতা ছিল আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের।

নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে কালজয়ী গানটিতে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমিন। আলাপচারিতায় গানটির পেছনের গল্প তুলে আনলেন তিনি।

সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, “নজরুল ইসলাম বাবুকে গানটি লেখার ধারণা দিয়েছিলেন বুলবুল। বাবুও কিছু ধারণা যোগ করে নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে গানটি লেখা হয়েছিল।”

প্রথমবার গানটির সুরে কেঁদে ফেলেছিলেন বলে জানালেন তিনি।

“আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেছি। এও কী সম্ভব! বুলবুলকে বললাম, সুরটা তুমি এরকমভাবে কী করে এতো সুন্দরভাবে বসালে? আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস।”

রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বুলবুলের দেশাত্ববোধক গানগুলো আর দশটা গানের চেয়ে আলাদা বলে মনে করেন তিনি। 

“উনি (বুলবুল) মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; সেকারণে তার গানগুলোও বৈচিত্রময়। ওনার দেশের গানগুলো আর আট-দশটা দেশের গানের মতো না। প্রত্যেকটা গানের মধ্যে ছবি আছে; গানটা যখন শুনছি, তখন দেখতেও পাচ্ছি।”

‘বুলবুলের মূল্যায়ন করতে পারিনি’

মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া এ শিল্পীকে জীবদ্দশায় যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি বলে আক্ষেপ ঝরেছে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে।

মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ওনাকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি। বুলবুলের মতো এমন প্রতিভা আসবে বলে মনে হয় না। সেরকম জিনিয়াসের আসলে কোনো দাম দিতে পারিনি। এখন আমরা অনেক কথায় বলছি, বলব কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায় আসলেই কোনো মূল্য দিতে পারিনি।”

তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা এত কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন; এটা সবাই পারে না। সে হিসেবেও কিন্তু অনেক কিছু পাওয়ার মতো ছিল, কিন্তু পাননি।”

বরেণ্য এ সুরকারকে ‘জিনিয়াস’ অভিহিত করে তার এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াকে দুঃখজনক বললেন সাবিনা।

“তার প্রয়াণে যে ক্ষতি হল, তার শূন্যস্থান কখনই পূরণ হবার নয়। বুলবুলের মতো মিউজিক ডিরেক্টর কখনো আসেওনি; ভবিষ্যতেও আসবে কি না জানি না। তাকে সালাম জানাই।”

ইচ্ছে ছিল আবারো একসঙ্গে গান বাঁধার..

মাস চারেক আগেও শয্যাশায়ী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের দেখা করতে গিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন; আশায় ছিলেন, সুস্থ হয়ে ফিরলে আবার একসঙ্গে গান করবেন। কিন্তু তার আগেই মঙ্গলবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওপারে পাড়ি জমান তিনি।

আফসোসের সুরে সাবিনা বলেন, “আমার অপূর্ণ ইচ্ছাটা আর পূরণ হল না।”

 

ইতোমধ্যে তাদের পুরানো গানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

“বিটিভির আমলের গানগুলো বিটিভির কাছে আছে কি না জানি না। বিটিভির যে অবস্থা তাতে গানগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে গানগুলো রিমেক করেছি। তা না হলে এতদিন মানুষ গানগুলো শুনতেও পেত না; হারিয়েই যেত।”

তার কণ্ঠে তোলা বুলবুলের সুরে আরো বেশ কিছু নতুন করে সঙ্গীতায়াজোনের পরিকল্পনা আছে বলেও জানালেন সাবিনা ইয়াসমিন।

বুলবুলের সুর করা যেসব দেশাত্মবোধক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন সেগুলো হল- সব কটা জানালা খুলে দাও না, ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে, সেই রেল লাইনের ধারে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য, ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি, মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না, একতারা লাগেনা আমার দোতারাও লাগে না।

এর বাইরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে চলিচ্চিত্রের যেসব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি (এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে সহযাত্রী চলচ্চিত্র), পৃথিবীতো দু দিনেরই বাসা, দু দিনেই ভাঙে খেলাঘর (সৈয়দ আবদুল হাদীর সঙ্গে ‘মরণের পরে’ চলচ্চিত্র), একদিন দুইদিন তিনদিন পর, তোমারি ঘর হবে আমারি ঘর (এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে ‘মহামিলন’ চলচ্চিত্র)