এখন অভাবের বড় অভাব: প্রতুল মুখোপাধ্যায়

গাইতে গাইতে শিখেছেন, গুরু মেনেছেন ‘সবাইকে’, অভাবের কখনো ‘অভাব হয়নি’। বাজনাহীন সেই অভাবের দুনিয়ায় পথ খুঁজতে খুঁজতে গায়কীর যে কায়দা রপ্ত করেছেন, তাতেই তিনি হয়ে উঠেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2016, 03:01 AM
Updated : 26 Nov 2016, 05:41 AM

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে পরিচিত গান সম্ভবত ‘আমি বাংলায় গান গাই’।

তবে এপার-ওপারের লোকগান আর গণসংগীতের সুর যাদের কানে গেছে, তাদের অনেকেই প্রতুলের কণ্ঠের ‘লং মার্চ’ শুনে পৌঁছে গেছেন বিপ্লবের চীনে। ‘ছোকড়া চাঁদের’ সঙ্গে আফ্রিকার খনি শ্রমিকের রাতভর কী কথা- সে গল্প প্রতুল তাদের শুনিয়েছেন। ‘ছোট্ট দুটি পায়ে’ চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে তিনি শ্রোতাকে দুনিয়া ঘুরিয়েছেন; ‘স্লোগান’ গানে বুঝতে শিখিয়েছেন, কে ভাই, আর কে দুশমন।

এক সময়ের নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড লং রেঞ্জ প্ল্যানিং বিভাগের সাবেক প্রধান ব‌্যবস্থাপক প্রতুল গানকেই করেছেন সমাজ বদলের হাতিয়ার।

পঁচাত্তরে পা রাখা এই গানের কবির ভাষায়, গান তিনি গান না, বলেন।

দেশভাগের আগে বরিশালে জন্ম নেওয়া এ শিল্পীর সুরের সঙ্গে পরিচয় ১২ বছর বয়সে; নিজে গান লেখা শুরু করেন ১৯৬৯ এসে। তারপরও দশককাল ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।

১৯৮২ সালে এক বন্ধুর অনুরোধে আসেন পর্দার সামনে; সেই থেকে চলছে তার মগ্নযাত্রা।

গত ২০ নভেম্বর কলকাতার বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বেঙ্গল থিওসোফিক্যাল সোসাইটিতে এক অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিলেন প্রতুল। সেখানেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মিনিট ত্রিশেক কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: লোকসংগীতকে প্রতুল মুখোপাধ্যায় সব সময় খুবই গুরুত্ব দেন; আজ যখন আধুনিক যন্ত্রে ওই লোকগান পরিবেশন হচ্ছে, সেটা কীভাবে দেখছেন?

প্রতুল: দেখুন, লোকসংগীতের বিকৃতি একটা বিরাট সমস্যা। মানুষের ভেতরে যত সুন্দর জিনিস, যেমন নারীর সৌন্দর্য, গানের সৌন্দর্য, গান থেকে যে উন্মাদনা; তা মানুষের মধ্যে ঢেউ খেলে যায়। এ সমস্ত ব্যাপারগুলোর খোঁজ বণিকেরা রাখে এবং পণ্যায়িত করে। পণ্যায়িত করার সময় ওরা খেয়াল করে- তাড়াতাড়ি কী করে এটা কারও নার্ভে লাস্টিং ইফেক্ট রাখতে পারে, বা ইমিডিয়েট ইফেক্ট করে। ওরা এটাও দেখে, পণ্যায়নের সময় এমনভাবে রাখতে হবে যেন- যে উত্তেজিত হবে তার প্রাক প্রস্তুতির প্রয়োজন না হয়।

যেমন কোনো নগ্ন নারীর সৌন্দর্যকে অনুধাবন করতে গেলে চারুকলা সম্পর্কে যে প্রাক-প্রস্তুতি থাকতে হবে, মানে এখানে লেখাপড়া করতে হবে তা নয়; বণিকেরা এসবের মধ্যে রাখতে চায়। সৌন্দর্যের মধ্যে অবগাহন করতে হয়, এই যে ব্যাপারটা... এটা না থাকলে কী হবে, ওই যে নগ্ন নারী তাকে শুধু যৌনতা দিয়ে মাপা হবে... এতে ইন্সট্যান্ট একটা ইফেক্ট হয়, কোনো রকম প্রাক-প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না।

এটা যেমন ছবির ক্ষেত্রে, তেমনি গানের ক্ষেত্রেও।

লোকগান শুনতে গেলে একটা প্রস্তুতি লাগে। বাংলা আধুনিক গানের রস আস্বাদন করা, গানকে অনুধাবন করা, এপ্রিশিয়েট করা এর জন্য কিন্তু একটা প্রচণ্ড রকমের প্রস্তুতি লাগে। প্রস্তুতিটা যে সুধীর চক্রবর্তীর বই পড়ে বা আশুতোষ ভট্টাচার্য‌্যের বই পড়ে হবে, তা বলছি না। প্রস্তুতিটা হচ্ছে- ওদের (বাউল/ফকির) সাথে মেশা, ওদের জীবনচর্চা সম্পর্কে একটা ধারণা রাখা। মাঝে মাঝে ওদের পালা-পার্বণে গিয়ে ওদের নাড়িটা, পালসটা ধরার চেষ্টা করা। এইগুলো না থাকলে লোকগানের তাৎপর্য বোঝা যায় না।

যদিও এখানে লোকগানের কিছু অদ্ভূত চটকদার উপাদান আছে। পাঞ্জাবের ভাংড়া দেখবেন, ওরা ওইখানে কিছু চটকদার, তালপ্রধান ওই ব্যাপারগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে তার সঙ্গে মালমশলা মিশিয়ে কিছু যৌন উপাদান ঢুকিয়ে একটা প্যাকেজ তৈরি করছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ওরা ভাংড়া রক বলছে...

প্রতুল: এখন সবই রক। এখন লালনও রক। সবই রক।

 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এখনকার ছেলে-মেয়েরা বলছে, তারা এখনকার জেনারেশন। তাদের সময় যে যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে তারা সেটা দিয়েই গান করবে...

প্রতুল: আপনি যদি রাশিয়ার জর্জিয়ান ফোক ড‌্যান্স... ওটা মাঝে মাঝে এখানে হয়, সেটা যদি দেখেন তবে দেখবেন, ওরা যেসব যন্ত্র ব্যবহার করছে, একেবারে সেই সময়কার। সেই সময়কার যন্ত্রগুলোকে ধরা রাখা। বিভিন্ন অবস্থায় কীভাবে বিহেভ করে সেটা দেখা, টোন ধরে রাখা। এটা কিন্তু ওই সিন্থেসাইজার বাজানোর চেয়ে অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক। অনেক বেশি টেকনোলজিকাল। ওই ব্যাপারটাকে আগের মত রেখে কাজ করাটার মধ্যে কৃতিত্ব অনেক বেশি। তাতেই কিন্তু ওই লোকগানের ঐতিহ্যটা ধরা যায়।

আগে যে গীতিআলেখ্য হত- তাতে কী হত? সামনে গান গাওয়া হত, তার সঙ্গে নাচা হত... এখন সিডিতে সব বাজে তার সঙ্গে সব ইয়ে হয়। গানটানগুলো সব পেছনে পেছনে হয়। এগুলো হচ্ছে ফাঁকিবাজি। এটা নয় যে তারা দোতরার বদলে সিন্থেসাইজার বাজিয়ে প্রগতি আনলে। তা কিন্তু নয়। পারে না দোতরা বাজাতে তাই... (হাসি), হ্যাঁ। মানে হচ্ছে, মধুর অভাবে গুঁড় খায়। এটা কিন্তু মোটেও প্রগতির লক্ষণ নয়। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক, যেমন ওরা এমন করতে পারে... সিন্থেসাইজারে আমি একবার করেছিলাম। জাপানি ফর্মে গান গেয়েছিলাম... ‘হিরোশিমা’। ‘ফিরিয়ে দাও আমার বাবা-মাকে’ শুনেছেন কি না?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: শুনেছি।

প্রতুল: সিন্থেসাইজারে এমন একটা মুড আনল; তাতে জাপানের একটা অবসলেট ইন্সট্রুমেন্ট। যেটা কেউ এখন আর বাজায় না, সেটা ওরা ইন্সট্রুমেন্টে বাজিয়ে ধরে রেখেছে। এমনতো হতেই পারে যে ওই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আগেকার সময়ে যে সাউন্ডগুলো তৈরি হত, এখন কলাকুশলীর অভাবে সেই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো আর আনা যাচ্ছে না। অথবা কেউ সেটা আর বাজাতে পারছে না।

এখন যদি কেউ কোনো টেকনোলজি দিয়ে সেই সমস্ত সাউন্ডগুলোকে রিপ্রোডিউস করবার দক্ষতা অর্জন করে তাহলে কিন্তু তারা একটা ভালো কাজ করছে। কারণ তারা ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাজনার যে ফ্রিকোয়েন্সি- সেটাকে আনছে। এবং তার সঙ্গে গান গাইলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর কিছুটা আবহ পাওয়া যায়। এদিক থেকে এটা কিন্তু বিরাট কাজ; হ্যাঁ।

কিন্তু যেগুলো অবসলেট হয়ে গেছে, সেই যন্ত্রের একজন বাদক আছে, তিনি চলে গেলে এটা আর কেউ বাজাবে না, এটা যদি রেকর্ড করে ওই ফ্রিকোয়েন্সিগুলোকে রাখে, যাতে এখানে সিন্থেসাইজারে সারেগামা বাজালে ওই যন্ত্রের সারেগামা আসবে, তাহলে বুঝতাম টেকনোলজি একটা বড় কাজ করছে। কিন্তু তা না করে ওই যন্ত্রের বদলে প্যাঁপড় প্যাঁপড় করে- ওই আমাদের কুরুচিকর হিন্দি ফিল্মের কিংবা বাংলাদেশি ফিল্মের বাজনা-টাজনা বাজিয়ে তার সঙ্গে সমান্তরাল করে দেবে; তাহলে কিন্তু তারা ভালো কাজ করেনি। এটা অসম্মান হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার গানে যন্ত্রের ব্যবহার কম থাকে। এর আগে একবার আপনি বলেছিলেন, আপনার কাছে কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ...

প্রতুল: বিষয়টা তেমন না। কথাটাতো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমি কখনো কখনো তান বিস্তার করেছি, তাতে কোনো যন্ত্র নেই। আসলে আমার যে ফর্ম, সেখানে গান গাওয়ার চেয়ে বেশি হয় গান বলা। আমি কমিউনিকেট করছি। কমিউনিকেশনের সবচে ভালো উপায় হচ্ছে নিঃশব্দতার উপরে, যেমন স্লেটের উপরে লেখা হয়। নিঃশব্দতার উপরে আমার শব্দগুলো মুদ্রিত। এটা কমিউনিকেশন। ‘চুপ করো, ও কথা বলছে’। এখন আমি যখন কথা বলছি তখন যদি বেশি জগঝম্প বাজে তা হলেতো কমিউনিকেশনটা সে রকম হল না।

‘আপনার ইন্টারেস্টের ওপর ছড়িয়ে পড়ব’- নাটকের এই যে ব্যাপারটা, এটা আমি আনি বাচন আর গায়নকে কাছাকাছি আনার জন্য। আবৃত্তি এবং খুব কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। এজন্য নৈঃশব্দের পটভূমি যত ভালো হয় সেরকম আর কিছুতে হয় না। এটা আমার মনে হয়েছে।

দুই নম্বর হল- এটা কেন এমন? এটা কী করে হয়ে উঠল, সেটার সবচে বড় উপাদান হচ্ছে অভাব।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: অভাব?

প্রতুল: অভাব। বহু নতুন জিনিসের বহু নতুন কাজের অভাব। এখানে সিঁড়িগুলো নেই। তাহলে আমি কী করব? আমি বেয়ে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করব। কারণ কী? সিঁড়ির অভাব। আমি কখনো প্রথাগতভাবে গান শিখিনি। আমার কাজে কখনো বাজনা ছিলোই না। ফলে আমি যে কমিউনিকেশনের কায়দাটা রপ্ত করেছি, আস্তে আস্তে এমন হয়ে গেল যে বাজনার প্রয়োজনই হচ্ছে না। আমার সংগীত জীবনে অভাবের অভাব ছিল না। অভাবের অভাব যাদের- তাদের খুব দুঃখ। এখনকার শিশুদের অভাবের বড় অভাব। এজন্য তারা হাতে ন্যাকড়া দিলে দড়ি বেঁধে সেটাকে পুতুল বানাতে পারে না।

 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: এজন্যই কী ১২ বছর বয়সের পানু (প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ডাক নাম) ‘ধান কাটার গান’ সুর করেছিল? খুব সম্ভবত সেটা আপনার প্রথম সুর।   

প্রতুল: এটাতো... প্রথম সুর যদি বলেন আরও আছে। এটা হচ্ছে প্রথম কোনো কবিতার গীতিরূপ। এর আগে থিয়েটারে গান করেছি। নাটকের গানগুলো, কথাগুলো সুর করেছি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তখন কী আসলেই ১২ বছর বয়স ছিল?

প্রতুল: হ্যাঁ, ১২ বছরইতো ছিল। এক জায়গায় যখন গান গেয়েছিলাম, তখন আমার সঙ্গে একজন হারমোনিয়াম বাজালেন। চুঁচুড়াতে খুব নামকরা শিল্পী, চিত্ত ঘোষ; আর আমি হাফপ্যান্ট পরা একটা ছেলে। এখনতো স্টাইল করে পরে, তখন স্কুলের ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরত। আমাকে তুলে দিয়েছে, জানে এই ছেলেটা গান গাইতে পারে। এই প্রতুল গান গাইবে। আমি গান গেয়েছি। ভদ্রলোক হারমোনিয়াম বাজালেন। পরে আমাকে বললেন, ‘তুমিতো ভালো গাইলে। কে গানটা শিখিয়েছে?’ বললাম, ‘আসলে এটা হয়েইতো ছিল। মনে ছিল, গানের মত করে গেয়েছি।’ সুর করাটা যে একটা কীর্তি সেটা আমার মনেই নেই। ভদ্রলোক বিশ্বাস করতে পারলেন না।  পরে ৫৭ তে ১৫ বছর বয়সে আমি বিষ্ণু দে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কবিতাকে গান করেছি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: জ্যাক প্রিভেরের কবিতাওতো...

প্রতুল: ওটাতো অনেক পরে... ৮৫ তে। ওগুলোতো (বিষ্ণু দে’সহ অন্য কবিদের কবিতার সুর) ৫২ থেকে ৫৭ এর মধ্যে। ৫২ তে বইটা পেয়েছি, বিষ্ণুদের মৌভোগ করেছি। (১৯৫৪ সালে বড় ভাইয়ের কাছে উপহার পাওয়া বই থেকে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমরা ধান কাটার গান গাই’ ছড়াটি সুর করেন প্রতুল) তখন আমার অসমীয়া গান শোনা, ভূপেন হাজারিকার গান কানে এসেছিল। ওখানে অসমীয়া সুরের ইয়ে ছিল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আর প্রতুল মুখোপাধ্যায় যখন সেজদা কমরেড নামে পরিচিত হল? (নকশালবাড়ী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর প্রতুলের ছদ্ম নাম ছিল সেজদা কমরেড)

প্রতুল: তখনতো নানারকম সুর এসেছে। চীনা সুর এসেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: লং মার্চ গানটা?

প্রতুল: লং মার্চে খুব একটা চীনা সুর আসেনি। ওটাতে খুব যে একটা সুরে প্রভাবিত হয়েছি তেমন না। আমার যেমন এসেছে। ওটা একেবারে আমার মত করে। ওটা হচ্ছে গানটা বলা। লং মার্চ বললেই লোকে ভাবে ড্রাম-ট্রাম চলবে। একেবারেই আমি সেভাবে দেখি না। মাও জে দং প্রকৃতি দেখছেন (চীন বিপ্লবের সময় কমিউনিস্ট পার্টির লং মার্চ। প্রতুলের সুর করা গানটি মাও জে দংয়ের লেখা কবিতা); প্রকৃতিকে দেখার সময় মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এ রকম করে দেখে (মার্চপাস্টের ভঙ্গি করে দেখালেন), এ কারণে আমি ড্রাম বিট ব্যবহারই করিনি। কোনো রকমের রিদম রাখা হয়নি। কিন্তু রিদম আছে। সেটাকে প্রকট করা হয়নি। এর মধ্যে আমার বাংলা আধুনিক গান শোনার যে কান, বিশেষ করে অখিল বন্ধু ঘোষ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এদের গানে যে মেলোডির ব্যবহার- এগুলো সব আমার গানের মধ্যে ছিল। সে গণসংগীত বলুন, আর যাই বলুন।

(এ সময় প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিজেই তার ‘লং মার্চ’ গান থেকে কয়েক কলি গেয়ে উঠলেন)

এর মধ্যে মেলোডি আছে। তো... ন্যাচারালি আমি কবিতাটাকে যেভাবে দেখেছি সেভাবে সুর করেছি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানে তাহলে লোকগানের সঙ্গে বাংলা আধুনিক গানের রেশও রয়েছে?

প্রতুল: বরং বলতে পারেন, আমার গানে আগেকার গণসংগীতের প্রভাব খুবই কম। গণসংগীতের সঙ্গে... সলিল চৌধুরীর গান মাইকে বাজত। সিনেমায় হত। সেগুলো কানে গেছে। প্রথাগতভাবে শিখিনি বা কমিউনিস্ট পার্টিতেও ঢুকিনি... ‘ঢেউ আসছে/কারা ফুঁসছে’... এভাবে কেউ শেখায়নি। সলিলের প্রচুর উত্তরসূরি আছে। তাদের সুর প্রায় সলিলের মতই লাগে। আমারতো সেরকম হয়নি। রানার, গায়ের বধূ, দূরন্ত ঘূর্ণি গাইতে পারতাম। সেগুলি গাইতে পারতাম। ওর কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব আমার গানে পড়েনি। বরং বহু পরে একটা গান আমি সুর করেছিলাম। তার মধ্যে হয়ত একটু ছোঁয়া থাকতে পারে। কিন্তু নকশালবাড়ীর আমলের গানে সেই প্রভাব পড়েনি। বাংলা কাব্যগীতির যে ঐতিহ্য মোটামুটি সেটাকেই নিয়েছি।

(এ পর্যায়ে প্রতুল তার ‘চেয়ে দেখ আজ’ গান থেকে দুটো লাইন গেয়ে শোনান)

মেলোডিয়াস না?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: গান বলা বা কমিউনিকেট করার যে বিষয়টা প্রতুল মুখোপাধ্যায় করেন; মানে আপনার স্টাইলটাতো দুই বাংলায় সেভাবে বোধহয় চর্চা কেউ করে না। তাহলে এটাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার...

প্রতুল: কেউ যদি... কোনো একটা জায়গায় যদি আমি যেতাম, ওঠা-বসা থাকত, তাহলে হয়তো হত। আমিতো অর্গানাইজার না, যে বললাম- ‘এখানে এসো’... হেমাঙ্গ বিশ্বাস এগুলো করতেন। আমি সেরকম অর্গানাইজার নই। আমার কাছেতো কেউ সারেগামা, সাতমাত্রা শেখে না।

বাউলরা যে রকম গান শেখে গুরুর কাছ থেকে। শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে শেখে, আমিও তাই। এগুলো হয় বুঝলেন... ঠিক তৈরি করাটা... আমি বলতে পারি না। তৈরি করা যায় কিনা... মারাদোনা পায়ের ওপর বল রাখতে পারতেন। এটা শেখানো যায় না। হয়ে গেছে কোনোভাবে। না হলে ১২ বছর বয়সে এভাবে সুর করতে পারি?

সেদিন শ্রীকান্ত বলছিল (কলকাতার আধুনিক গানের শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য) ধান কাটার গানের মাঝখানে যে বিষাদের জায়গাটা আসছে। এই জায়গায় যে লয়ের চেইঞ্জ, সেটা কীভাবে করলাম। আমি বললাম- হয়তো ওরকম গান শুনেছি। আমরা করব, গ্রামার আমাদের পেছন পেছন যাবে। আমি করছি। আগে আমার, তারপর গ্রামার।

আমি বলি সব সময়, সবাই আমার গুরু, সবাই আমার শুরু। সবার কাছ থেকে আমি শিখছি। এমনকি নোংরা গান থেকেও শিখি। নোংরা গান যদি হয়, দেখতে হবে সেখান থেকে গ্রহণীয় কী আছে। এই যে নর্দমার জল... ঠিকমতো প্রসেস করলে মাছের খাদ্য পাওয়া যাবে। নর্দমার জল মানেই ফেলে দিতে হবে তা নয়। আমি কখনও কিছু ফেলিনি। সবাই আমার গুরু। যারা রাস্তায় গণসংগীত করে তারাই আমার গুরু শুধু নয়। একদিন শুনি ওয়ান ডাইমেনশন বলে আঠারো বছরের একটা ছোঁড়া নাকি মেয়েদের মাথা ঘুরিয়ে ফেলছে। শুনলাম, কী ব্যাপার দেখি। এই তো...

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার বাড়িতো বরিশালে...

প্রতুল: জন্মেছি। বাবা অশ্বিনী দত্তের স্কুলে পড়াতেন। বেশি মনে নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: যাবেন আবার?

প্রতুল: যদি কেউ নিয়ে যায়। ডাক্তার আমাকে একা ট্র্যাভেল করতে বারণ করেছে। এখানকার এসইউসি (স্যোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া) নিয়ে গিয়েছিল। এর আগেরবার উদীচী নিয়ে গিয়েছিল।

তো হল তো আপনার? আমি এবার যাই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

প্রতুল: নমস্কার