বাতাসে নাইট্রোজেন ও বিপজ্জনক সূক্ষ্ম কণার মাত্রা কমিয়ে চারপাশের বায়ুকে বিশুদ্ধ করে তুলছে এই টাওয়ার।
Published : 13 Jun 2023, 09:42 AM
বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের একটি পার্কে গত গ্রীষ্ম থেকে নিবিড়ভাবে চারপাশের বাতাস বিশুদ্ধ করে চলেছে একটি মসৃণ ফিল্টার বা বায়ু পরিশোধন ‘টাওয়ার’, যা পরিচিত ভার্টো নামে।
১৮ ফুট দীর্ঘ এই স্থাপত্য যন্ত্রটি বসানো হয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লির সুন্দর নার্সারি নামের সেই পার্কে। বাতাসে নাইট্রোজেন ও বিপজ্জনক সূক্ষ্ম কণার মাত্রা কমিয়ে এটি চারপাশের বাতাসকে বিশুদ্ধ করে তুলছে। দিনে ৬ লাখ ঘনমিটার বায়ু বিশুদ্ধ করছে এই টাওয়ার, যা ২৭৩টি উষ্ণ বায়ু বেলুনের সমান।
সিএনএন লিখেছে, এখন এই যন্ত্র ব্যবহারে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্থপতিরা ধারণা করছেন, বড় জনসমাগমপূর্ণ এলাকা, আশেপাশের অন্যান্য এলাকা এমনকি পুরো শহরে বায়ু বিশুদ্ধ করার জন্য এই প্রকল্পটি বড় করা যেতে পারে।
এই টাওয়ারের নির্মাতা স্থাপত্য ফার্ম ‘স্টুডিও সিমবায়োসিস’। ভারত ও জার্মানিতে তাদের অফিস রয়েছে। তাদের এই টাওয়ারগুলোতে একটি জ্যামিতিক শেলের ভেতরে পাঁচটি বায়ু ফিল্টার কিউব রয়েছে।
ফার্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা দম্পতি অমিত ও ব্রিটা নোবেল গুপ্ত সিএনএনকে বলেন, ফ্যানচালিত তাদের এই যন্ত্র আবদ্ধ জায়গার ৬৫৬ থেকে ১ হাজার ৬৪০ ফুট ব্যাসার্ধ পর্যন্ত বায়ু পরিষ্কার করতে পারে। আর বাইরে খোলা জায়গায় এটি ৩২৮ ফুট থেকে ১ হাজার ১৪৮ ফুট জায়গা জুড়ে বায়ু পরিশুদ্ধ করতে পারে। কতটুকু জায়গা জুড়ে এটি কাজ করবে, তা নির্ভর করে বাতাসের গতি আর সেই এলাকাটি কেমন তার ওপর।
দিল্লি থেকে ভিডিও কলে অমিত বলেন, এই যন্ত্র ব্যবহারে প্রাথমিক এই ফলাফলই আমরা আশা করছিলাম। এগুলো আরও বসানোর জন্য আমরা সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।
তিনি জানান, এ প্রকল্পে সাফল্য পাওয়ায় ইতোমধ্যে স্টুডিও সিমবায়োসিস উজবেকিস্তান থেকে শুরু করে ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ডের সম্ভাব্য ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি তাদের অবকাঠামো নির্মাণ সাইটে ধুলো ও সূক্ষ্ম কণা প্রতিরোধে প্রায় ৪০টি টাওয়ারের অর্ডার দেওয়ার কথা ভাবছে।
“আমি মনে করি, এই টাওয়ারগুলো পাবলিক পার্ক বা পাবলিক প্লাজাগুলোতে বসানো যেতে পারে, যেখানে বেশিরভাগ সময় মানুষ থাকে। এছাড়া ঘরহীন লোকেরা যেখানে ঘুমায়, সেখানে এটি বসানো গেলে তারা অবশ্যই উপকার পাবে”, বলেন ব্রিটা নোবেল গুপ্ত।
সিএনএন জানিয়েছে, ল্যাটিন শব্দ ‘ভার্টেন্ট’ থেকে এই টাওয়ারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভার্টো’। টাওয়ারের পৃষ্ঠের দিকে যতটা সম্ভব বাতাস ঠেলে দেওয়ার জন্য এর মোচড় দেওয়া নকশা করা হয়, যেখানে এটি বাতাস শুষে ফিল্টারে নেয় এবং তারপর সেটিকে বের করে দেয়।
জার্মান ফার্ম ম্যান+হিউমেল এর ফিল্টার ব্যবহার করে স্টুডিও সিমবায়োসিস আধুনিক মডেলে বায়ুর বিভিন্ন অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এই টাওয়ারগুলোর সবথেকে কার্যকরী আকৃতির দিকে মনোযোগ দেয়।
অমিত বলেন, এটি পুরোটাই বাতাসের গতি সম্পর্কিত বিষয়। ফলে তারা গাড়ির স্পয়লারসহ জেট বিমান ও এর প্রপেলার ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে, সেই বিষয়টিতে নজর দিয়ে এই টাওয়ার তৈরি করেন। ছোট ছোট অংশ সংযুক্ত করে বানানো এই টাওয়ার কীভাবে অধিক অ্যারোডাইনামিক হয়ে ওঠে তা ব্যাখ্যা করেন তিনি।
‘গণ পণ্য’
মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের একটি সমীক্ষা বলছে, ভারতে কেবল ২০১৯ সালেই বায়ু দূষণ প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানী নয়া দিল্লি নিয়মিতই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে; যানবহনের ধোঁয়া, শস্য পোড়ানো এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো শহরের বায়ু মান কমাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ‘হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট’ গত বছর দিল্লির বাতাসে ক্ষতিকর সুক্ষ্ম কণা বা পিএম২.৫ এর মাত্রা পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি।
দূষণের সরাসরি প্রভাব ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে ১৯৯২ সাল থেকে ২৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে গত মাসে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
অমিত ও ব্রিটা নোবেল গুপ্ত জানান, লন্ডন থেকে দিল্লির দূষণের মাত্রা দেখে তারা ওই টাওয়ার বানানোর কাজে উদ্যোগী হন।
“আমাদের মূল ব্যবসা হল স্থাপত্য… আমরা বায়ু পরিশোধন করতে চাইনি। কিন্তু এখানে (দিল্লিতে) যে দূষণ, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নয়। এট খুবই খারাপ,” বলেন অমিত।
সিএনএন লিখেছে, দূষণ কমাতে বাতাস শুষে নিতে টাওয়ারে যে বৈদ্যুতিক ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছে, তার ফলে ফের দূষণ হচ্ছে, যদিও সামান্য পরিমাণে। ভার্টোর পরিবেশগত প্রভাব কমাতে স্টুডিও সিম্বায়োসিস বিদ্যুৎসাশ্রয়ী স্মার্ট ফ্যান ইনস্টল করেছে।
স্থপতিদের দাবি, প্রতিটি টাওয়ার শিল্প ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত একই পরিমাণে শক্তি ব্যয় করে। কিন্তু এটি আবার বায়ুপ্রবাহ ১০০ গুণ বৃদ্ধি করে।
প্রতি তিন থেকে নয় মাস অন্তর এই টাওয়ারের ফিল্টার পরিবর্তন করা প্রয়োজন হয়। তবে তা আংশিকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্যও বলে জানিয়েছেন অমিত ও ব্রিটা। এই টাওয়ার থেকে উৎপন্ন শব্দের মাত্রা ৭৫ ডেসিবল, যা রান্নাঘরে ব্লেন্ডারের শব্দের সমান মাত্রার।
অমিতের অনুমান, দিল্লি জুড়ে বায়ু পরিশুদ্ধ করতে সম্ভবত এরকম ১০০ টাওয়ারের প্রয়োজন হবে। তবে সঠিক হিসাব পেতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
এতে ব্যবহৃত গ্লাস ফাইবার কংক্রিটকে আরও শক্তিশালী করেছে, যাতে সেগুলো সহজে পরিবহন করা যায় এবং বৃহৎ পরিসরে সেগুলো ব্যবহার বাড়ানো যায়।
এই বায়ু শোধনকারী টাওয়ারকে গণ মানুষের পণ্যে পরিণত করতে চান অমিত।