ভক্ত অনুরাগীদের প্রশ্ন ছিল, পুরনো ব্ল্যাককে ফের নিয়মিত পাওয়া যাবে কি না; কৌশলে উত্তর দিলেন তাহসান।
Published : 11 May 2024, 06:46 PM
ব্ল্যাকের পুরনো তারা পাঁচজন। তাহসান খান, জন কবির, টনি ভিনসেন্ট, মুশফিক জাহান ও মাহমুদ করিম মিরাজ। জাহান বাদে পুরনো কেউ আর ব্ল্যাকে নেই এখন; যে যার পথে হাঁটছেন।
এই পাঁচজনকে শেষবার পাওয়া গিয়েছিল ২০০৫ সালের এপ্রিলে ঢাকার একটি মিলনায়তনে। এরপর পাঁচজনকে একসঙ্গে আর দেখা যায়নি। শুধু এ কনসার্টের জন্যই দলের ড্রামার টনি উড়ে এসেছেন কানাডা থেকে।
পঁচিশ বছর পূর্তিতে তাহসান, জনদের পুরনো লাইনআপ নিয়ে ব্ল্যাকের কনসার্ট-এ ঘোষণায় কতটা উচ্ছ্বসিত ব্ল্যাক অনুরাগীরা সেটির আঁচ পাওয়া গিয়েছিল আগেই, সোশাল মিডিয়ায়। আর কনসার্টের দিন, দুপুর থেকেই মঞ্চের সামনে যেদিকে চোখ যায়, কেবল মানুষ আর মানুষ।
সাতটি ব্যান্ডের কনসার্ট হলেও গাঁটের পয়সা খরচ করে বেশির ভাগ মানুষ এসেছিলেন ব্ল্যাকের হাত ধরে পুরনো সময়ে ফিরতে।
আইসিসিবি এক্সপো জোনে গেটের প্রবেশমুখেই বেশ কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে কথা বলে গ্লিটজ জেনেছে, ব্ল্যাক নিয়ে তাদের আগ্রহের কথা।
আইসিসিবি এক্সপো জোনে কনসার্ট শুরু হয় শুক্রবার দুপুর ২টায়। আর ব্ল্যাক ব্যান্ড মঞ্চে ওঠে রাত ১০টা নাগাদ। পুরনো সদস্যদের আগে গান শোনান দলের নতুন সদস্যরা।
একই দিনে মঞ্চে আরও সাতটি ব্যান্ডের পারফরম্যান্স ছিল। ব্ল্যাক ছাড়াও ওয়ারফেইজের সাবেক লিড গিটারিস্ট অনি হাসানের গান শুনতেও উদগ্রিব ছিলেন অনেকে। অনিও গান গেয়ে মাতিয়ে দেন আসর।
মঞ্চে তখন 'রিকল ব্যান্ড', 'ওল্ড স্কুল', 'প্রোজেক্ট ব্যান্ড' দল নিজেদের শ্রোতাপ্রিয় বেশ কয়কেটি গান পরপর শোনান। বেলা পড়তির দিকে মঞ্চে উঠে 'পপাই বাংলাদেশ' ব্যান্ড। প্রথমবারের জন্য ছেলের গান শুনতে এসেছে পপাই বাংলাদেশ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট রাফান ইমামের মা। স্টেজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
তিনটি গান গেয়ে রাফান ইমাম দর্শকের উদ্দেশ্যে বলে উঠেন, " আজকের কনসার্ট আমার জন্য অনেক স্পেশাল। প্রথমবারের মত আমার মা এসেছেন আমার কনসার্ট দেখতে। স্টেজের পাশে থেকে আমার গান শুনছে এ অনুভূতি বোঝাতে পারব না। পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি ভালোবাসা। চলেন এবার ভালোবাসার গান শুনাই।"
তারপর 'ভালোবাসা বাকি' গান দিয়ে দর্শক মাতিয়ে তোলেন তিনি। একে একে 'ক্রিপটিক ফেইট', 'ফারুক ভাই' ব্যান্ড তাদের পারফর্ম শেষ করেন।
রাত আটটার দিকে একসঙ্গে মঞ্চে ওঠেন 'ওয়ারফেজ' ব্যান্ডের সাবেক গিটারিস্ট অনি হাসান, মিজান রহমান ও ‘পাওয়ার সার্জ’ ভোকালিস্ট জামসেদ চৌধুরী।
৫০ মিনিট সময় নিয়ে মঞ্চে উঠলেও এক ঘণ্টার উপরে দর্শক মাতিয়ে রাখেন তারা। তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয় গায়ক অনি হাসান। দীর্ঘ ১০ বছর পর বাংলাদেশের মঞ্চে পারফর্ম করছেন তিনি।
অনি মঞ্চে উঠতেই দর্শকের সমস্বরে চিৎকার। ১০ মিনিটের মতো গিটারের মূর্ছনায় কনসার্টে যেন ঝড় তুললেন তিনি। অনিকে নিয়ে গায়ক জামসেদ চৌধুরী গাইলেন ‘স্বপ্নদেব’, 'অধরা' সহ জনপ্রিয় সব গান।
" ১৭ বছর পর অনির সঙ্গে এমন ক্রাউড পরিবেশে গান গাইলাম। আপনাদের এই সাড়া দারুণ লাগল" এই বলে অনির সঙ্গে জামসেদের পারফরম্যান্স শেষ হয়।
এরপর মিজানের সঙ্গে অনির পারফর্ম শুরু করার আগে, অনি ব্যান্ডের কিংবদন্তী শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করেন।
বাচ্চুকে উৎসর্গ করে অনি বাজালেন 'সেই তুমি কেন অচেনা হলে' গানের মিউজিক।
রূপালি গিটারের স্রষ্টাকে স্মরণ করে অনি বলেন, " ৬ বছর পর দেশে ফিরলাম। বাচ্চু ভাই তখন বেঁচে ছিল, আমাকে প্রায়ই বলতেন, অনি তুমি দেশে আসো, আমার গিটারগুলো বাজাও। আমি তখন দেশে আসতে পারিনি। ৬ বছর পর দেশে ফিরলাম, কনসার্ট করলাম। বাচ্চু ভাই বেঁচে নেই। আমার এই মুহূর্তটুকু বাচ্চু ভাইকে উৎসর্গ করলাম।"
ব্যান্ডটির প্রতি তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা একটু বিশেষভাবেই বইছিল পুরো কনসার্টজুড়ে। ‘না’, ‘পূর্ণতা’ গানগুলোর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলেন অনেকে। দুটোই ছিল অনি ও মিজানের পুরনো ব্যান্ড ওয়ারফেজের গান।
তাদের গান শেষ হতে হতে রাত ৯টার বেশি বেজে যায়। ব্ল্যাক ব্যান্ডের অনুরাগীদের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না।
৪২ বছর বয়সী আরমান আহমেদ নামের এক দর্শক বলেন, " যখন কনসার্ট এ ঢুকলাম পপাই ব্যান্ডের গান হচ্ছিল। তরুণ- তরুণীরা তাদের গানের সঙ্গে কি সুন্দর গলা মিলাচ্ছে, আর আমি ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে ভাবছিলাম প্রায় ১৯ বছর আগে যখন পুরনো 'ব্ল্যাক' স্টেজে উঠে গান গাচ্ছিল, আমি তখন এভাবেই গলা মিলাচ্ছিলাম। আর সবাই আমার দিকে এভাবেই তাকাচ্ছিল!"
ব্ল্যাকের কনসার্ট দেরি করে শুরু করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আরমান বলেন, " এই কনসার্টটা ছিল আমাদের মত ১৯ বছর আগের দর্শকের জন্য। অন্য ব্যান্ড দিয়ে রাত না করে ব্ল্যাকের গান শুরু করে দেওয়া উচিত। আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।"
এদিকে রাজশাহী থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে কনসার্টে এসেছেন সোনিয়া কাউসার। মেয়েরা ব্ল্যাক গানের ভক্ত বলে জানান তিনি। বললেন, ব্ল্যাকের রিইউনিয়নের সাক্ষী হয়ে থাকতেই কনসার্টে এসেছেন।
"আমরা তো আজকের অভিনেতা গায়ক তাহসানকে চিনি ব্ল্যাকের তাহসান হিসেবেই। ২০০৫ সালে তাহসানদের কনসার্ট দেখতাম। আমরা তখন মাত্র বড় হচ্ছি, কনসার্টে যাওয়া শুরু করেছি। সেসময় 'আমার এই আঁধার', 'আমার পৃথিবী' আরও অনেক গান। যেটা এখন খুব একটা মনেও নেই। এত বছর পর ব্ল্যাকের কনসার্টে আসব, গত পাঁচ দিন ধরেই এটা নিয়ে ব্যাপক এক্সসাইটমেন্ট কাজ করছে।"
১৮- ২০ বছর পর জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান শুনছি সেটার অনুভূতি 'অন্যরকম' বললেন ইমাম সাদিক নামের এক শ্রোতা।
এই কথোপকথনের ফাঁকেই মঞ্চ থেকে শোনা যাচ্ছিল এক ভদ্রলোকের কণ্ঠে ‘এইবার হবে।’
কী হবে? সব অপেক্ষার পালা শেষ করে মঞ্চে কারা উঠবে ? এমন সব প্রশ্নের তুবড়ি ছুটিয়ে দর্শকের হুড়োহুড়ি যেন বেড়ে গেল।
বিকালের দৃশ্যের সঙ্গে রাতের কনসার্টের দৃশ্য বদলে যায়। রাতে আরও ভিড় বাড়ে, বিশাল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। প্রায় সবাইকে যেন মঞ্চের সামনে যেতেই হবে, এমন অস্থিরতা ছিল মানুষের ভেতরে। তবে গান শুরুর আগের নম্বর কাউন্ট ডাউনের সময় হুড়োহুড়ি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
শুরু হয় ব্ল্যাকের নতুন গান ‘সমান্তরাল’র মিউজিক ভিডিও দিয়ে। তারপরই মঞ্চে ওঠেন ব্ল্যাকের বর্তমান সদস্য রুবায়েত চৌধুরী, মুশফিক জাহান (গিটার) ও চার্লস ফ্রান্সিস (বেজ)।
পরপর চারটি গান ‘আবারও’, ‘মানুষ পাখির গান’, ‘এখনও’, ‘তুমি কি সাড়া দিবে’ করেন তারা।
তাদের পারফর্ম শেষ হলে দর্শকরা ভেসে যান নস্টালজিয়ায়। কারণ মঞ্চে ওঠেন তাহসান, জন, টনি, জাহান ও মিরাজ। অর্থাৎ ব্ল্যাকের পুরনো সদস্যরা।
ব্ল্যাকের এই পঞ্চপাণ্ডবদের দেখে দর্শকরা চিৎকার করে, নেচে গেয়ে যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, তাতে মনে হয় সন্ধ্যা সবেমাত্র শুরু। বিকাল থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার ক্লান্তি যেন ঘুঁচে গেল সবার।
শুরুটা করেন জন। তিনি ধরেন আমার পৃথিবী অ্যালবামের ‘আমরা’ গানটি। এরপরই তাহসানের কণ্ঠে শোনা যায় ‘শ্লোক’।
মঞ্চে তাহসান ও জন কবির একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছু সময়। এত বছর পর ফেরার সবটুকু আবেগ দর্শকের সঙ্গে ভাগ করে নেন দুই শিল্পী।
একে একে তাহসান ও জন প্রায় ১৬-১৭টি গান করেন। এক ঘণ্টার মত মঞ্চ ও দর্শক ছিল তাদের দুজনের দখলে। গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন তাহসান, আর দাঁড়িয়ে বা বসে গেয়েছেন জন।
কনসার্টের ফাঁকেই তাহসান জানালেন '' এত বছর ফিরে খুবই ইমোশনাল লাগছে যেই অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা খুব একটা সহজ নয়। এই রিইউনিয়ন ব্ল্যাকের প্রয়াত ইমরান আহমেদ চৌধুরী মবিন ও ব্ল্যাকের গীতিকার ইমন জুবায়েরকেও খুব মিস করছে। তারা আমাদের ব্ল্যাকের সঙ্গে সবসময় ছিলেন এবং থাকবেন।"
তাহসান বলেন, " আমরা যে আজ ১৫টির মত গান করছি তার ১২টি গানই হয়ত ইমন ভাইয়ের লেখা। আমরা শুধু পাঁচজন পারফর্ম করছি না, ইমন ভাইও আমাদের সাথে আছেন।"
এরমধ্যে ‘প্রাকৃতিক’, ‘আমার পৃথিবী’, ‘যদি ইচ্ছে করে তবে’, ‘কবর’, ‘চিহ্ন’, ‘কেন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গান দিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে রাখেন তাহসান ও জন।
ভক্ত অনুরাগীদের প্রশ্ন ছিল, পুরনো ব্ল্যাককে ফের নিয়মিত পাওয়া যাবে কি না।
গানের ফাঁকে তাহসান দর্শকের কাছে জানতে চান, তাদের গান ভবিষ্যতে কেউ শোনার আগ্রহ রেখেছেন কি না।
উত্তরে, 'চাই, চাই' স্লোগানে কেঁপে ওঠে পুরো মাঠ। এরপর তাহসান বলেন, "আমরা আবারও ফিরব, যদি জন চায় তাহলে আবারও ফিরব আমরা!"
ব্ল্যাকের শেষ গান ছিল ‘পরাহত’। তখন রাত প্রায় ১২টার কাছকাছি। এটি দিয়েই পর্দা নামে কনসার্টের।