“সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলে তা পরাজয় স্বীকার হবে, তার অর্থ আমরা পারব না।…আমরা পারব না কেন? আমরা নিশ্চয় পারব। আমাদের চেষ্টা করতে হবে” বলেন তিনি।
Published : 08 Feb 2024, 11:53 PM
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য যেসব প্রস্তুতি দরকার তা নিতে বাংলাদেশ ‘দেরি করে ফেলেছে বলে’ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয় উপদেষ্টা মসিউর রহমান। আগামী কয়েকটি বছর যে সময় আছে তার মধ্যেই দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় ‘বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ১৩ম মন্ত্রী পর্যায়ে সম্মেলন: বাংলাদেশের ভাগ্যে কী আছে’ বিষয়ে এক সেমিনারের এ কথা বলেন মসিউর।
জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে যে প্রস্তুতির দরকার তা নিতে আমরা ইতোমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি।
“এই প্রস্তুতি আমাদের আরও আগে থেকেই নেওয়ার সময় ছিল। আমরা কিছুটা সময় হারিয়েছি। তাই এখন থেকেই সেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের পরে নতুন যে মাত্রা আসবে সেদিক অগ্রসর হতে হবে।”
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ উন্নয়নের তিনটি সূচকে শর্ত পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশ থেকে ২০২৬ সালের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার।
মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট ২০২০ সালে ছিল ৭৫.৩।
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে সেই দেশকে এলডিসিভুক্ত রাখা হয়, ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল ২৫ দশমিক ২।
মসিউর বলেন, এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে যেতে সমস্যা মনে হলে জাতিসংঘের কাছ থেকে আরও সময় নেওয়ার সুযোগ থাকে। তবে এটা করতে চান না তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, “সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলে তা পরাজয় স্বীকার হবে, তার অর্থ আমরা পারব না।…আমরা পারব না কেন? আমরা নিশ্চয় পারব। আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
“আমরা যেখানে পৌঁছেছি এরপরে পেছনের দিক হাঁটব না, সামনের দিকেই হাঁটব। সরকারেরও সেদিকেই হাঁটার প্রবণতা।”
অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনারের বক্তব্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ ২০২৯ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে এখন যেসব বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা আর পাওয়া যাবে না। বর্তমানে বিশ্ববাজারে রপ্তানিতে যে শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা পায়, তা আর পাওয়া যাবে না।”
তার মতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতে পারে প্যাটেন্ট সুবিধা হারানো।
তিনি বলেন, “বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধের উৎপাদনে সমস্যা না হলেও ২০ শতাংশ ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সমস্যায় পড়তে পারি। তখন এসব ওষুধের দাম ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।”
সাবেক সচিব শরিফা খান বলেন, “এলডিসি থেকে উত্তরণ পর্যায়ে তিন বছর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও যুক্তরাজ্য।
“তবে ২০২৯ সাল থেকে আর এই সুবিধা থাকবে না। এ জন্য এখনই ডব্লিউটিও মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় জোরালো অবস্থান রাখতে প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যে জিএসপি প্লাসের মতো বাণিজ্য সুবিধা নেওয়া যায়।”
মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তাফা আবিদ খান বলেন, “উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর আমাদের মৎস্য, কৃষি, শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা এবং ই-কমার্স খাতের ওপর বেশি নজর রাখতে হবে।”
কোনো দেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বৈশ্বিক হিসাবের ১ শতাংশের বেশি হলে ডাব্লিউটিওর আইন অনুযায়ী সেই খাতের ওপর ভর্তুকি দেওয়া যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে আমাদের মাছ রপ্তানি ক্ষেত্রে বেশি শুল্কারোপ হবে। এবং মাছ রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
“আমাদের ইলিশকে সামুদ্রিক মাছ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ এটা নদীর মাছ। তাই ডাব্লিউটিওর কাছে আবেদন করে ইলিশ মাছ সামুদ্রিক মাছের তালিকা থেকে বের করে আনতে হবে।”
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কৃষি ও মৎস্য খাতে ভর্তুকি নিয়ে চাপ থাকবে। বিশেষ করে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে। তবে কৃষি ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যের ১০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া যাবে, বাংলাদেশ এখন ২ শতাংশের কম দিচ্ছে।”
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন আগামী ২৬ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় কয়েক দফা স্থগিত থাকা দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন ২০২২ সালের জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বর্তমানে ১৬৪টি দেশ ডব্লিউটিওর সদস্য। এই সংস্থার এলডিসি গ্রুপের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ বাংলাদেশ।
এলডিসি থেকে উত্তরণ পর্যায়ে থাকায় এবারের সম্মেলনও বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্মেলনে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা করবে, ডব্লিউটিওর ভবিষ্যৎ কাজের বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেবে এবং ১৪তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের রোডম্যাপ পথ নকশা তৈরি করা হবে। এসব বিবেচনায় এবারের সম্মেলনকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্ব দেবে।
আলোচনায় অংশ নেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন মাসুম, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্লানিং এডিটর আসজাদুল কিবরিয়া ও র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ।