অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র যাচাইয়ের নির্দেশনা আছে এনবিআরের। এ জন্য যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে নিজেরাই তথ্য হালনাগাদ করতে পারছে না।
Published : 14 Nov 2023, 08:25 AM
একটি বেসরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত আছে আয়েশা তাবাসসুমের। তার কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন আছে। গত বছর রিটার্ন জমাও দিয়েছেন। তার প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও আছে। ফলে বছর শেষে মুনাফার ওপর তার কাছ থেকে ১০ শতাংশ কর কাটার কথা থাকলেও ব্যাংক কেটেছে ১৫ শতাংশ।
আয়েশার সঙ্গে একই সঙ্গে ব্যাংকে যাওয়া আরও ছয় জন একই সমস্যার মুখোমুখি পড়ে হতবাক হয়েছেন। কারণ, তারা সবাই জানতেন টিআইএন সনদ এবং রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র দেখালে ১০ শতাংশ কর কাটার কথা, কিন্তু তাদের কাছ থেকে কর কাটা হয়েছে তার দেড় গুণ।
আইন অনুযায়ী টিআইএন নম্বর না থাকলে আমানতের মুনাফা ওপর কর কাটা হয় ১৫ শতাংশ, যাদের টিআইএন নম্বর আছে এবং রিটার্ন হালনাগাদ আছে, তার কাছ থেকে কর কাটা হয় ১০ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ক্ষেত্রেও একই বিধান।
একই বিধান আছে পুঁজিবাজারেও টিআইএন নম্বর না থাকলে পুঁজিবাজারের লভ্যাংশের ওপর থেকেও এভাবে ১৫ শতাংশ কর কাটা হয়, আর কর শনাক্তকরণ নম্বর থাকলে ১০ শতাংশ কাটা হয়। এ কারণে করযোগ্য আয় না থাকলেও অনেকেই টিআইএন নম্বর নেন এবং আয়কর রিটার্নও জমা দেন।
কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সিদ্ধান্তে এই কর কম দেওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন না বহু করদাতা। কারণ, তাদের কর প্রাপ্তি স্বীকারপত্র গ্রহণ করছে না ব্যাংক।
এরও কারণ এনবিআরের একটি সিদ্ধান্ত।
রাজস্ব বোর্ড ব্যাংকগুলোকে অনলাইনে একটি ওয়েবসাইট থেকে কর প্রাপ্তি স্বীকারপত্র যাচাই করতে বলেছে। এটি অনলাইনে আপলোড করার দায়িত্ব এনবিআরের নিজের। কিন্তু গত বছর যারা রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাদের সব তথ্য আপলোড করতে পারেনি সংস্থাটি। এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন করদাতারা।
একই ঘটনার ভুক্তভোগী একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক। তিনি তার রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখালেও অনলাইনে সেটি খুঁজে না পাওয়ায় ব্যাংক তার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ আয়কর কেটে নিয়েছে। এরপর ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে এনবিআরের সেই নির্দেশের কথা জানতে পারেন তিনি।
তিনি জানান, এনবিআর ব্যাংকগুলোকে রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র অনলাইনে যাচাই করতে বলেছে। এ জন্য একটি ভেরিফিকেশন সাইটও আছে। ব্যাংকগুলো সেই সাইটে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রসিদ খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে তারা ১৫ শতাংশ আয়কর কেটে নিচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি রিটার্ন দাখিল করেছি এবং প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও পেয়েছি। ব্যাংক থেকে মুনাফা তোলার সময় তার কপিও দাখিল করেছি। কিন্তু ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সেই রসিদ অনলাইনে চেক করে পাওয়া যায়নি জানিয়ে আমার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ কর কেটে নিয়েছে।”
‘এক বছর আগের রিটার্নের রসিদ কেন এনবিআর কর্মকর্তারা অনলাইনে আপডেট করতে পারলেন না?’ এই প্রশ্ন রেখে সেই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, “এর দায় তো ঠিকমত কর প্রদানকারীদের নয়! কেন তারা বেশি অর্থ দেবেন?”
কেবল ব্যাংকে নয়, অনেক দূতাবাসে ভিসার জন্য রিটার্নের এই রসিদ জমা দিতে হয়। এনবিআরের ভেরিফিকেশন সাইটে সেই তথ্য না থাকায় ভিসা আবেদন প্রার্থীদের ‘খরচা-পাতি’ করে নিজেদের রসিদ অনলাইনে তোলার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, এমন অভিযোগও মিলছে।
কী বলছে ব্যাংক
বাড়তি কর কাটার যে তথ্য ভুক্তভোগীরা দিচ্ছেন, সে বিষয়ে জানতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের মতিঝিলের লোকাল অফিস শাখার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এনবিআরের চিঠির একটি কপি দিয়ে বলেন, “আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কর কাটার সময় গ্রাহকের রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র সত্যতা যাচাই করতে হবে।
“এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে করদাতার প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও থাকার পরও আমাদের সত্যতা যাচাই নিশ্চিত করতে হয়। এবং আমরা সরকারি ওই অনলাইনে না পেলে অতিরিক্ত কর কাটতে হয়।”
http://verification.taxofficemanagement.gov.bd ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র যাচাই করা হয় বলেও জানান সেই ব্যাংকার।
কথা বলবেন না এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা
অতিরিক্ত কর কেটে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে জবাব দিতে রাজি হননি এনবিআরের আয়কর নীতির সদস্য শামস উদ্দিন আহমদ।
পরে তার বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “আমাদের কাছে এ রকম অনেক অভিযোগ আসছে। কিন্তু আমরা কোনো সমাধান দিতে পারছি না।”
যেসব করদাতা হার্ড কপি বা কাগজের ফরম পূরণ করে (ম্যানুয়াল) আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এই সমস্যা কেন হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “এনবিআর জনবলের অভাবে রিয়েলটাইমে সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে পারছে না।”
এনবিআর এই খাতে বর্তমানে যে জনবল আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ রিটার্ন দাখিলকারীর তথ্য আপলোড করতে পারে জানিয়ে সেই কর্মকর্তা বলেন, “অথচ চলতি অর্থবছরে আমাদের অনেক বেশি রিটার্ন দাখিল হতে পারে। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে এনবিআরকে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিতে হবে।”
২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যক্তি শ্রেণির ২৮ লাখ ৫১ হাজার করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। তার আগের বছর এই সংখ্যাটি ছিল প্রায় ২৩ লাখ।