চলচ্চিত্রের স্টান্টম্যানরা প্রচারের আড়ালেই থেকে যান। ক্যামেরার পেছনে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলা সেইসব মানুষের জীবন কেমন?
Published : 18 Jun 2024, 01:09 AM
ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে রেল লাইনের ব্রিজে দৌড়াচ্ছেন শাকিব খান ও বৈশাখী। হঠাৎ পা পিছলে নিচে পড়ে যাওয়ার উপক্রম বৈশাখীর। তাকে বাঁচাতে এক হাত দিয়ে ধরে ফেললেন শাকিব।
এটি ‘নিখোঁজ সংবাদ’ সিনেমার একটি দৃশ্য এটি। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমার এই দৃশ্যে কাজ করতে গিয়ে স্টান্টম্যান সুমন রেজা জুম্মনকে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবেন কল্পনাও করতে পারেননি সেদিন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে সেদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জুম্মন বলেন, “শাকিব ভাইয়ের ডামি করছিলাম। ওই শটটা ছিল পুবাইলে নদীর উপরে রেলব্রিজে। রশি দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, নিচে ঝুলবে অভিনেত্রী বৈশাখী। এক সময় দুজনই ঝাঁপ দেবে পানিতে- দৃশ্যটা এমন।
“শুটিংয়ের প্রস্তুতির মধ্যে হঠাৎ ট্রেন এসে গেল। জায়গাটা জঙ্গলে ঘেরা, হর্ন না দিলে দেখাও যায় না ট্রেন আসছে। ট্রেনের রাস্তায় আমাকে বেঁধে রাখা, জীবন বাঁচাতে সবাই আমাকে রেখে দৌড়ে দুদিকে সরে গেল।”
ভয়ঙ্কর সেই ঘটনার স্মৃতি স্মরণ করে এই স্টান্টম্যান বলেন, “আমি না পারছি পানিতে লাফ দিতে, না পারছি রশি খুলতে। সেই অবস্থায় রেলব্রিজের কাঠের স্লিপারগুলোর ওপর শুয়ে পড়ি। পুরো ট্রেনটা আমার উপর দিয়ে গেছে। প্রাণে বেঁচে গেলাম সেবার।”
তার জীবনে দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ছিল আরও মারাত্মক, রীতিমতন জীবন বিপণ্ন হওয়ার মত। সেটা ২০১২ সালের দিকে।
জুম্মন বলেন, সোহানুর রহমান সোহানের 'এক মন এক প্রাণ' সিনেমায় একটা অসম্পূর্ণ ভবন থেকে গ্লাস জাম্প (কাচের দরজা ভেঙে প্রবেশের দৃশ্য) দেন। লাফ দেওয়ার সময় উপরে একটা জায়গায় পা আটকে যায়। ভাঙা কাচ পড়ে পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বের হয়ে যায়।
পরদিন ছিল শবে বরাতের ছুটি। কোনো হাসপাতাল অপারেশনের জন্য রাখছিল না জুম্মনকে। শেষ পর্যন্ত বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসক কাচ টেনে বের করতে গিয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে দেন। অর্ধেকটা কাচ ভেতরেই থেকে যায়।
“ডাক্তার বলেছিলেন, ‘বাবা তোকে মনে হয় বাঁচাতে পারব না’। আমি নিজের কানে শুনেছিলাম ওই কথা এবং এরপর জ্ঞান হারাই। পুরো তিন দিন পর জ্ঞান ফিরেছিল সেবার।”
জীবনবাজি স্টান্টম্যানদের, বাহাদুরি নায়ক-নায়িকার
এমন হাড়হিম করা স্মৃতি জুম্মনের একার নয়। সিনেমার পর্দায় সাধারণত নায়কের, কখনো-কখনো নায়িকার বাহাদুরি দেখে অভ্যস্ত দর্শক জানতেও পারে না, দৃশ্যগুলোর নেপথ্যে কারা কাজ করেছেন।
আগুনের উপর দিয়ে ঝাঁপ দেওয়া, পাহাড়ের উপর থেকে নিচে পড়ে যাওয়া, রেলসেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে নায়িকাকে বাঁচানো, উঁচু দালান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়া, কাচ ভেঙে প্রবেশ- নায়কদের এমন অনেক দৃশ্য সিনেমায় দেখে বাহবা দেন দর্শকরা। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিনেমার পর্দায় কাজটি করেন স্টান্টম্যানরা। তারাই একজন নায়ককে করে তোলেন সত্যিকারের নায়ক, নায়িকাকেও।
তবে বাংলাদেশে এখনও এই পেশায় আসেননি কোনো নারী। পুরুষরাই নারীর সাজসজ্জায় কাজ চালিয়ে নেন।
স্টান্টম্যান মিঠু বলেন, “আমরা অনেক নায়িকার স্টান্ট হয়েও কাজ করেছি। যেমন- অভিনেত্রী শাবনূরের জনপ্রিয় 'কাজের মেয়ে' সিনেমায় কাজ করেছি, মৌসুমীর 'বাঘিনী কন্যা', অভিনেত্রী পারভীন সুলতানা দিতির 'হত্যা' সিনেমায় কাজ করেছি। এমন অনেক অভিনেত্রীর ডামি আমরাই করেছি। মেয়েরা এই পেশায় আসতে ভয় পেত, তাছাড়া এই কাজগুলো পরিচালকরাও মেয়েদের দিয়ে করাতে চাইত না। তাই আমরাই অভিনেত্রীদের সাজে ডামি দিয়ে দিই।”
ইন্ডাস্ট্রিতে ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতা মিঠুর। অনেক সিনেমায় কাজ করেছেন, এখনো নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। অভিনেতা জসিম ছিলেন এলাকার বড় ভাই। জসিম তার ‘জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপে’ নিয়ে আসেন তাকে। লাফ, ঝাঁপে এক্সপার্ট ছিলেন বলে প্রথম কাজেই জসিমের কাছ থেকে বেশ প্রশংসা পান মিঠু।
১৯৯১ সালে মিঠু স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। জসিমের 'লক্ষ্মীর সংসার' সিনেমা দিয়ে শুরু হয় তার এই যাত্রা। জসিমের পার্সোনাল স্টান্টম্যান হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছেন। তারপর ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরী, মান্না, অমিত, রিয়াজ, ফেরদৌস, সালমান শাহর সঙ্গেও কাজ হয়েছে তার।
মিঠু বলেন, “সালমান ভাইয়ের 'কিছু আশা কিছু ভালবাসা ', 'বিচার হবে', 'কন্যা দান', 'বিক্ষোভ ', 'আঞ্জুমান', সিনেমাসহ অনেক সিনেমায় কাজ করেছি। মান্না ভাইয়ের ১০০ সিনেমার মধ্যে ৮০টাই আমি স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করেছি। শাকিব খানের অনেক সিনেমায় কাজ করেছি। শেষ কাজ করেছি 'রাজত্ব' সিনেমায়। আমি ভারতের অনেক শিল্পীর সঙ্গেও কাজ করেছি, দেশের বাইরে ঘুরে ঘুরে কাজ করেছি, থাইল্যান্ডের শুটিং করার সুযোগ হয়েছে, নেপাল কাজ করেছি।"
স্টান্টম্যান মো. হারুন অর রশিদ জানালেন, অভিনেত্রী চম্পার বেশকিছু অ্যাকশন দৃশ্য ছিল 'খলনায়ক' সিনেমায়, যেগুলো তিনি করেছেন।
জীবনের ঝুঁকির দাম ‘অতি সামান্য’
চলচ্চিত্রের এই স্টান্টম্যানরা প্রচারের আড়ালেই থেকে যান। ক্যামেরার পেছনে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নেওয়ার বিনিময়ে জীবনে কী পান তারা?
সেই উত্তর জানতে কয়েকজন স্টান্টম্যানের সঙ্গে কথা হয় গ্লিটজের। তাদের মধ্যে কেউ নিয়মিত কাজ করছেন এখনো, কেউবা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মো. হারুন অর রশিদ ১৯৮৪ সাল থেকে স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর এই পেশায় কাজ করে এখন তিনি জ্যেষ্ঠ স্টান্টম্যান। এক সময় কাজ করেছেন ‘ফাইট মাস্টার’ হিসেবে। আর এখন কাজ করেন ‘অ্যাকশন ডিরেক্টর’ হিসেবে।
অভিনেতা জাফর ইকবাল, শাবানা, রোজিনা, অলিভিয়া, মাহমুদ কলিদের সময়ে তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন হারুন। এফডিসিতে তাকে ‘হারুন ফাইটার’ নামেই চেনে সবাই।
জীবনে ঘটে যাওয়া বড় কোনো দুর্ঘটনা আছে কিনা জানতে চাইলে হারুন গ্লিটজকে বলেন, “অনেক আছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনা বেশি মনে পড়ে। গাজী মাযহারুল আনোয়ার পরিচালিত 'তপস্যা' সিনেমার একটি দৃশ্যে ৪০০ ফুট পাহাড়ের ওপর থেকে ছুরি মেরে খলনায়ক রাজীব নায়ক আলমগীরকে নিচে ফেলে দেয়। ওই দৃশ্যে আলমগীরের বডি ডামি ছিলাম আমি।
“গড়িয়ে পড়তে গিয়ে আমি একেবারে নিচে পড়ে যাই। কোমরে, মাথায়, পায়ে ব্যথা পাই। পড়ার পরে সবাই মনে করেছে হারুন মরে গেছে, ডেকেও সাড়া পাচ্ছে না। অজ্ঞান ছিলাম। তারপর হাসপাতালে গেলে জ্ঞান ফিরে আসে। অবশ্য পরের দিন আবার এসে ওই শুট সম্পন্ন করি।”
এছাড়া ২০০৪ সালে পি এ কাজলের ‘ঘাড়ত্যাড়া’ সিনেমার একটি দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে আগুনে দগ্ধ হন হারুন। পেট্রোলের আগুনে হাত, মুখ পুড়ে যায়।
“মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, শুনেছিলাম পোড়া জায়গা রক্তাক্ত না হলে চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তাই চেহারা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি খামচে, চুলকে নিজেই নিজের মুখ রক্তাক্ত করেছি। এটা করা খুব কষ্টের ছিল। পরে সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছে।”
এর বাইরে গ্লাস জাম্প, মাথা দিয়ে গ্লাস ভাঙ্গার দৃশ্যও করেছেন হারুন। সেসব করতে গিয়ে জখম হয়েছেন বহুবার। মাথায় সেলাইয়ের দাগ দেখলেই বোঝা যায় সেসব।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করছেন, নিজেদের জীবনের মূল্য কত? হারুন বললেন, “১৯৮৪ সালে স্টান্টম্যান হিসেবে যখন কাজ শুরু করি, তখন আমাকে ১০ টাকা কনভেন্স বিল দিত। আর জিজ্ঞেস করত ‘ভাত কী দিয়ে খাইছস’। যদি গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাইতাম, তখন বলত ‘তাইলে তো তোর কোনো টেকাই নাই আইজকা’। জীবনের ঝুঁকির দাম এখানে অতি সামান্য।”
অভিজ্ঞ এই স্টান্টম্যান বলেন, “তখন সিনেমা পাগল ছিলাম। মনে হত টাকা দিলে দিল, না দিলে নাই, কাজ করি। আর এখন যারা স্টান্টম্যান বা ফাইটার আছি, তারা এক শিফট কাজ করলে পাই ১৫০০ টাকা। দুই শিফট করলে পাই ২৫০০ টাকা। শিফট হয় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা, আর ৫টা থেকে রাত ১১টা।
“অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে কাজ করলে আমাদের ‘জীবনের’ মূল্য ২৫০০ টাকা। নব্বইয়ের দশকের দিকে প্রতিদিনই কাজ ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা প্রতি মাসে ৫ দিন কাজ করতে পারলেই সবাই শুকরিয়া আদায় করি। অনেকে আছে যারা দুই মাস, চার মাস, পাঁচ মাস কোনো কাজ পায় না। বেকার ঘুরে বেড়ায়।”
তারপরও কেন এই পেশায়? হারুনের উত্তর, “ফিল্মকে ভালোবেসেই এই কাজ করা। সিনেমার অভিনয় দেখে ভালো লাগত, মনে হল সিনেমায় অভিনয় তো করতে পারব না, তাহলে টেকনিশিয়ান হই। ধারণা ছিল টেকনিশিয়ান হয়ে জীবনে এক সময় এর মূল্য পাব।”
পেশা ছেড়েছেন দেলোয়ার-ইমনরা
কাজ করতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন স্টান্টম্যান দেলোয়ার হোসেন। এখন আর ঝুঁকি নিতে পারেন না। তাই এ পেশা ছেড়ে ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন, তাতেই কোনোমতে সংসার চলে।
দেলোয়ার বলেন, “প্রায় ২৫ বছর আগের ঘটনা। ‘দেশের শত্রু’ সিনেমায় বোমা হামলার দৃশ্য করতে গিয়ে আমার উপরে বোমাটা ফেটে যায়। এসব দৃশ্যে তো রশি দিয়ে উপর থেকে উড়ে এক পাশ থেকে আরেক পাশে যেতে হয়। বোমার সুইচটা দেবে আমি ওপাশে গেলে। কিন্তু আমি যখন ক্রস করতে যাই, ভুলবশত সুইচ আগে দিয়ে ফেলে। সাথে সাথে আগুন লেগে যায়। এখনো আমার পুরো শরীরের চামড়া পোড়া।”
দেলোয়ার বলেন, “জ্যাম্বস গ্রুপে জসিম ভাইয়ের স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করেছি। জিমন্যাস্টিকস, মার্শাল আর্ট এসব করতাম। সেসব দেখেই ডামি নূর ইসলামের হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আসা। নূর ইসলাম আর নেই। আমি ১৯৯০ সাল থেকে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি। এখন আর করি না।”
স্টান্টম্যান হিসেবে ইমন আনোয়ারের হয়েছে নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা । এখন আর কাজ করেন না।
এই পেশায় এসে জীবনের দেড়টা বছর দুর্বিষহ কেটেছে জানিয়ে ইমন বলেন, “‘বাজিগার সিনেমায় স্টান্ট করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছি। রাস্তায় লাফ দিয়ে লাথি দিতে গিয়ে যে শিল্পীকে টার্গেট ছিল উনি সরে গেছেন। আমি আর ব্যালেন্স রাখতে পারিনি। পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে ৩০ মিনিটের মত স্পটেই অজ্ঞান ছিলাম। এই আঘাতে আমি এক থেকে দেড় বছর অ্যাবনরমাল ছিলাম।
“তখন আমার ফ্যামিলিই এই খরচটা বহন করছে। আঘাত পাওয়ার পরে সাময়িক যে ট্রিটমেন্ট সেটা তারা দিয়েছিল। বাকিটা আমার ফ্যামিলি, আমার যা রোজগারের টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে হয়েছে। এরপর আর কাজ করিনি। এখন ডিরেকশন দিই বা আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করি।”
এখন ওরা সাতজন
এফডিসিতে এখন স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করছেন সাত জন। ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ফাইটারস বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে তাদের একটি সংগঠন আছে। স্টান্টম্যান ছাড়া ফাইটাররা ওই সমিতির সদস্য হতে পারেন। সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দুইশর কাছাকাছি। ফাইটার হারুন এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।
টলিউড, বলিউড, হলিউডের স্টান্টম্যানদের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের জন্য জীবন বীমা করা থাকে। বাংলাদেশে তেমন সুবিধা আছে?
প্রশ্ন শুনে তাচ্ছিল্যের হাসিতে হারুন বলেন, “বাংলাদেশের বাইরে যারা স্টান্ট করে, তাদের জীবন বীমা আছে, তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা পয়সা পায়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন অবস্থা যে, দেখা যাবে আমি দুর্ঘটনায় পড়লাম, বেঁচে আছি। আমার আগে ওরাই টাকা তুলে খেয়ে ফেলেছে। এদেশে এগুলো বিশ্বাস করা যায় না।”
কিছুটা অভিযোগের সুরে হারুন বলেন, “আমরা দুর্ঘটনার শিকার হলে প্রযোজককে জানালে তারা একটা খরচা দেয়। খরচটা শুধু হাসপাতাল পর্যন্ত। এরপর আর টাকা-পয়সা কেউ কোনোদিন পায়নি, খোঁজও নেয় না কেউ। তারা দেখার প্রয়োজনও মনে করে না। আমরা কাজ করে দিই, কাজ শেষ তাদের দায়িত্বও শেষ।”
পাশ থেকে স্টান্টম্যান জুম্মন তার দুর্ঘটনার সূত্র ধরে বললেন, “হাসপাতালের খরচটাও পুরোপুরি পাওয়া যায় না। 'এক মন এক প্রাণ' সিনেমায় আমি যে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম, তারপর ১৩ দিনের মত হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। প্রথম দিনের খরচের পর আর আমার খবর রাখেনি কেউ। ১৩ দিন পর আমি নিজের টাকায় হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে বসায় ফিরি। ডাক্তার রেস্ট দিয়েছিল ৬ মাস।
“প্রযোজকের উচিত ছিল খরচটা দেওয়া, দেয়নি। সে সময় একটা পুলিশ কেস করা যেত ‘অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডার’। তাদের সম্মান বাঁচানোর জন্য আমি সেটাও করিনি। আমরা যেহেতু মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, পেটের তাড়নায় এক মাস পরই কাজে ফেরত আসি।”
কিছুটা ক্ষোভের সুরে জুম্মন বললেন, “বাংলাদেশে স্টান্টম্যান, ফাইটারদের জন্য কোনো বাজেট থাকে না, একটা গানের পেছনে ২০ লাখ টাকা খরচ করতে পারে, কিন্তু ফাইটিং, স্টান্টম্যানদের জন্য ৫ হাজার টাকাও রাখে না।”
নেই নামের স্বীকৃতিও
নায়কদের উত্থানের পেছনে স্টান্টম্যানদের ভূমিকা থাকে। অথচ দর্শক চেনে না এসব নেপথ্য নায়কদের। পর্দায় নায়কদের সাহসী কার্যকলাপ দেখে দর্শকরা হাততালি দেন, স্টান্টম্যানরা থেকে যান আড়ালেই। খারাপ লাগে না?
প্রশ্ন শুনে স্টান্টম্যান মো. মাসুদ খান বলেন, “এত রিস্ক নিয়ে কাজ করি, কিন্তু আমাদের নাম সিনেমায় যায় না। শেষের ৫-৭ সেকেন্ড আমাদের নাম রাখতে পারে। আমাদের দেশে রাখা হয় না।”
মুসলিম ফাইটিং গ্রুপের সদস্য মাসুদ কাজ করছেন ২০০৭ সাল থেকে। তিনি বলেন, “অনেক সময় অনেককে বলেছি আমরা স্টান্টম্যান হিসেবে কাজ করি, আমাদের নাম যদি আসে তাহলে আমাদের একটু ভালো লাগে৷ কিন্তু আমরা কোনো সাড়াশব্দ পাইনি৷ আমাদের ডিরেকশন তো ফাইট ডিরেক্টর দেয়। সিনেমায় তাদের নাম যায়, আমাদের যায় না।"
পর্দায় ফাইট ডিরেক্টরের নাম গেলেও স্টান্টম্যানদের নাম যায় না কেন তা জানতে চাওয়া হলে জ্যেষ্ঠ ফাইট ডিরেক্টর আরমান বলেন, “সিনেমায় ফাইট আর্টিস্ট হিসেবে নাম যায়, কিন্তু আলাদা করে স্টান্টম্যান হিসেবে নাম যায় না। তবে তাদের নাম যাওয়া উচিত। এটা নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়নি, হয়ত সামনে করব।”
অ্যাকশন-থ্রিলারধর্মী সিনেমা নির্মাণ করে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন নির্মাতা ইফতেখার চৌধুরী। 'রাজত্ব', 'অগ্নি', 'অ্যাকশন জেসমিন' সিনেমায় বেশ কিছু দুর্ধর্ষ দৃশ্য রয়েছে, যেগুলো স্টান্টম্যানরাই করেছেন।
সিনেমায় স্টান্টম্যানদের নাম যাওয়া উচিত কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার সিনেমায় নাম যায়, এনক্রিপশন স্ক্রিনে থাকে। অন্যদের সিনেমার কথা জানি না। বাইরের দেশগুলোতে কিন্তু স্টান্টম্যানদের অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তারা চায় তাদের স্টান্টম্যানরা আন্তজার্তিকভাবে পরিচিতি পাক। হিরোরাও উদ্যোগ নেন।
“তাদের জীবন অনেক ঝুঁকির। তাদের জন্য ভাবা উচিত। এমনও দেখা যায়, কেউ একজন মারা গেল, এত বছর ধরে কাজ করছে, এত সিনেমা করেছে, তাদের জন্য ভালো কিছু করা হয় না। আমাদের দেশে স্ট্যানম্যানদের বড় করে ধরা হয় না। তাদের জন্য উদ্যোগ নেওয়া, চিন্তা করা উচিত।”
ভুলে গেছে সবাই
১৯৭৩ সালে অভিনেতা জসিম জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ সিনেমায় বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে প্রথম অ্যাকশন দৃশ্য যুক্ত করেন। পরে অ্যাকশন দৃশ্যের জন্য তার নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা থেকে 'জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ' খোলেন। পাঁচজন সদস্যের নামে করা হয় ওই গ্রুপটি।
এফডিসিতেই কথা হয় জ্যাম্বস গ্রুপের অন্যতম সদস্য মো. শেখ জামালের সঙ্গে।
বয়সের ভারে ভেঙে পড়া এই ব্যক্তি বলেন, জ্যাম্বস গ্রুপের যে পাঁচজন প্রধান ছিলেন, তাদের মধ্যে আমান ও বাবুল বেঁচে আছেন। আর সবাই মারা গেছেন।
জামাল বলেন, “এফডিসিতে এসে বসে থাকি জ্যাম্বস গ্রুপকে ভালোবাসি বলে। এটা দেখার কেউ নেই, ধরে রাখার কেউ নেই। প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি মারা যায় সেটার হাল ধরতে না পারলে আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা মারা গেলে এই নামটাও আর থাকবে না। আমাদের ভুলে যায়, সবাই ভুলে গেছে মৃতদের নাম।”
আগের অনেক স্টান্টম্যান এখন বেঁচে নেই। বুলেট, কামাল, মুসলিম, লাবু, শামীম ছিলেন এক সময়ের দাপুটে স্টান্টম্যান। চারজনই মারা গেছে। নূর ইসলাম নামের একজন ছিলেন, যার কোনো খোঁজ মেলেনি। অনেকে ধারণা করছেন তিনিও মারা গেছেন।
[এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবিগুলো স্টান্টম্যানদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেওয়া।]