আত্মজয় হচ্ছে নিজেকে ভেতর ও বাহির থেকে মুক্ত করে আপন শক্তির মহিমায় অবলোকন করা, তারপর ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য সেই আত্মশক্তিকে ইতিবাচকভাবে প্রয়োগ করা।
এইভাবে একটি সফল বিদ্রোহ সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কালক্রমে এমন একটি কর্মপদ্ধতিতে বিবর্তিত হয়ে যায়, যা নিজেকে ও অন্যকে মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজনে ইতিবাচক সক্রিয়তায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে।
বিদ্রোহ কেবল একবার ঘটে না, বার বার ঘটে। জীবন নবায়িত হয়, নবায়িত হয় চাহিদা, নবায়িত হয় নতুন সময়ের নতুন দ্রোহের সম্ভাবনা। চলচ্চিত্র ‘ভুবন মাঝি’ এরকমই বাঙালির ধারাবাহিক সংগ্রাম ও আত্মজয়ের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে।
‘ভুবন মাঝি’র পটভূমি ১৯৭০ সাল। শুধু মুক্তিযুদ্ধই ‘ভুবন মাঝি’র মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয় একটা মানুষের ভিতরের শক্তি জেগে ওঠার প্রয়োজনে যে প্রেক্ষাপট দরকার এবং তা পার করার যে সময়ের প্রয়োজন সে সময়টা পার হওয়ার একটা জার্নি অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৩ বছরের গল্প। বিদ্রোহ, মানবিকতা, প্রেম, ইতিহাস, সংগ্রাম, সংস্কৃতি এসবই এই ছবির বিষয়বস্তু।
বড় পরিসরে কাজের চিন্তা থেকে ‘ভুবন মাঝি’ করার সিদ্ধান্ত নিইনি, বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের ফলে কাজটি করা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।
চলচ্চিত্রটিতে নন লিনিয়ার স্টোরিলাইনের কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করা হয়েছে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই ধারার গল্প নিয়ে কাজ খুব একটা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমানের সংমিশ্রণে তৈরি নন লিনিয়ার কনসেপচুয়াল স্ক্রিপ্টের একটা ইতিবাচক মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে ‘ভুবন মাঝি’ চলচ্চিত্রটির সর্বাংশে।
চলচ্চিত্রটিতে বর্ণিত হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এক বাউল মনোভাবাপন্ন যুবকের কথা।
রবীন্দ্র-নজরুল-লালনে মজে থাকা থিয়েটার পাগল যুবক নহির সাঁই, রাজনীতির পালাবদলে যুদ্ধবাস্তবতায় দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি নিজেকে খোঁজার যুদ্ধই এখানে মুখ্য।
রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম, নজরুলের বিদ্রোহ চেতনা আর লালনের আমিত্ব- এই তিনের সংমিশ্রণে যার মনে সে স্বাভাবিকভাবেই সময় নেবে সিদ্ধান্ত নিতে। তবুও এই সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে থেমে থাকেনি রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়, কেবল ফরিদার(প্রেয়সী) প্রতি ভালবাসাই তাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে, মানুষ আর জানোয়ারের পার্থক্য করতে শিখিয়েছে।
প্রেয়সী, মা, মাটি এই তিন ভালোবাসার একই রূপ বাউল মতের এই অপূর্ব চিন্তা চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
‘ভুবন মাঝি’ একটি ধারাবাহিক সংগ্রাম ও আত্মজয়ের গল্প, যেখানে ৬ দফা আন্দোলন, নির্বাচন, স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ভারত সরকারের সহযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সেই অপশক্তি কর্তৃক বাউল শিল্পী, ভিন্নধর্মী মানুষদের ওপর হওয়া অত্যাচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবকিছু উঠে এসেছে অকপটে।
আরেকটা লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে এই চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে একটা ইতিবাচক রূপে তুলে ধরা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যিনি ঊর্ধলোকে তর্জনী উঁচিয়ে সামষ্টিক বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিমানুষের প্রান্তমুক্ত বিদ্রোহী সত্তার বাস্তব অভিব্যক্তিকেই মূর্ত করেছিলেন।
ব্যক্তিবাঙালি আর সর্বকালের সর্বপ্রান্তের ব্যক্তিমানুষের শক্তিমত্তার এই জয়গান মূলত প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক তাবৎ প্রতিকূলতাজয়ী মানবিক শক্তিরই অনিবার্য স্বীকৃতি। বিষয়টি পূর্বে এতো স্পটভাবে বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে আসেনি যেটা আমরা করার চেষ্টা করেছি।
সরকারি অনুদানের স্বল্প বাজেটেই এই চলমান চিত্রটি সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছি। চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে, গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন লালন সাঁইপন্থি বাউলকে বেছে নিই।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার প্রাগপুর অঞ্চলের যার বসতি, নাম নহির সাঁই, যিনি বাউল দর্শন অনুসারী হয়েও পাকিস্তানিদের বর্বরতর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে।
সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে স্ক্রিপ্ট তৈরির অভিপ্রায়ে কুষ্টিয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠকদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ও গবেষণার মধ্যদিয়ে ‘ভুবন মাঝি’ গল্পটি দাঁড় করাই।
যা ছিল অনেক দীর্ঘসূত্র ও ব্যয়বহুল। অর্থনৈতিক সমস্যাটি একটি বড় সমস্যা, সরকার থেকে প্রাপ্ত সীমিত অর্থের উপর ভিত্তি করে এধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা অনেক কঠিন। রিফ্লেক্ট মাল্টি মিডিয়ার সত্বাধিকারী কাজী মনসুর উল হকের (প্রযোজক, ‘ভুবন মাঝি’) সহযোগিতায় কাজটি করা আমার জন্য কিছুটা সহজ হয়েছে।
১৯৭০-৭১ সালের ইমেজ জন্য লোকেশান নির্বাচন, কস্টিউম, প্রপস ইত্যাদির ব্যবস্থাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। কুষ্টিয়ার মানুষের কাছে চির-ঋণী কেননা কুষ্টিয়ার মানুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা না পেলে আমার এধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হতনা।