'সাতভাই চম্পা’: লোককাহিনির চিরন্তন আবেদনের দৃষ্টান্ত

‘শোনেন শোনেন জাঁহাপনা, শোনেন রানী ছয়জনা, শোনেন বলি নতুন করে পুরান ঘটনা’ - বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় এই গানটি শোনেননি এমন শ্রোতা পাওয়া মুশকিল।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2016, 09:31 AM
Updated : 14 April 2016, 09:31 AM

গানটি যে চলচ্চিত্রের তার নাম ‘সাত ভাই চম্পা’। বাংলাদেশে লোককাহিনিভিত্তিক অসংখ্য সিনেমা নির্মিত হয়েছে এবং লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসাসফল হয়েছে। ‘সাতভাই চম্পা’কে এ ধরনের সিনেমার পথিকৃত বলা চলে।

বাংলার একটি সুপরিচিত রূপকথা ‘সাতভাই চম্পা’। সিনেমার শুরুতে দেখা যায় সুলেমানপুরের বাদশাহর ছয় রানী। কিন্তু বাদশাহ নিঃসন্তান। বাদশাহ স্বপ্ন দেখেন দরবেশ তাকে বলছে মৃগয়ায় যেতে। সেখানে তিনি যাকে পাবেন তাকে যেন তিনি বিয়ে করেন। তাহলে তার সন্তান লাভ হবে।

স্বপ্নে আদেশ পেয়ে বাদশাহ পরদিনই সহচর নফরকে নিযে মৃগয়ায় যাত্রা করেন। বনে বাস করে দরিদ্র কাঠুরিয়া ও তার কন্যা। মহাজনের ঋণের কারণে তাকে ধরে নিয়ে যেতে চায় মহাজনের ছেলে। তাকে উদ্ধার করেন রাজা। এই কাঠুরিয়া কন্যাকে বিয়ে করেন রাজা। প্রাসাদে নিয়ে আসেন তাকে। রাজা তার পরিচয় দেন তিনি বিজয়পুরের শাহজাদি হিসেবে। তিনি হন ছোট রানী। তার ছোটবেলার সই তার কাছে আসে মালিনী হয়ে। ছোট রানীকে পছন্দ করে না অন্যান্য রানীরা। তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।দরবেশের বরে অচিরেই অন্তসত্তা হন ছোট রানী। রাজপ্রাসাদে আনন্দের বন্যা  বয়ে যায়।

ছোট রানীর আঁতুড় ঘরে অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না ছয় রানী। তারা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রাখে ছোট রানীকে। একে একে সাত পুত্র ও এক কন্যা জন্মায়। কিন্তু সাত ছেলেকে আঁতুড়ঘর থেকেই সরিয়ে ফেলে ছয় রানী। তাদের রাজবাড়ির পেছনে বাগানে পুতে ফেলে। রানীদের অগোচরে একমাত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পারে মালিনী সই।

ছয় রানী বাদশাহকে বলে ছোট রানীর সাতটি কুকুর ছানা হয়েছে। ডাইনি মনে করে ছোট রানীকে বনবাসে পাঠান বাদশাহ।

এদিকে দরবেশের বরে সাতটি রাজপুত্র চাঁপা ফুল হয়ে ফুটে থাকে গাছে।

বনে বনে ঘুরে বেড়ায় দুঃখিনী ছোট রানী। একজন বৃদ্ধ কাঠুরিয়ার কুড়েতে আশ্রয় পায় সে। অন্যদিকে রাজবাড়িতে মালিনী সইয়ের ঘরে মালিনীর সন্তান পরিচয়ে বড় হতে থাকে রাজকন্যা পারুল। নদীর ঘাটে তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক তরুণ সওদাগরের। সওদাগর ও পারুলের প্রেম জমে ওঠে। ছয় মাসের জন্য দেশে যায় সওদাগর। যাবার আগে পারুলের কাছে দিয়ে যায় এক আজব আয়না ও একটি কবুতর পাখি। আজব আয়নায় দূরে থাকলেও প্রিয়জনদের দেখা যায়। আজব আয়নায় ছোট রানীকে বনে বনে কেঁদে বেড়াতে দেখে পারুল। মালিনী মায়ের কাছ থেকে সে জানতে পারে নিজের জন্ম ইতিহাস। এদিকে পারুলের হাত থেকে পড়ে আয়না ভেঙে যায়। সে চম্পা গাছের কাছে গিয়ে সাত ভাইকে ডাকে। কিন্তু সাত ভাই সাড়া দেয় না। সেখানে আসে দরবেশ। দরবেশ বলে, যেদিন রাজা, ছোটরানি ও পারুল সবাই একসঙ্গে ওদের ডাকবে সেদিন সাত ভাই সাড়া দিবে।

কবুতর পাঠিয়ে সওদাগরকে ডাকে পারুল। সওদাগর ছুটে আসে। মালিনীর বাড়িতে সওদাগর এসেছে এ খবর পায় বড় রানী।

বড় রানী ছাড়া আর কেউ জানে না কোথায় বনবাসে পাঠানো হয়েছিল ছোট রানীকে। বড় রানীর মহলে গোপনে যায় সওদাগর। সওদাগর তরোয়াল দিয়ে রানীকে ভয় দেখায়। প্রাণের ভয়ে বড় রানী বলে, উত্তর পশ্চিমে একশ মাইল দূরে হরিদ্রা বনে ছোট রানীকে নির্বাসন দেওয়া হযেছে। সওদাগর যায় ছোট রানীকে আনতে। এদিকে প্রহরী নিয়ে মালিনীর বাড়িতে যায় বড় রানী। কিন্তু মালিনী ও পারুলকে পায় না। তারা আশ্রয় নেয় পারুলের সইয়ের বাড়িতে। পারুলের সই রাজদরবারের গায়িকা। প্রতিরাতে নিশি ভোজনের পর বাদশাহকে গান শোনায় গায়িকার দল। সেরাতে দরবারে সইয়ের পোশাক পরে পারুল যায় বাদশাহকে গান শোনাতে।

ছোট রানীকে নিয়ে আসে সওদাগর। পারুল তখন দরবারে বাদশাহকে গান শোনাচ্ছে। ‘শোনেন শোনেন জাঁহাপনা, শোনেন রানী ছয়জনা’। গানের ভেতর দিয়ে পুরো ঘটনা বাদশাহকে শোনায় পারুল।

গান শুনে চমকে ওঠেন বাদশাহ।

প্রশ্ন করেন, তুমি কে? পারুল সে কথার জবাব না দিয়ে বাদশাহর সামনে ফুলের ডালা রেখে বলে ফুল খেতে। বাদশাহ বলেন, মানুষ কি কখনও ফুল খায়?

পারুল পাল্টা প্রশ্ন করে, মানুষের ঘরে কি কুকুর ছানা হয়?

সে সময় ছোটরানীকে নিযে দরবারে আসে সওদাগরপুত্র। বাদশাহকে পরিচয় দেয় এই হলো শাহজাদী পারুল। বাদশাহ প্রমাণ চাইলে ঘটনাস্থলে আবির্ভাব ঘটে দরবেশের। দরবেশ পারুলের পরিচয় দেয়। এবার পারুল, সওদারগর, ছোট রানী ও বাদশাহ যান রাজপ্রাসাদের পাশে চাঁপা ফুলের গাছের কাছে। সঙ্গে যায় ছয় রানীও। পারুলের ডাকে সাড়া দেয় সাত ভাই চম্পা। বাদশাহ ফিরে পান তার সাত ছেলে ও এক মেয়েকে। পারুলের সঙ্গে বিয়ে হয় সওদাগরের।

১৯৬৮ সালে নির্মিত ‘সাত ভাই চম্পা’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। ছবির পরিচালক ছিলেন দীলিপ সোম। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন খান আতাউর রহমান। প্রযোজনা করেন মিজানুর রহমান বুলেট। সংগীত পরিচালনা করেন আমির আলি।  ‘সাত ভাইয়ের এক বোন পারুলের ভূমিকায় কবরী ছিলেন অনবদ্য। তার সৌন্দর্য এবং সুঅভিনয় ছবিটিতে প্রাণ সঞ্চার করে।বিশেষ করে ‘শোনেন শোনেন জাঁহাপনা’ গানের দৃশ্যে কবরীর অভিব্যক্তি ছিল অসাধারণ। আজিমও সওদাগরের ভূমিকায় রোমান্টিক আবেদন সৃষ্টি করেন। বস্তুত পুরো সিনেমা ছিল প্রথম অংশে ছোট রানী, বাদশাহ এবং পরবর্তী অংশে রাজকন্যা পারুল ও তার প্রেমিক সওদাগরকেন্দ্রিক। নায়ক সওদাগরের ভূমিকায় ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক আজিম। ফুলরূপী রাজপুত্র অর্থাৎ পারুলের ভাইদের তেমন কোনো ভূমিকা অবশ্য ছিল না ছবিটিতে। দরবেশ ছিলেন খান আতাউর রহমান। নফরের ভূমিকায় কৌতুক অভিনেতা রবিউল।

ছবিটি ছিল সংগীতবহুল। ‘ও সাতভাই চম্পা জাগো রে’ সহ অনেক জনপ্রিয় লোকগীতি ছিল এখানে।কাহিনির সরলতা, যাত্রার ভঙ্গি, উচ্চকিত অভিনয় এ সবই লোকজ আমেজে ভরপুর ছিল।‘সাত ভাই চম্পা’র বিপুল জনপ্রি|য়তার ফলে ছবিটির সিকুয়াল ‘পারুলের সংসার’ নির্মিত হয়। ‘সাত ভাই চম্পা’ রিমেইক হয় বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে।

বস্তুত ‘সাত ভাই চম্পার’ বিপুল সাফল্যের মূল কৃতিত্ব ছিল লোককাহিনির চিরন্তন আবেদন যা ছবিটিকে ধ্রুপদীর মর্যাদা দিয়েছে।