পরিচালক ও প্রযোজকরা মনে করছেন, এখন সিনেমা মুক্তি দিলে বড় লোকসানের শঙ্কা রয়েছে।
Published : 11 Sep 2024, 02:59 PM
ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার শাকিব খানের ‘দরদ’, এবং ‘জংলী’, ‘নীলচক্র’সহ আরো কয়েকটি সিনেমা মুক্তির কথা ছিল চলতি বছর শেষের আগেই। কিন্তু আন্দোলন, সরকার পতন, পরবর্তী পরিস্থিতি এবং বন্যা ঘিরে অনিশ্চয়তায় পরিচালক এবং প্রযোজকরা নির্ধারিত সময়ে তাদের সিনেমা মুক্তি দিতে চাইছেন না।
তারা মনে করছেন, দেশের মানুষ এখন গাঁটের পয়সা খরচ করে বিনোদন উপভোগ করার মত মানসিক অবস্থায় নেই। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে ‘অস্থিরতা কাটেনি’। এখন সিনেমা মুক্তি দিলে কেবল আর্থিক ক্ষতিই হবে।
তাই বড় বাজেটের অনেক সিনেমার মুক্তির সম্ভাব্য তারিখ প্রযোজকরা এক ধাক্কায় নিয়ে গেছেন আগামী বছরে।
চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির অফিস সচিব সৌমেন রায় বাবু গ্লিটজকে বলেছেন, “সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি। ১৩ তারিখে একটি সিনেমা মুক্তির কথা ছিল। তারিখও নিয়ে রেখেছিল, কিন্তু সেটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে এখন সিনেমা মুক্তির সাহস কেউ পাচ্ছে না৷"
এর মধ্যে জুলাই মাসে শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব কারখানা’ এবং অগাস্টে মনতাজুর রহমান আকবের ‘অমানুষ হল মানুষ’ মুক্তি পেয়েছে। এছাড়া নতুন কোনো সিনেমা হলে আসেনি।
চলতি বছর মুক্তির তালিকায় আরো ছিল 'দরদ', ‘জংলি’, ‘নীলচক্র’, 'এশা মার্ডার', ‘কবি’, 'নূর', ‘নন্দিনী’, ‘হৈমন্তীর ইতিকথা’সহ আরো কয়েকটি সিনেমা।
‘নীলচক্র: ব্লু গ্যাং’ মুক্তির কথা ছিল অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরে। তবে এই বছর আর সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া হবে না জানিয়ে পরিচালক মিঠু খান গ্লিটজকে বলেন, "সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক সিনেমার মুক্তি পিছিয়েছে। দেশ এখনো স্বাভাবিক হয়নি, কী হয়, কী হবে এসব নিয়ে এখনো চিন্তা কাটেনি মানুষের ভেতরে।
“দেশে বন্যা পরিস্থিতিতে অনেকে বিনোদনের জন্য যে ফান্ড থাকে, সেটা হয়তো দিয়ে দিয়েছেন। বিনোদনে খরচ করার মত পরিস্থিতি হবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, মানসিক অস্থিরতা কাটেনি। তাছাড়া পরিস্থিতি দেখতে যতটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলেই কি স্বাভাবিক?
"আমাদের অনেক শিল্পী বিতর্কিত হয়ে গেছেন। আবার অপরাধ না করেও কোনো কোনো শিল্পী যে অপরাধের খাতায় ঢুকে গেলেন, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় তারা খুঁজে বের করুক। হয়ত খুব শিগগিরই একটা সমাধানে আসবে, তখন সিনেমা মুক্তি নিয়ে পরিকল্পনা করা যাবে।"
সরকার পতনের পর সিনেমা শিল্পেও ‘সংস্কারের কাজ চলছে’ বলে জানালেন এই পরিচালক।
তিনি বলেন, "আমরা একটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। ডিরেক্টর, শিল্পী থেকে মিডিয়াকর্মী যারা আছেন, সবাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সংস্কারের জন্য কাজ করছেন। এখানে অনেক সংস্কার দরকার। সেন্সর বোর্ডের নিয়মনীতি সবই সংশোধন ও সংযোজন প্রয়োজন, সেই কাজ চলছে। অন্যান্য দেশে যে নিয়ম মেনে সিনেমা চালানো হয়, আমদের দেশেও সেন্সর সার্টিফিকেশনকে সেই নিয়মের আওতায় আনতে হবে। এফডিসিতেও অনেক সংস্কার দরকার। সব মিলিয়ে পরিবর্তন আনাটা আগে জরুরি বলে মনে হচ্ছে।"
অগাস্টের ২ তারিখে মুক্তির কথা ছিল পরিচালক সোয়াইবুর রহমান রাসেলের ‘নন্দিনী’ সিনেমাটি। মুক্তি পিছিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে পরিচালক বলেন, "সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি স্থবির হয়ে আছে। এখনই সিনেমা মুক্তি নিয়ে চিন্তা করছি না। আরো এক দুই মাস যাক। সরকার পরিবর্তন, বন্যা সব মিলিয়ে দেশের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাই মুক্তি দিতে চাচ্ছি না।"
একই কথা বললেন 'জংলি' সিনেমার পরিচালক এম রাহিম। সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার এখন কোনো পরিকল্পনাই নেই রাহিমের।
“পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে মুক্তির নতুন তারিখ ঠিক করব, প্রচারও শুরু করব। এটা চলতি বছরও হতে পারে, বা আগামী বছরের শুরুতেও। এখনই নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।”
এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’।
সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, তবে সেন্সর কমিটি ‘না থাকায়’ জমা দিতে পারছেন না জানিয়ে পরিচালক অনন্য মামুন বলেন, " সেন্সর বোর্ডের কমিটি নতুন করে গঠন হলে হয়ত সিনেমাটি সেন্সরে জমা দেওয়া হবে। তখন সিনেমাটির মুক্তির তারিখ নিশ্চিত করা যাবে। এখন সেন্সর বোর্ডের উপর বাকিটা নির্ভর করছে।
“যেহেতু সবকিছুই নতুনভাবে, নতুন সিস্টেমে আনা হচ্ছে, তাই আমাদের অপেক্ষা করাই ভালো। এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ওপর অনেকগুলো হল মালিক, পরিবার নির্ভর করছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়ায় যদি ফিরে যাওয়া যায়।"
তবে কমিটির বিলুপ্তি নিয়ে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কমিটি না থাকার এরকম কোনো তথ্য আমার জানা নেই, এ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রজ্ঞাপনও আমরা হাতে পাইনি।"
কোভিড মহামারীর পর গত কয়েক বছরে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ফিরেছিল। ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘প্রহেলিকা’ এবং গেল কোরবানির ঈদে 'তুফান' দিয়ে বেশ ভালো ব্যবসা করেছেন হল মালিকরা।
এখন নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে ব্যবসা বাণিজ্যের ভবিষৎ ভালো দেখছেন না স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, "তুফানের পর তো আর দেশে বলতে গেলে কোনো সিনেমাই নেই। নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে দর্শকরা হলমুখী হবেন না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির বড় একটা প্রভাব তো ফেলবেই।"
সিনেমা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্নে প্রযোজক শামসুল আলমকে বলেন, "বন্যার জন্য অনেক সিনেমা হল বন্ধ আছে। দেশের মানুষ যেহেতু মাত্র একটা দুর্যোগকালীন সময় পার করে উঠেছে তাই এখনই সিনেমা মুক্তি নিয়ে কেউ ভাবছে না। পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে হয়ত সিনেমা মুক্তি দেওয়া হবে।“
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার বলেছেন, দেশের ৮০ শতাংশ সিনেমা হল বন্ধ এবং সিনেমা মুক্তি দিলে বড় লোকসান হওয়ার ভয়েই সিনেমা মুক্তি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন প্রযোজকরা।
গ্লিটজকে তিনি বলেন, "অনেক বড় বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রযোজকরা এখন কোন সিনেমাই মুক্তি দিতে চাচ্ছে না। সবার ভিতরেই লোকসানের ভয় কাজ করছে। যদি সিনেমার খরচটাই উঠে না আসে। কারণ হাতে গোনা কয়েকটা সিনেপ্লেক্স চালু আছে এবং ৯ থেকে ১০টা সিঙ্গেল হল চালু আছে। যেসব হল খোলা তাদের অবস্থাও শোচনীয়। 'তুফান' সিনেমা আর কত চালাবে। আর সব থেকে বড় কথা দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মানুষ কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। সিনেমা দেখার পিছনে টাকা খরচ করবে সেই মানুষের সংখ্যাও কম।"
তবে এই পরিস্থিতিতেও যদি শাকিব খানের 'দরদ' সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া যায়, তাহলে দর্শক হলে ফিরতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি।