আত্মকথনে এমন কিছু সত্যি ও বাস্তব ঘটনা উঠে আসত, যা কিছু মানুষের মনবেদনার কারণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল।
Published : 24 Jan 2025, 09:40 AM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ইচ্ছা ছিল তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন এবং কলকাতার সিনেমা জগতের নানা অধ্যায় তুলে আনবেন বইয়ের পাতায়। কিন্তু সেই ইচ্ছা অধরাই রয়ে গেছে।
সত্যজিৎ রায়ের অপুর আত্মজীবনী কেন দুই মলাটে এল না?
এর কারণ আত্মকথনে এমন কিছু সত্যি ও বাস্তব ঘটনা উঠে আসত, যা কিছু মানুষের মনবেদনার কারণ হয়ে উঠত বলে জানিয়েছেন সৌমিত্রর মেয়ে পৌলমী চট্টোপাধ্যায়।
অভিনেতার ৯০ তম জন্মবার্ষিকী গেছে চলতি মাসের ১৯ তারিখে। দিনটি ঘিরে আজকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাবার সেই অপূর্ণ ইচ্ছার কথা তুলে ধরেছেন পৌলমী।
তিনি বলেন, “আত্মজীবনী লিখতে গেলে যে সত্যিগুলো লিখতে হত তাতে অনেক মানুষ কষ্ট পেতেন। আর উনি ঠিক করেছিলেন আত্মজীবনী লিখলে সব সত্যি কথা লিখবেন। কোনও রাখঢাক রাখবেন না তাতে। সেই জন্যই তার আত্মজীবনী লেখা হয়ে ওঠেনি।"
সাক্ষাৎকারের বাবাকে ‘কাজ পাগল’ মানুষ বর্ণনা করে থিয়েটারের অভিনেত্রী পৌলমী বলেছেন, জন্মদিনেও অভিনেতা কাজে ডুবে থাকতেন। বিশ্রাম নেওয়া বা অলস সময় কাটানো তার ‘ধাতে ছিল না’ বলে ভাষ্য পৌলমীর।
অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দিনটিতে তাদের বাড়িতে আসতেন বলে জানিয়েছেন পৌলমী। আসতেন রবি ঘোষসহ আরও কয়েকজন অভিনেতা।
সৌমিত্রকে ব্যক্তি জীবনে একজনন বাবা বা স্বামী হিসেবে একেবারে সাধারণ অনাড়ম্বর মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছেন পৌলমী।
তার কথায়, সাধারণে মিশে যেতে সৌমিত্রর কোনোদিন অসুবিধা হয়নি।
“বাবা মুদির দোকানে যেতেন লুঙ্গি পরে। বাজার করতেন। কিনে আনতেন বাড়ির প্রয়োজনীয় সামগ্রী। আমাকে নাচের স্কুলে নিয়ে যেতেন, নিয়ে আসতেন। নিউ মার্কেটে বাবার হাত ধরে ঘুরেছি, আমাদের বায়নাও সামলেছেন তিনি।"
সৌমিত্র চলে গেছেন মহামারীর বছরে। কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ২০২০ সালে ৮৫ বছরে মারা যান সৌমিত্র।
১৯৩৫ সালে ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এক সাংস্কৃতিক পরিবারে তার জন্ম। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় একজন আইনজীবী ও মঞ্চঅভিনেতা। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়ও যুক্ত ছিলেন মঞ্চনাটকে; তিনি স্থানীয় নাটকের দল ‘প্রতিকৃতি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
শুরুতে আবৃত্তি ও মঞ্চনাটকে ব্যস্ত সৌমিত্র চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তার মন বদলে দেয়।
অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’র অপু চরিত্রের জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সৌমিত্রর।
সেই সূত্রে অডিশন দিতে গেলেও চরিত্রের সঙ্গে বয়সের তারতম্যের কারণে সেবার সুযোগ মেলেনি তার। তবে সৌমিত্রকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের। ১৯৫৯ সালে অপু ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এ তরুণ অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকেই তিনি বেছে নেন।
সেই সিনেমায় সৌমিত্রের সঙ্গে অভিষেক ঘটে ১৩ বছর বয়সী শর্মিলা ঠাকুরের। সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’র মত দৃশ্য আর সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সেই রসায়ন দর্শকের মনে এখনও অমলিন।
সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর পর সত্যজিতের সৃষ্টি আরেক চরিত্র ফেলুদাকে সিনেমার পর্দায় সৌমিত্র নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়।
ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনশর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই শিল্পী। মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের সঙ্গেও কাজ করেছেন।
সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, বাক্স বদল, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, ঝিন্দের বন্দী, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আবার অরণ্যের মত সিনেমার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে।
অভিনয় ছাড়াও নাটক ও কবিতা লিখেছেন তিনি, যুক্ত হয়েছেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশনায়, দ্যুতি ছড়িয়েছেন আবৃত্তির মঞ্চেও।
চলচ্চিত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ছাড়াও ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ন অব দ্য অনার’ পদকে ভূষিত হয়েছেন এই অভিনেতা। ২০০৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার।
ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) সমর্থক ছিলেন, তিনি ছিলেন বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচকদের একজন।