চলতি বছরে ১০ জানুয়ারি 'আত্মপ্রকাশ' করেছে কবিতার ব্যান্ড ‘শ্লোক’।
Published : 07 Feb 2025, 09:48 AM
তিন পেশার তিনজন মানুষের ইচ্ছা মিলিত হয়েছে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে। তাতেই ‘শ্লোক’ এর জন্ম। না, তারা মুখে মুখে শ্লোক বলেন না, তারা শোনান কবিতা। গিটারের তারে সুর তুলে কবিতা পাঠ করেন তারা।
‘কবিতা এবং গানের মধ্যে সেতুবন্ধ’ রচনার মাধ্যমে কবিতাকে আরও শ্রুতিমধুর করে সবার কাছে পৌঁছে দিতেই কবিতার ব্যান্ড তৈরির ভাবনা এসেছে বলে জানিয়েছেন দলটির সদস্যরা।
শ্লোক ব্যান্ডের এই তিন সদস্য হলেন এম নবী রনি, শফিউল মাওলা ও স্যাম। যাদের মধ্যে একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, একজন সাংবাদিক ও অন্যজন ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অফিসে এক বিকেলে গল্প ও আড্ডায় তারা জানান ব্যান্ডদল তৈরির শুরুর গল্প ও ভাবনার কথা।
‘কবিতার ব্যান্ড’ একটু ভিন্ন চিন্তা। কী ভাবনা থেকে এমন একটি দল গড়ার কথা মাথায় এল এমন প্রশ্নে রনি বলেন, “প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর আগের কথা, আমরা ধানমন্ডি লেকে বসে আড্ডা দিতাম। সবাই কবিতা পড়ার, শোনার খুব বড় ভক্ত। কবিতা লিখি, পড়ি ও পছন্দ করি। আমাদের ব্যান্ডের সদস্যরা ভালো গিটার বাজায়, গান করে।
“আমরা একসাথে বসলেই গিটার, গান, কবিতার আড্ডা হত। একদিন লেকে বসে মাওলা (শফিউল) গিটার বাজিয়ে গান শুরু করে আর আমি দুই লাইন করে কবিতা পড়ছিলাম। সেটাও দেখলাম অনেকে উপভোগ করছে। তখনই আসলে মাথায় আসে কবিতা এবং গানের সেতুবন্ধন করা যায় কি না।”
সেই পাঁচ বছরের ভাবনা থেকেই গত ১০ জানুয়ারি তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
শফিউল মাওলা বলেন, “ব্যান্ড বলতে আমরা রক, ফোক বা গানকেই বুঝি। কিন্তু ব্যান্ড কিন্তু যেকোনো কিছুরই হতে পারে। আমরা কবিতার সাথে গান মিশিয়ে অনেক প্র্যাকটিস করেছি, বন্ধু-বান্ধবদের শুনিয়ে প্রশংসা পেয়েছি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
‘শ্লোক’ নাম বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “শ্লোক শব্দ হচ্ছে পবিত্র বাণী বা সুন্দর কথা। কবি বা কবিদের কথাগুলোও তো স্রষ্টা থেকে আসে, আমরা যেহেতু কবিতাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আগ্রহ নিয়ে দলটি তৈরি করেছি তাই এই নামটাই অর্থবহ মনে হয়েছে এবং আমরা তিনজন মিলেই এই নামটি দেই।”
‘কবিতার ব্যান্ড নাকি ব্যান্ডের কবিতা’ নিজেদেরকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন?
এই প্রশ্নে ব্যান্ডের আরেক সদস্য স্যাম বলেন, “ব্যান্ডের কবিতা মানে একটা ব্যান্ড সে কখনো গান গাইতে পারবে আবার সেখানে কবিতার লাইনও যুক্ত করতে পারবে অর্থাৎ গানের একটা পার্ট হিসেবে দুই চার লাইন কবিতা পড়ছে।
“আর আমরা নিজেদের কবিতার ব্যান্ড বলছি কারণ শ্লোক কবিতার জন্য করা, কবিতার কথাই বলবে এবং আমরা কবিতা পড়ছি।”
নিজেদের রচিত কবিতা দিয়েই তারা যাত্রা শুরু করেছেন জানিয়ে রনি বলেন, “আমরা এখনো স্বরচিত কবিতাই পাঠ করছি। কবিতাকে আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা সম্ভব এই ভাবনা থেকেই আমরা কবিতা লিখি, আমরা কিন্তু কবিতাকে বিকৃত করছি না, অনেক আবৃত্তিশিল্পী আছেন তাদের প্রতি সম্মান রেখেই আমরা এই ব্যান্ড তৈরি করেছি।
“পুরাতন জনপ্রিয় কোনো গানের সাথে মিলিয়ে পাঠ করছি, গানটা যেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে, কবিতাকেও সেভাবে পৌঁছানোর জন্য।”
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশকের পুরোটা এবং তার পরও, দেশে মিউজিক্যাল ব্যান্ডের একটা জোয়ার ছিল। কবিতার মত সাহিত্যের একটি ধারাকে উপজীব্য করে ব্যান্ড, সেক্ষেত্রে আপনাদের উপস্থাপনের ধরন নিয়েও কথা বলে দলটির সদস্যরা।
রনির ভাষ্য, “আমাদের স্বরচিত একটা কবিতা হচ্ছে ‘মুক্তিযোদ্ধা রসুল মিয়া’। আমরা যখন এটা পারফর্ম করি তখন শুরুতে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গান দিয়ে শুরু করি। সেই সুর থেকেই কবিতা পাঠে চলে যাই।
“‘আবার দেখা হবে’ নামের কবিতা শুরু হয় চাইম ব্যান্ডের প্রয়াত খালিদ ভাইয়ের ‘আবার দেখা হবে’ গান দিয়ে। ‘অতশি’ কবিতা শুরু হয় প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর গান দিয়ে। আমরাও কিন্তু নব্বই দশকের সেই ক্রেজ বা টেস্টের গান দিয়েই শুরু করছি। যেন এখনকার প্রজন্মের টেস্টের সাথে মিল রেখে কবিতাকে সামনে আনা যায়।”
ব্যান্ড বলতেই ওপেন এয়ার কনসার্ট, ইনডোর কনসার্ট বোঝেন অনেকে। মিউজিক্যাল ব্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটা প্যারামিটারও বলা যেতে পারে স্টেজ শো। কীভাবে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে চায় ‘শ্লোক’?
শফিউল মাওলা বলেন, “আমাদের শুরুটা যেহেতু বেশিদিনের না, ধীরে ধীরেই শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাব সেই আশা রাখছি, আগে আমরা ঘরে বসে নিজেদের পেইজের জন্য পারফর্ম করতাম, এখন আমরা বাইরে বের হচ্ছি। প্রথম শো করেছি টিএসসিতে, তারপর ছোটখাটো বিভিন্ন জায়গায় পারফর্ম করেছি। আমাদের মানুষ পছন্দ করছে।”
‘শ্লোক’ ব্যান্ডকে আয়ের উৎস হিসেবে দেখছেন না এর সদস্যরা। কবিতা নিয়ে আধুনিকায়ন এবং দর্শক শ্রোতাদের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতেই তাদের এই আয়োজন।
মাওলা বলেন, “ব্যান্ড শব্দটার সঙ্গে কনসার্ট বা আয়ের একটা ব্যাপার আসে। আমরা তিনজন তিন ভিন্ন পেশায় আছি। আমাদের আয়ের উৎস সেটাই।
“তাই ওপেন এয়ার কনসার্ট, ইনডোর কনসার্ট এসবের চেয়ে আমরা দর্শক শ্রোতাদের সঙ্গে নিজেদের কানেক্ট করতে চাই। সেটা চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বড় কোনো আয়োজনও হতে পারে। যারা আমাদের এই কবিতার আয়োজনটা সহজেই গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থবিত্তের সম্পৃক্তা খুঁজছি না।”
একটা সময় কবিতার অ্যালবামও বের হত। এখন তেমনটা খুব দেখা যায় না। ‘শ্লোকের’ ভাবনা কী?
পশ্নের উত্তর দিতে স্যাম বললেন, কবিতা নিয়ে ‘কাজের ঘাটতির’ কথা।
“কবিতা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে যাওয়া শিল্প, ডিজিটালাইজেশনের যুগে অন্য সব কিছু যেমন এগিয়ে গিয়েছে সেই অনুযায়ী কবিতা এগিয়ে যেতে পারেনি। ২০১০ সালের পর থেকে বিখ্যাত হয়েছে এমন কোনো কবিতার নাম কেউ বলতে পারবে না। আর গান কিন্তু অহরহ হিট হচ্ছে, মানুষ শুনছে। তাই কবিতা নিয়ে কাজের ঘাটতি চোখে পড়ছে বলেই কবিতাকে একটু মুখরোচক করতেই আমাদের এই ব্যান্ড তৈরি।”
স্যাম বলেন, “শ্লোক সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে, আপাতত আমরা আমাদের শ্রোতাকে কিছু একটা শোনাতে চাই, কবিতা নিয়ে আমরা যা অনুভব করি যদি আমাদের শ্রোতারা সেটার কাছাকাছি কিছু হলেও অনুভব করে, সেটাই হবে আমাদের সার্থকতা। দর্শক, শ্রোতা পছন্দ করলে আমরা ডিজিটালে আমাদের পরিধি আরও বাড়াব।”
পৃথিবীতে বিভিন্ন বিপ্লব, আন্দোলন, যুদ্ধ- সবকিছুর সাথেই সংস্কৃতির একটা যোগ থাকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও শিল্পীরা মাঠের যোদ্ধাদের সমান্তরাল একটা লড়াই চালিয়ে গেছেন। সেখানে অনেক আবৃত্তিশিল্পী, লেখক, সাংবাদিকও ছিলেন। কখনো যদি তেমন পরিস্থিতি আসে?
এই প্রশ্নে মাওলা বলেন, “শিল্পীদের কোনো রাজনৈতিক দল থাকা উচিত না। তারা সবসময় সভ্যতা, মানুষ, বিপ্লব, আন্দোলনের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই শিল্পকর্ম তৈরি করে। যেটা সমকালীন। কবিতা শিল্পটাও একটা এভারগ্রিন ব্যাপার। আমরা চেষ্টা করব সেসব লড়াইয়ে কিছু রেখে যেতে, যেন মানুষ তাদের কল্যাণে প্রয়োজন মত ব্যবহার করে যেতে পারে।”
সবশেষে ‘শ্লোক’ নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানাতে তিনজন নিজেদের ভাবনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্নভাবেই।
রনি বলেন, “কবিতা তো সমুদ্রের মত, আমরা সেই সমুদ্র পাড়ি দিতে চাই আমাদের এই শ্লোক নিয়ে।”
“‘শ্লোক’কে পরিকল্পনা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে আবদ্ধ রাখতে চাই না, ‘শ্লোক’ টিকে থাকুক মানুষের মধ্যে,” চাওয়া শফিউল মাওলার।
আর স্যামের ভাষ্য, “আমাদের উদ্দেশ্য কবিতা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া, যেন কবিতা আগের মত টিকে থাকতে পারে। কবিতা যেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হারিয়ে না যায়, আমাদের উদ্দেশ্য যেন সফল হয়।”