'স্টপ জেনোসাইড': মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র

বাংলার শান্ত গ্রামীণজীবন। ঢেঁকিতে চলছে ধানভানা। কিশোরীর হাসিমুখ। হঠাৎ ঢেঁকির শব্দকে ছাপিয়ে শুরু হলো মেশিনগানের গুলির শব্দ, শ্বাপদের চিৎকার, বুটের আওয়াজ। এভাবেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2015, 07:03 AM
Updated : 16 Dec 2015, 07:03 AM

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল-মে মাসে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান এই তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এই তথ্যচিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করা।

তথ্যচিত্রটি শুরু হয় রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের অবিস্মরণীয় বাণী দিয়ে। সেখানে বলা হয় মুক্তিকামী জনগণের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড বলা মানবাধিকারের চরম লংঘন। লেনিনের এই উক্তির মাধ্যমে জহির রায়হান এ কথা স্পষ্ট করে দেন যে, বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ জনগণের মুক্তিযুদ্ধ, এটি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কর্ম নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল পাকিস্তান এবং তার দোসররা|

জহির রায়হান এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরেন পাকিস্তানিদের চালানো গণহত্যার অসংখ্য আলোকচিত্র। এইসব আলোকচিত্রে দেখা যায় পাকিস্তানি গণহত্যার শিকার নারী, শিশু। কুকুরে খাওয়া মৃতদেহ|। নদীতে ভাসমান অসংখ্য শব। শিশুর মৃতদেহ। বিবস্ত্র লাশ। ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যায় শিয়াল ও কুকুরের চিৎকার। মেশিনগানের শব্দ। এরপর দেখা যায় জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের কপি টাইপ হচ্ছে। মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র থেকে কিছু অংশের পাঠ শোনা যায়। ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনির চালানো হত্যাযজ্ঞের আলোকচিত্র দেখানো হয় এবং তথ্য উল্লেখ করা হয়।

এরপর জহির রায়হান বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো হত্যাকাণ্ড এবং শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করেন। দেখা যায় সীমান্তের দিকে মানুষের ঢল। আতংকিত মানুষ চলেছে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে, পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন, শুধু বেঁচে থাকার আশায়। তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। বৃদ্ধ, শিশু কারো চলার শেষ নেই।  তিনি তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট সেলুলয়েডে ধরে রাখেন। আশ্রয় শিবিরে মানুষের তীব্র কষ্ট, দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার, তাদের মন্তব্য তুলে ধরেন। । একজন কিশোরীকে দেখা যায়। তার বাবা, ভাই ও কাকাকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। সে হয়েছে গণধর্ষণের শিকার। এই কিশোরীর চোখে যেন মৃত মানুষের দৃষ্টি, সে বাকরুদ্ধ। শোনা যায় শিশুর কান্না। নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষের মন্তব্য রয়েছে। ইয়াহিয়া খানকে হিটলার, মুসোলিনি, চেঙ্গিস খানসহ অতীতের নরহত্যাকারী নৃশংস একনায়কদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ বলে উল্লেখ করা হয়। হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের কথা তুলে ধরা হয়। গ্রামবাসীদের উপর পাকিস্তানি হানাদাররা কি বীভৎস নির্যাতন চালিয়েছে তার তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয়।

জহির রায়হান এরপর যান বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে। গৌড়ের ভগ্নপ্রাসাদের ভিতর ১৯৭১ সালে বাঙালি আশ্রয়প্রার্থীদের শিবির স্থাপিত। আশ্রয় শিবিরে শরণার্থীদের কথা তুলে ধরা হয়। গণহত্যার তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে বিশ্ববিবেকের  প্রতি আবেদন জানানো হয় এর বিচারের এবং এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য আশু পদক্ষেপের। জাতিসংঘের নিরবতায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়।

বর্ষার কষ্ট উপেক্ষা করেও অসহায় মানুষের মিছিল এগিয়ে যায় সীমান্তের দিকে। দেখা যায় একজন বৃদ্ধাকে। চলার শক্তি নেই, চোখে প্র্রায় কিছুই দেখেন না। যিনি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শিবিরের দিকে|। তার মুখে শুধু একটিই কথা, ‘নাই, কিছু নাই, কেউ নাই, সব গেছে’। অথচ মানবাধিকার সনদে রয়েছে মানুষের অধিকার নিয়ে কত গালভরা কথা।

এরপর দেখানো হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের দৃশ্য। জহির রায়হান মুক্তাঞ্চলে প্রবেশের ধারাবর্ণনা দেন এবং মুক্তিসেনাদের শিবিরে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি, হাতে রাইফেল। এরা গেরিলা যোদ্ধা| তিনি ক্যাম্প কমান্ডারের বক্তব্য তুলে ধরেন। মুক্তিযোদ্ধাদের  প্রশিক্ষণের দৃশ্য দেখান।

তথ্যচিত্রের শেষ পর্যায়ে আবার দেখানো হয় অসহায় মানুষের মুখ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের যে কোনো দেশের, কালের ও জাতির মুক্তিকামী মানুষের জনযুদ্ধেরই একটি অংশ। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরদের চালানো গণহত্যা বন্ধের দৃঢ় আহ্বানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘স্টপ জেনোসাইড’| তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছিল ইংরেজিতে, বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়ার লক্ষ্যে। এর ভাষান্তর করেন জহির রায়হায়নের সহকারী, মুক্তিযোদ্ধা এবং চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির।

‘স্টপ জেনোসাইড’ শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিলই নয়, শিল্পমানের দিক থেকেও এটি অনবদ্য। জহির রায়হানের কুশলী পরিচালনায় এটি হয়ে ওঠে মানবতার অমর আখ্যান। তথ্যচিত্রটির  ব্যাপ্তিকাল ২০ মিনিট। এটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ব্যাপক প্রভাব রাখে|। 'স্টপ জেনোসাইড’- এর অব্যবহিত পরেই জহির রায়হান নির্মাণ করেন আরেকটি তথ্যচিত্র 'আ স্টেট ইজ বর্ন'।