মহামারী: টাকার জন্য গয়না বেচে দিচ্ছেন ভারতীয়রা

সোনার গয়না বন্ধক রেখে গত বছর ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছিলেন পল ফার্নান্দেজ। কিন্তু এ বছর সেসব গয়না তাকে ছেড়েই দিতে হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2021, 09:20 AM
Updated : 12 July 2021, 11:12 AM

ভারতের গোয়া উপকূলের ৫০ বছর বয়সী এই প্রৌঢ় এক প্রমোদ তরীতে ওয়েটারের চাকরি করতেন। মহামারীর মধ্যে গত বছর তার চাকরি চলে যায়। এরপর আর চাকরি জোটাতে পারেননি। নিজে ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন।

তিনি বলেন, “সোনার গয়না বন্ধক রেখে যে টাকা পেয়েছি সে তো শেষ পর্যন্ত একটি দেনাই। গয়নাগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আর সুদ গুণতে হবে না।”

সোমবার এনডিটিভির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারীতে অভবে পড়ে পল ফার্নান্দেজের মত ভারতের কোটি নাগরিক তাদের শেষ সঞ্চয় সোনার গয়নাগুলো বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সোনার গয়না ভারতে কেবল সাজসজ্জার উপকরণ নয়, বিভিন্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামের মানুষই সেখানে সোনার গয়নার সবচেয়ে বড় ক্রেতা।

করোনাভাইরাসের মহামারীতে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিই সবচেয়ে খারাপ দশায় পড়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংক কম বলে অভাবের তাড়নায় গতবছর অনেকে গয়না বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার সংক্রমণের দ্বিতীয় ফেউয়ের পর তারা তা বিক্রি করে দিচ্ছেন।

লন্ডন ভিত্তিক ‘মেটালস ফোকাস লিমিটেড’ এর উপদেষ্টা চিরাগ শেঠের মতে, ভারতে যদি সংক্রমণে তৃতীয় ঢেউ দেখা দেয়, তাহলে বিক্রির চাপে ‘গিনি বা কাঁচা সোনার’ মোট সরবরাহ বেড়ে গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ২১৫ টনে উঠতে পারে।

ভারতে আমদানি করা সোনার বড় অংশই আসে সুইজারল্যান্ড থেকে। এখন দেশের ভেতরে হাতে থাকা গয়না বিক্রি বেড়ে গেলে আমদানি কমে যাবে।

এনডিটিভি লিখেছে, মহামারীতে পঙ্গু হতে বসা অর্থনীতিতে ভারতে যারা এখনও নিজেদের দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখতে পেরেছেন, তাদের অনেকের কর্মসংস্থান এখন গভীর অমানিশায় পড়েছে। ২০ কোটির বেশি মানুষের আয় দৈনিক ৫ ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

ভারতের সবচেয়ে বড় বন্ধকী ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ‘মনপুরাম ফাইন্যান্স লিমিটেড’ গত মার্চ থেকে তিন মাসের মধ্যে ৪০৪ কোটি রুপির সোনার গয়না নিলামে বিক্রি করেছে, যাকে ‘বিপর্যয়ের প্রাথমিক লক্ষণ’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এর মধ্যে সোনার দামও পড়ে গেছে। যারা গয়না বন্ধক রেখে ঋণ করেছিলেন, তা তারা পরিশোধ করতে পারছেন না। সুদের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তারা গয়না বিক্রি করে দিচ্ছেন।

এনডিটিভি লিখেছে, এ বছর মার্চের আগে নয় মাসে মনপুরাম ফাইন্যান্স ৮ কোটি রুপির সোনার গয়না নিলামে বিক্রি করেছিল। গয়না বন্ধক রেখে ধার নেওয়া টাকা শোধ করতে না পারলে সেসব সোনা নিলামে তোলা হয়।

কচি ভিত্তিক রিফাইনার ‘সিজিআর মেটালয়েস প্রাইভেট’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেমস জোস জানান, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে সোনার গয়না কিনে রাখার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক সময়ে সেখানে আগে সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ পুরনো সোনা গয়নার দোকানে বিক্রি করত, এখন সেই হার ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।

“লকডাউনের পর দোকান খুলে দেওয়া হয়েছে। আপনি দেখবেন গয়নার দোকানে লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে। তার দুটি কারণ: একটি হল বিয়ের মৌসুম, লোকজন কিনতে যাচ্ছে; আর দ্বিতীয়ত নগদ অর্থের জন্য মানুষ গয়না বিক্রি করতে যাচ্ছে।”

অর্থনীতির অবস্থা খাপার হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই ভারতীয়দের সোনার গয়না কেনা কমেছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশটিতে সোনার গয়না বিক্রি নেমে এসেছে গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচে।

তবে ‘মেটালস ফোকাস লিমিটেড’ এর উপদেষ্টা চিরাগ শেঠ বলছেন, দাম পড়ে যাওয়ায় এবং বিয়ের কারণে এ বছর ৫০ টন সোনার গয়না কিনেছে মানুষ। সে কারণে এবছর চাহিদা ২০২০ সালের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি হতে পারে। তবে এই অনুমানের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হচ্ছে মহামারীর সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ।