সব মশা মেরে ফেলার চিন্তা যদি আসে, সবার আগে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এর সংখ্যা। বিশ্বে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে।
Published : 05 Oct 2023, 08:36 PM
এ বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আর মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারিভাবে জনসচেনতা তৈরি আর মাঠপর্যায়ে মশা নিধনের নানা উদ্যোগের পরও ডেঙ্গুর দাপট কমছে না।
কেবল ডেঙ্গু নয়, ম্যালেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল, জিকাসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগে প্রতি বছর এ পৃথিবীতে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়। সে কারণে মশাকে বিশ্বের সবথেকে প্রাণঘাতী জীব অ্যাখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব উষ্ণ হয়ে ওঠায় রক্তচোষা এ প্রাণীর উপদ্রব আরও বেড়েছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে মশার সঙ্গেই মানুষের প্রতিদিনের বসবাস। এই পতঙ্গের উপদ্রব বেড়ে গেলে স্থানীয়ভাবে বা নিজেদের চেষ্টায় এ সমস্যা সমাধানের সহজ কোনো পথ আছে? সব মশা মেরে ফেলতে পারলে কি এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে।
মশা কী কাজে লাগে
সব মশা মেরে ফেলার চিন্তা যদি আসে, সবার আগে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে এর সংখ্যা। বিশ্বে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে।
লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির কীটতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টেন হিলি বলেন, আবাসস্থলের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক প্রজাতির মশাই খুব আলাদা। কেউ মানুষকে কামড়ায়, কেউ ব্যাঙ বা পাখিদের। ফলে তাদের বাস্তুতন্ত্রও ভিন্ন। আর এই বৈচিত্র্যের কারণেই এসব মশা ভিন্ন ভিন্ন বাস্তু শৃঙ্খলের অংশ। অর্থাৎ, আলাদা আলাদা পরিবেশ ও প্রাণীর সঙ্গে তাদের সম্পর্কও ভিন্ন ভিন্ন।
আমেরিকান মসকিউটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিলি জানান, জলাধারের জীবন চক্রে মশার ভূমিকা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। মাছ ও অন্যান্য ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণির খাবার হল মশার লার্ভা। আবার ছোট কিছু প্রাণী আছে, যারা প্রাপ্তবয়স্ক মশা খায়।
অন্য পরিবেশে যেসব মশা পাওয়া যায়, তারাও তাদের আবাস্থল অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট বাস্তু শৃঙ্খলে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ সেগুলো কারও না কারও খাবার হিসেবে কাজে লাগে। সে কারণে মশার বংশ ধ্বংস করতে গেলে তার প্রতিকূল প্রভাবও পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শত শত বিলিয়ন মশা যে মানুষ একেবারে নির্মূল করতে পারবে, এমন সম্ভাবনাও কম। আর সব মশা থেকে মানুষের পরিত্রাণের প্রয়োজনও নেই। যেসব প্রজাতির মশা মানুষকে কামড়ায় বা বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ ঘটায়, সংখ্যায় সেগুলো কম।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লরা হ্যারিংটনের মতে, সব মশা নির্মূল করলে তা খাদ্যচক্রে প্রভাব ফেলবে। দুই-একটি প্রজাতিকে নিধন করলে ততটা বিরূপ প্রভাব নাও পড়তে পারে।
সমস্যা কোন মশায়
মানুষের জন্য যেসব মশা সমস্যা তৈরি করছে, তার মধ্যে আছে এইডিস, অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স জাতের মশা। এই প্রজাতিগুলো একাধিক ভাইরাস বা পরজীবীর বাহক হতে পারে। অ্যানোফিলিস ম্যালেরিয়ারে জীবাণু বহন করে, কিউলেক্স ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস এবং এইডিস মশা পীত জ্বর, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাস বহন করতে পারে। মানুষের বাস্তুতন্ত্রে এই মশাগুলোর প্রয়োজন নাও থাকতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির বায়োস্ট্যাটিস্টিকস ও এপিডেমিওলজির আবাসিক অধ্যাপক জন মার্শাল বলেন, “রোগ ছড়ানো মশার প্রজাতি, যেমন এইডিস ইজিপ্টি ও এইডিস অ্যালবোপিকটাস পৃথিবীর অনেক এলাকায় আগে ছিল না, পরে সেখানে তারা রাজত্ব শুরু করেছে। এসব মশা ছাড়াই আমরা ভালো ছিলাম।
“হাজার হাজার প্রজাতির মশা আছে, যার মধ্যে মাত্র কয়েকটি রোগজীবাণু ছড়ায়। ফলে রোগ ছড়ানো প্রজাতিগুলোকে যদি নির্মূল করা হয়, তবে ক্ষতিকর নয় এমন অন্য প্রজাতিগুলো তাদের পরিবেশগত জায়গা দখল করতে পারবে। ঐতিহাসিক কাল ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে রোগ ছড়ানো মশা নির্মূল করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়ভাবে এসব মশা নির্মূল সম্ভব।”
হিলি বলেন, ভাইরাস ও পরজীবের সঙ্গে এই মশাগুলোর ‘খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ রয়েছে। এর মানে হল, সহযোগী প্রজাতিগুলোও তাত্ত্বিকভাবে এসব জীবাণু বহন ও ধরন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে। কিন্তু ক্ষতিকর মশাগুলো নির্মূল করলে এর সঙ্গে সম্পর্কহীন অপরিচিত প্রজাতিগুলো যে হঠাৎ একেবারে প্রাণঘাতী ভাইরাসের বাহক হয়ে উঠবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। সাধারণত ঘরবাড়িতেই এর উপদ্রব দেখা যায়। পাখি এসব মশা খায়। সে কারণে পাখিও ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের বাহক হয়ে যায়। মানুষ এ ভাইরাসের পোষক হয় দুর্ঘটনাক্রমে।
কীটতত্ত্ববিদ হিলি জানান, লার্ভা ও পিউপা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কিউলেক্স মশা সেপটিক ট্যাংকের জল, বদ্ধ পুকুর ও নর্দমার মত দূষিত পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে। এছাড়া এশিয়ান টাইগার মশার (এইডিসের প্রজাতি) মত যে মশাগুলো ঘরবাড়ির আঙিনায় জন্মে, সেগুলোও নির্মূল করার চেষ্টা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
এই মশাগুলো প্রাথমিকভাবে বাড়ির পেছনে ফেলে রাখা পানির পাত্র, টায়ার ও অন্যান্য পাত্রে জমা পানিতে বেড়ে ওঠে। এ ধরনের বাস্তুচক্রে অন্যান্য প্রজাতির মশাগুলো থাকে না। ফলে ঘরবাড়িতে জন্মানো নির্দিষ্ট এই মশাগুলো নির্মূল করলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যস্ত হবে না।
অপরদিকে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ানো অ্যানোফিলিস মশার বিষয়টি খানিকটা ভিন্ন। এ মশাগুলো জলাধারে বেশি থাকে, যেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুসংস্থান রয়েছে।
হিলির মতে, “আপনি যদি এই প্রজাতির মশাগুলো নির্মূল করতে যান, তাহলে কী ধরনের জিনিস সেই পরিবেশে ব্যবহার করছেন, সেটি ভাবতে হবে।”
মানুষ কী করছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে– এমন ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের দিন আর নেই। মশা নিধন কৌশলগুলো এখন আরও বেশি পরিশীলিত হয়ে উঠেছে।
যেমন- ডেঙ্গু, জিকা ও পীত জ্বরের ভাইরাসের বাহক এইডিস ইজিপ্টি মশাকে ‘জীবাণুমুক্ত’ করার জন্য ‘ওলবাসিয়া’ ব্যাক্টেরিয়ার ব্যবহারে কিছু সাফল্য এসেছে।
লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিলি বলেন, পুরুষ মশাকে জীবাণুমুক্ত করতে ‘ওলবাসিয়া’র ব্যবহার করা হয়। এটি এইডিস মশায় থাকা জিকা, ডেঙ্গু, পীত জ্বর ও চিকুনগুনিয়া রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলোর প্রতিলিপি তৈরি হতে দেয় না।
আবার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেও মশার প্রজনন রোধ করা যেতে পারে। রাসায়নিকের ব্যবহার না করে মশাখেকো মাছ, চিনির ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। মশার লার্ভা খুঁজতে ব্যবহার করা যেতে পারে ড্রোন।
কিন্তু মশা মারার যুদ্ধে মানুষ যে জয়ী হতে পারেনি, সেখানে কারও দ্বিমত নেই। এই লড়াইকে ‘চ্যালেঞ্জিং’ হিসেবে বর্ণনা করে হ্যারিংটন বলেন, মশার জীবনকাল স্বল্পস্থায়ী। মশা মারতে মানুষের প্রক্রিয়াগত যে সময় লাগে, তার চেয়ে দ্রুত মিউটেশন, অভিযোজন ও পরিবর্তন ঘটাতে পারে তারা। আবার তাদের জীবন ও আচরণ সম্পর্কে মানুষ এখনও খুব বেশি জানি না। কার্যকর উপায়ে মশা দমনে এ বিষয়টি জানা গুরুত্বপূর্ণ।
“মশা মারতে সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য সরঞ্জামগুলোর বেছে নিতে অনেক গবেষণা দরকার। বিশেষ করে যেসব দেশের সক্ষমতা সীমিত, কিন্তু মশাবাহিত রোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, তাদের জন্য এটা জরুরি।”
মশা নিধনের শিক্ষাটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- স্প্রের ভুল ব্যবহারে মৌমাছির মত অন্যান্য পোকামাকড়ের ক্ষতি হতে পারে।
এখন তাহলে কী
ক্ষতিকর মশাগুলো নির্মূল করা সম্ভব হলেও সেজন্য সময় লাগবে। আপাতত নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন তার সারমর্ম হল-
>> মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকতে স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ অনুসরণ করতে হবে
>> পরিবেশ সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা অনুমোদিত স্প্রে ব্যবহার করা যায়।
>> বাইরে গেলে হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক যেমন- লম্বা স্লিভস ও প্যান্ট পরা যেতে পারে।
>> দরজা-জানালা দিয়ে যেন মশা ঢুকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা।
>> মশা আছে এমন কোথাও গেলে মশারির ব্যবস্থা করা।
>> সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও খুঁজে দেখতে হবে, বাড়িতে জমে থাকা পানি আছে কিনা। বৃষ্টির পর পাত্র, বোতলের পানি ফেলে দিতে হবে।